Home Blog Page 2

সেইসব বনফুলস্মৃতি এবং আমার করোনাকালীন “ভাবনা”

0

নির্ধারিত শিরোনামের উপর বিস্তারিত আলোকপাত করার আগে পাশের ছবিখানির কিয়ৎ ব্যাখ্যা টানার প্রয়োজন আছে। ছবিটি আজ থেকে প্রায় ২০/২২ বছর আগেকার একটি ছবি। ১৯৯৭/৯৮ এর দিকের ছবি। তখন আমি ২য় শ্রেণীর সুবোধ বালক।

ডানপাশ থেকে-

২য় সারিতে- ১. শংকর তঞ্চঙ্গ্যা ২. পাইন্দুমং মারমা

৩য় সারিতে- ১. প্রদীপ ত্রিপুরা ২. স্বতসিদ্ধ চাকমা ৩. এপোলো চাকমা

৪র্থ সারিতে- ১. রাসুময় তঞ্চঙ্গ্যা ২. তন্ময় দেওয়ান

বর্তমান যে “বনফুল আদিবাসী গ্রীণহার্ট স্কুল এন্ড কলেজ” তার নাম তখন ছিল- “বনফুল শিশু সদন”। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে তুলনামূলকভাবে ছিন্নমূল এবং অনাথ শিশুদের ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিনামূল্যে আবাসিক শিক্ষা প্রদানের এক স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান ছিল বনফুল শিশু সদন। তখন রাঙ্গামাটির মোনঘর শিশু সদন এর একটি দূরবর্তী প্রতিষ্ঠান ছিল এটি।

ফ্রান্সের বিখ্যাত সংস্থা “PARTAGE” অর্থায়ন করতো মোনঘর এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য মানবসেবামূলক প্রকল্পগুলোকে। ছবিটি তুলেছিলেন শ্রীমৎ উত্তমালঙ্কার ভিক্ষু। তিনি জাতিতে মারমা। শুনেছি তিনি বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। আমাকে খুব ভালোবাসতেন। রেসলিং পছন্দ করতেন। আমাদেরকে দিয়ে ডেমো রেসলিং খেলাতেন। তিনি হতেন আন্ডারটেকার আর আমাদের একেকজনকে বানাতেন- অস্টিন গোল্ড, রক, কেইন, ট্রিপল এইচ, বিগ শো ইত্যাদি। তিনি ছিলেন হাউস তত্বাবধায়ক আর আমরা ছাত্র।বর্তমান বনফুলের যেখানে ডাইনিং হল টি আছে তার উপরে, দোতলায় থাকতাম আমরা। ১৬ জনের বেড। আমাদের উপরের তিনতলায় হাউসটিচার ছিলেন নভেন্দু চাকমা দা।

প্রত্যেকদিন ভোরে বন্দনাপর্ব শেষে সূর্য উঠি উঠি করা মাত্রই উন্নতমানের নাস্তা- ডিম, পাউরুটি, কলা এবং একগ্লাস দুধ। যেখানে বাড়িতে দুবেলা নিয়মিত ভাত জুটতো কি জুটতো না সেইসব প্রান্তিক আদিবাসী ছেলের জন্য এমন প্রাত:নাস্তা রাজার খানাপিনা বটে। এরপরে ৮ টার দিকে স্কুল। সত্যি মনে আছে- আমার ২য় শ্রেণীর প্রিয় সাবেজক্ট ছিল- পরিবেশ-পরিচিতি সমাজ! খুব সম্ভব নবারুন স্যার নামে একজন পড়াতেন। স্কুলের প্রধান ছিলেন তন্দ্রা চাকমা দিদি। ১২ টার দিকে স্কুল ছুটি হতো। দুপুরের দিকে ক্যারম, লুডু, দেশভ্রমন লুডু, দাবা, টেনিস, টেবল টেনিস প্রভৃতি ইনডোর গেমস খেলার সুযোগ ছিল। 

দুপুরের খাবারের তালিকায় প্রত্যহ মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, সবজি- দুপুর ১টায়। রাতের বেলায়ও একপ্রকার তাই- রাত ৮টায়। বাবুর্চি মামুদের মধ্যে অমিত মামু-র নামখানিই কেবল মনে আছে। বিকেলের দিকে ছেলেদের অধিকাংশ ক্রিকেট খেলতো। দুইটা দোলনা ছিলো মাঠে- সেগুলো থাকতো মেয়েদের দখলে। আর ছিল টিভিরুম। বিশাল লাইব্রেরীতে ছিলো নানাধরনের বই। বছরে বেশ কয়েকবার টি শার্ট, স্কুল ড্রেস, জুতাসহ নানাধরনের পোশাক-পরিচ্ছদ, দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপাতি পেতাম আমরা। ব্যবহৃত পোশাক নিজেদের ধুতে হতো না। চাচামিয়া আসতেন প্রতি সপ্তাহে, ময়লা কাপড়চোপড়গুলো রুমভিত্তিক সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন, ধুয়ে আবার দিয়ে যেতেন যার যার রুমে।ছোট ছোট আলমারি ছিল সবার জন্য যেখানে পরিপাটি করে বইপত্র রাখা যেত আর হেঙ্গারস্ট্যান্ডে ঝুলিয়ে রাখা যেত কাপড়-চোপড়। ব্যবহার করে শেষ করা যেত না জিনিসপাতিগুলো। বছরান্তে বার্ষিক পরীক্ষার পরে একবার মাসখানেকের জন্য বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হতো A, B, C, D  চারটি “চ্যালেনজারস” বাসে। পথে বাসগুলোর মধ্যে হালকা প্রতিযোগিতা হতো। কী যে আনন্দ।

প্রথমে রাঙ্গামাটির মোনঘরে ড্রপ করা হতো, পরে সেখানে খাগড়াছড়ি বা বান্দরবান এবং রাঙ্গামাটির অন্যান্য উপজেলা থেকে অভিভাবকরা তাদের আদরের “ধনও”, “তুঙঙো”,  “চিক্কো’ “পরান্নে” “বাবু”-কে বহুদিন পর বাড়িতে নিতে আসতেন। অনেকে শার্ট বা অন্যান্য পোষাকগুলো জমিয়ে রাখতো ছুটির সময় বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য যেন ঘরে ফেলে আসা ভাই বা বোনটিকে ঢাকার উপহার হিসেবে চমকে দেওয়া যায়।

অনেক পোশাক-পরিচ্ছদ আসতো সোজা বিদেশ থেকে। তাই সেগুলোর মান, উফ্ -ওয়াও! খেলাধুলা দাদু আসতেন প্রতি শুক্রবার সকালে। দৌড়ানো, লংঝাম্প, হাইঝাম্প আরো কি কি জানি ব্যায়াম-তেয়াম শেখাতেন। কখনো কখনো নিয়ে যেতেন ক্যাম্পাসের বাইরে। ক্যাম্পাসবন্দী শিশুর হঠাৎ উন্মুক্ত আকাশ দেখার আনন্দঘন মজা তখন দেখে কে! প্রতি শুক্র-শনিবার বিকেলে গান, নাচ, আবৃত্তি, অভিনয় প্রভৃতি শেখানো হতো। আর্ট শেখাতেন ধনমনি দা। আমার আর্ট, গান, খেলাধুলা কিছুই ভালো ছিলো না- তবে মনে আছে একটা গানের দুই লাইন মুখস্থ করতে সক্ষম হয়েছিলাম-

“ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে- বহে কিবা মৃদুবায়”

বেশ ওইটুকুই আমার আনুষ্ঠানিক সংগীত শিক্ষা। আর আর্ট শেখার মধ্যে মনে আছে – বড় আকারের একটি ৫ লিখলে তার মাথায় উপর দিক থেকে একটা বক্ররেখা টেনে দিলে আর ৫ এর উপর সবুজ রঙ মেরে দিলেই, বেশ ঝটপট একটা কাঁচা আম হয়ে যেত। বছরে দুইবার আমাদের ঢাকাস্থ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান বা বিনোদন পার্কে নিয়ে যাওয়া হতো। এই যেমন জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, শিশুপার্ক, বোটানিকেল গার্ডেন। তখন পাহাড়ি সমাজে ডিস টিভি ছিল অলীক কল্পনা মাত্র। আর আমরা ঢাকা পড়ুয়া কতিপয় শিশু কত না ভাগ্যবান ছিলাম। বনফুলের টিভিরুমে আমরা ছেলেরা প্রচুর ক্রিকেট আর রেসলিং দেখতাম। মেয়েরা দেখতে চাইতো হিন্দি গানের চ্যানেলগুলো। এ নিয়ে ছেলে-মেয়ে প্রায়ই টিভি রিমোট নিয়ে লাগতো। এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে রিমোট চলে যেত “Pappay” বা “Tom and Jerry”- র উপর। ছেলে-মেয়ে সবার পছন্দ ছিলো এ দুটি কার্টুন। বিশেষত পেপেয় যখন তার বিশেষ বলবর্ধক ঔষধ- ঘাস বা Weed  টুকু সেবন করা মাত্রই বলশালী হয়ে যেতেন এবং অসাধ্যকে সাধ্য করে ফেলার ক্ষমতা অর্জন করতেন, তখন সবার মধ্যে কী যে হাসির রোল! দ্যা মাস্ক মুভিটি ছিলো অনেকের প্রিয়। কতবার যে দেখেছি- দ্যা মাস্ক! ছেলেদের অনেকেই ক্রিকেট খেলতো, কমিকস পড়তো। বিখ্যাত ক্রিকেটারদের ছবি, নানা কমিকস বই এবং তিলের খাজা, গাজর প্রভৃতি ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে সংগ্রহ করে এনে দিতেন দারোয়ান দাদু-রা।

ক্রিকেটার হিসেবে আমার পছন্দের তালিকায় ছিলো বাংলাদেশের পাইলট, অপু, ভারতের মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, শ্রীলঙ্কার চামিন্দা ভাস, রমেশ কালুভিতারানা, আফ্রিকার শন পোলক, এলান ডোনাল্ড, ল্যান্স  ক্লুজনার, অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাকগ্রা, জ্যাসন গিলেস্পি, জিম্বাবুয়ের এ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওয়ালস ভ্রাতৃদ্বয়, পাকিস্তানের সাকলায়েন মুশতাক।

বিখ্যাত খেলোয়ারদের ছবি বা কমিকস বুকস সংগ্রহ করা হতো। আমার সংগ্রহে ছিল মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের একটি পোস্টার। আমি তেমন একটা কমিকস পড়ি নি। রুপকথা বা গল্পের বই ভালো লাগতো। অনেকেই টিনটিন, শক্তিমান ও অভয়, চাচা চৌধুরী ও সাবু প্রভৃতি কমিকস পড়তো। আমি ক্রিকেট টিমেও চান্স পেতাম না। তাই আমার গত্যন্তর  ছিলো হয় দাবা খেলা নতুবা লাইব্রেরী।

বলাবাহুল্য- দাবা খেলায় বহু সিনিয়রকে হারিয়ে দিতে সক্ষম ছিলাম। আমাদের হাউসটিউটর উত্তমালঙ্কার ভান্তে ক্যাম্পাসে-র প্রায় সকলের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন। ছাত্র-শিক্ষক কর্মচারী সবার কাছে। তার একটি কম্পিউটার এবং একটি ডেস্কসেট ক্যাসেট প্লেয়ার ছিলো। রুমে থাকলে তিনি সাদা মনিটরের সেই উইন্ডোজ ৯৮-এ তাস খেলতেন অথবা ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজাতেন রণজিৎ দেওয়ানের এ্যালবাম “মর চব্বিশ বজরর হোজপানা” থেকে-

“হোই হোই হোই হোই হোই হোই জুমোত যেবঙ

জুমোত যেই নে গোচ্চে সুদো তুলিবোঙ।”

অথবা-

“মর চব্বিজ বজররররররররররররর হোজপানাআআআআআআঅ

বুগোত গুরি তরে বাবেলুং ল- নাআআ আআ আ আ আ! ”

সেসময় বনফুল এ কেউ পড়ার সুযোগ পেয়েছে মানে ছোট-বড় গ্রামের সকলের কাছে সে বিশাল আগ্রহের পাত্র। আমরা পাহাড়ের সেইসব ভাগ্যবান কতিপয় শিশু যারা ডিস টিভি, খেলাধুলা, রাজকীয় খানা, মানসম্পন্ন শিক্ষা, উন্নত সমাজ-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ আর সুশৃঙ্খল জীবনের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম সেই শৈশবেই, যখন পাহাড়ে ‘‘শিক্ষা” শব্দটি-ই ছিল একটি বিলাস। ঢাকা-র সাথে তখনও পাহাড়ের খুব একটা নৈকট্য ছিলো না। কেননা এই তো কিছু আগেও যে রক্তধারার জনপদ ছিল- পাহাড়। ৯৭ এর শেষেই না “পার্বত্য চুক্তি” হয়েছিলো ।  আমার বনফুল ভর্তি একপ্রকার কাকতালীয়। মোনঘর বা বনফুলে তখন ভর্তি করা হতো অনাথ-ছিন্নমূল-হতদরিদ্র শিশুদের। আবার প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষাও দেওয়া লাগতো। অন্যদিকে আমার বাপ সরকারি চাকুরে, তাই সে অর্থে আমি ছিন্নমূলও নই, অনাথও নই, হত-দরিদ্রও নই। ঘটনা হলো- লটারি! আমার মা একটা ভর্তি ফরম কিনেছিলেন- হলে হলো, না হলে নাই এমন। তো- মোনঘর প্রতিষ্ঠানটি যেহেতু আমাদের গ্রামে অবস্থিত, আমাদের গ্রামের অনেকের প্রত্যক্ষ শ্রম বা অন্য-অনেক অবদান আছে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠার পেছনে, সেহেতু আমাদের রাঙাপান্যে গ্রামবাসীর দাবী ছিল- প্রতিবছর কমপক্ষে তিনজন ভর্তি করতে হবে রাঙাপান্যে থেকে।

বনফুল শিশু সদন কমপ্লেক্স এ রয়েছে শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহার। শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহারে লেখকের পিতা-মাতা! ছবি: লেখক

আবার আমাদের পাশের গ্রাম ভেদভেদী থেকে ২জন ভর্তি করতে হবে। মোনঘরের পেছনে ভেদভেদী-বাসীরও অবদান আছে। ভেদভেদী আর রাঙামাটির মিলনস্থল হলো মিলন বিহার, সেই মিলন বিহার-কে কেন্দ্র করেই মোনঘর। যাই হোক, কর্তৃপক্ষ মেনে নিলো এলাকাবাসীর দাবী। প্রতিবছর রাঙাপান্যে থেকে ৩ জন এবং ভেদভেদী থেকে ২ জন অবধারিতভাবে বনফুলে ভর্তি-র সুযোগ পাবে। কিন্তু কাকে রেখে কাকে ভর্তি করা হবে? সমাধান- যারা ভর্তি ফরম কিনবে- সেগুলোর মধ্যে চলবে লটারি, যার নাম উঠবে সেই- “বুনোফুল”!

নির্ধারিত দিন রাঙাপান্যে-র ভৈরব চন্দ্র কার্বারী-র উঠোনে জড়ো হলেন ভেদভেদী-রাঙাপান্যের কার্বারী-মেম্বার-গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং ভর্তি ফরম বা লটারি কেনা সেইসব অভিভাবকরা। একে একে লটারিতে নাম উঠবে ভাগ্যবান বুনোফুলদের। থমথম উত্তেজনা। প্রথমেই নাম উঠলো-

মঙ্গলসোনা চাকমা! এরপরে- মিন্টু চাকমা! ভেদভেদীর পালা শেষ। এবার রাঙাপান্যে-র পালা। কারা সেই ভাগ্যবান তিনজন?

প্রথমে নাম উঠলো- রঙ্গদেবী চাকমা, পিতা- ভাগ্য চাকমা। এরপর চিক্কোমুনি চাকমা, পিতা- বৃক্কমুনি (জব্বর) চাকমা। এবার সর্বশেষ জন! কে সে????? যারা পড়ছেন- বুজতেই পারছেন, রাঙাপান্যের ভৈরব চন্দ্র কার্বারীর উঠোনে সেদিনকার সেই সর্বশেষ ভাগ্যবান শিশু- আর কেউ নয়, এই নরাধম- আজকের হেরেঙা, মি: সুলভ চাঙমা ঢেঙা! পাঠককল্পনায়- (একটা ইমো হবে এখানে) অথবা বাংলা সিনেমার কোন এক আবহ সঙ্গীত!

আমার বনফুল জীবনের সমসাময়িক আরো কিছু ঘটনা মনে আছে।

. “কহোনা প্যায়ার হে” গানখানি-নতুন রিলিজ পেয়েছে তখন এবং সুপারহিট। ঋত্বিক রোশন সমুদ্র পারে আই লাভ ইউ বলতে বলতে আমিশা প্যাটেলের দিকে ছুটে যাচ্ছেন এই গানটি বাজলেই তখনকার বনফুল মেয়েরা পাগল হয়ে যেত। আর ছেলেরা তখন রিমোট কেড়ে নিতে চাইতো রেসলিং বা ক্রিকেট চ্যানেল চালিয়ে দিতে।

২. সম্ভবত ১৯৯৮ বা ৯৯ সালে প্রয়াত চাকমা রাণী তাতু রায়ের মৃত্যু হয় ঢাকা বা কলকাতায়। তার মরদেহ বনফুলে আনা হয়েছিলো কিছু সময়ের জন্য। ঢাকাস্থ পুরো জুম্মসমাজ বনফুলে মিলিত হয়েছিলো সেদিন। আমরা বনফুলের সবাই প্রয়াত রাণী-র মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলাম।

৩. আকরাম খানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে পরাজিত করে ১৯৯৯ সালে। রাত ১০ টা কি ১১ টায় বোধহয় ঢাকার রাজপথ যেন জনারণ্য। শৈশব উল্লাসে আমরাও বনফুলের কেউ কেউ হয়তো চিৎকার করে বলেছিলাম- বাংলাদেশ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ। ১৯৯৯ এর শেষে সম্ভবত পারতেজ মোনঘর এবং মোনঘর সংশ্লিষ্ট সকল অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। আমাদের চলে যেতে হয় “অহদে অহ্দ ফিত্তি আয়”। আমার বনফূল স্মৃতি-র আনুষ্ঠানিকতা এখানেই সমাপ্ত।

শুধু বাস্তব মূর্ত স্মৃতি হয়ে আছে উপরের ছবি টি। তাও-সবার চেহারা বোঝা যায়- কেবল আমার মুখাবয়ব ঝলসে গেছে।

লেখার অন্যতম আলোচ্য “করোনা” -তে আসি।

করোনায়-য় এখন পুরো বিশ্ব কাবু। করোনা আমাদের সবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো বৈষয়িক ভোগ-বাসনায় মত্ত হতে হতে আমরা দিনদিন কেমন নির্লজ্জ-বেহায়া সমাজ তৈরী করছি। পুজি-র চরম বিকাশের এই যুগে ভোগবাদী লালসা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি ও আধিপত্য বিস্তারের উগ্র বাসনা সমগ্র বিশ্বজুড়ে তৈরী করেছে এক বিশালকায় বৈষম্যের শৃঙ্খল। বিশ্বজুড়ে নিত্য হানাহানি, বিভেদ, হিংসা-বিদ্বেষ, রেষারেষি, যুদ্ধের দামামা। এর শেষ কোথায়? কোনদিকে যাচ্ছে মানবসমাজ ও সভ্যতা? পৃথিবী নামক এই গ্রহের ভবিষ্যত-ই বা কী? করোনা আমাদের নতুন করে মনে করিয়ে দিলো- প্রকৃতির কোনও কোনও অমোঘ সত্যের কাছে আমরা কখনো কখনো নিতান্তই অসহায়। করোনা আমাদের সবাইকে ভাবাচ্ছে-হাসাচ্ছে-কাঁদাচ্ছে, শেখাচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে আবার সাহসও যুগাচ্ছে। করোনাকালে নানাজনে নানাউদ্যোগ, সামাজিক কর্মকান্ড, অনলাইনে ব্যক্তিগত ভাবে পরামর্শমূলক টিপস দেওয়া প্রভৃতি প্রশংসনীয়-অণুস্মরণীয় ভালো ভালো কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের আদিবাসী ভাই-বোনেরাও অনেকেই সক্রিয় ভূমিকায় মাঠে নেমেছেন। আমি কিছুই করতে না পারা-দের দলে আছি আপাতত। তাই পেট-পুড়ে ঘাস খাওয়া গরুর মতন কিছু পুরনো এবং শৈশবীয় স্মৃতি-অস্মৃতি জাবর কাটছি। অনেকেই করোনা- লকডাউনে আটকে পড়ে “চিৎ ন ভিজ্চ্যে মন” আর “তেনেয়ে মনরিভেং” নিয়ে দিনের পর দিন হুদাই বাড়িতে পড়ে থাকার বিরক্তিতে আছেন। অনেকের মনে হয়তো অপ্রত্যাশিত অস্বস্তি-উৎকন্ঠা-উদ্বেগ-হতাশা-নিরাশা-র ছাপ। আমি করোনাকালে আমার দুইটা পুরনো ভালো অভ্যেস পুন:জাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে কিছু সুফল পেয়েছি। ভালো লাগলে কেউ কেউ সত্য সত্যই চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

  • ১.            বই পড়া
  • ২.           ধ্যান বা ভাবনা বা মেডিটেশন

আমি এই করোনাকালে রাঙামাটির রাজবনবিহারে ৩৩ দিনের পরীক্ষামূলক স্বেচ্চা ব্রক্ষ্মচর্যা বা শ্রামণ্যব্রত পালন করে আসলাম। সুবাদে রাজবন লাইব্রেরীতে বেশ কিছু বইয়ের সাথে সন্ধি হয়েছে। এই যেমন- May Flower by C. T Shen, Buddha and His Teachings by Narada, Buddhist Wisdom and Faith by Thich Thein Tam,  শান্তিপদ ও প্রজ্ঞা দর্শন – সুবল চন্দ্র বড়ুয়া, জাতক পঞাশক- জিনবংশ মহাথেরো, জ্যোতিপাল মহাথেরর চর্যাপদ, প্রয়াত সংঘরাজ শীলালংকার মহাস্থবিরের তিনটি অসাধারণ জীবনীমূলক বই আনন্দ, জীবক, অজাতশত্রু, ডা: ভগদত্ত খীসা রচনা স্মারক, দক্ষিণ-পূর্ব বাঙলায় ফ্রান্সিস বুকানন, নারায়ণ স্যানালের অজন্তা-অপরুপা এবং শ্রদ্ধেয় বনভান্তের নিজের লেখা দুটি বই – সুদৃষ্টি এবং সুত্ত-নিপাতের কিয়দংশসহ আরো বেশ কিছু দেশী-বিদেশী বই।

পড়তে যেয়ে ভালোলেগেছে এমন কিছু বই থেকে দুএকটি কোটেশন তুলে দিচ্ছি এখানে-

“ক্ষমা ও মৈত্রী-করুণাই চিত্তের পবিত্রতা আনয়ন করে। চিত্তের মল স্বরুপ বৈরভাবের বিরামেই জীবন হয় সুন্দর ও শান্তিময়। শত্রুর চেয়েও মানুষের সমধিক ক্ষতিকারক বিপথগামী চিত্ত। আসক্তি-বন্ধন লৌহ বন্ধন হতেও দৃঢ়তর।” 

– আনন্দ, শীলালংকার মহাস্থবির।

“This Body of Flesh and Blood I bear

Just for the World’s

Good and Welfare”

– Sri Sanghabodhi.

“I looked at my brother with microscope of criticism

And I said, “How coarse my brother is!”

I looked at him through the telescope of scorn

And I said, “How small my brother is!”

Then I looked in the mirror of truth

And I said, “How like me my brother is!”

– Bolton Hall

“The gift of Truth Excells all other Gifts.”

 – Dhammapada, Narada.

এই করোনাকালে ঘরের বাইরে যেতে না পারলে কিছু বই তো পড়া যেতেই পারে!

হয় বই পড়ুন নয় ধ্যান করুন! ধ্যান বা ভাবনা প্রসঙ্গে আসি। কেবল করোনাকালীন উঠকন্ঠার সময়ে নয়, যে কোন মানসিক অস্থিরতা-উদ্বেগ-উঠকন্ঠা-হতাশা-নিরাশা বা কোন দুর্বিসহ স্মৃতি কাটিয়ে উঠার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী একটি জনপ্রিয় এবং পরিচিত প্রেসক্রিপশন হচ্ছে নিয়মিত ধ্যান/ভাবনা/মেডিটেশন চর্চা করার অভ্যাস। সংস্কৃত ধ্যান শব্দটিকে জাপানীরা বলে জেন ((ZEN)), চাইনীজরা চেন (CHAN)। ধ্যান বিষয়ক প্রচুর কন্টেন্ট পাওয়া যাবে অনলাইনে। ইউটিউবে মিলবে সহ¯্র টিউটোরিয়াল।মেডিটেশন লিখলেই দেখবেন কতশত কন্টেন্ট। পৃথিবীর তাবৎ মোটিভেশনাল স্পিকার বা প্রতিষ্ঠিতজনরা অবশ্যকরণীয় তালিকা করতে গেলে “ভাবনা”-র কথা উল্লেখ না করে পারেন না। আমাদের মনের অস্থির প্রকৃতিকে বোঝানোর জন্য ইংরেজীতে একটি টার্ম ব্যবহার করা হয়- “Monkey Mind”। প্রকৃতই আমাদের মনচিত্তে-র গতি-প্রকৃতি অনেক সময় স্বয়ং আমরা নিজেরাও বুজতে সক্ষম নই। বানরের মতো কখন কোন গাছ থেকে কোন গাছে, কোন শাখা থেকে কোন শাখায় সে লাফ দিয়ে বেড়ায় তার ইয়ত্তা নেই। তাছাড়াও বৌদ্ধ শাস্ত্র মতে, আমাদের মনে নীরবে বাসা বেধে থাকে নানাবিধ মন:ব্যাধি; লোভ-দ্বেষ-মোহ! এজন্য আত্মপ্রশান্তি, আত্মউন্নতি, আত্মসমৃদ্ধি সবকিছুর জন্য বৌদ্ধ শিক্ষায় জীবনযাত্রার সবক্ষেত্রেই সংযম-কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

বুদ্ধ তিন প্রকার সংযম বা শীল এর কথা বলেছেন- ১. কায় সংযম শীল ২. মন:সংযম শীল ৩. বাক্য সংযম শীল। এই তিনটি শীলই বাকি সকল বৌদ্ধ শীলাচার-বিনয় বা নিয়ম কানুনের মূল উৎস। কায় বা শরীরের সংযম, মনের সংযম এবং বাক্যে বা কথা-বার্তায় সংযম প্রতিষ্ঠার জন্যই মূলত বৌদ্ধরা ধ্যানস্থ হন বা নিয়মিত ভাবনা চর্চা করে থাকেন। বোধহয়, বিশ্বাসী বা চর্চাকারী অর্থে আমি তেমন একটা বৌদ্ধ চর্চাকারী নই, তবে বুদ্ধের শিক্ষা ও দর্শন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা অর্জনের লোভ আমার বহু আগে থেকে। তার অন্যতম একটা কারণ সম্ভবত উপরের ছবিটি। উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে বনফুলের কতিপয় সুবোধ বালকেরা ধ্যানস্থ বা মেডিটেশনস্থ। বৌদ্ধ সাহিত্যে এবং বৌদ্ধ শাস্ত্রে ধ্যান বিষয়ক শতশত বই-পত্র রয়েছে। প্রখ্যাত বৌদ্ধ পন্ডিত আচার্য বুদ্ধঘোষপ্রণীত প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ বই- বিশুদ্ধিমার্গ। বলা হয়ে থাকে বিশুদ্ধিমার্গ হচ্ছে সমগ্র ত্রিপিটক বা সমগ্র বৌদ্ধ শিক্ষা ও দর্শনের সারমর্ম। বিশুদ্ধিমার্গে বুদ্ধঘোষ মূলত ভাবনা সংশ্লিষ্ট আলোচনায় করেছেন। গৌতম বুদ্ধের শিক্ষাসমূহ এবং সমগ্র ত্রিপিটক অধ্যয়ন করে আচার্য বুদ্ধঘোষ শাক্যমুনি বুদ্ধের শিক্ষাকে মূলত দুই প্রকার “ভাবনা” প্রকরণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

আচার্য বুদ্ধঘোষের মতে বুদ্ধ নির্দেশিত ভাবনা দুই প্রকার,-

  • ১. শমথ ভাবনা
  • ২. বিদর্শন ভাবনা।

শমথ ভাবনার মাধ্যমে মনচিত্তকে স্তির করা যায়। বিশুদ্ধিমার্গ অনুসারে প্রায় ৪০ প্রকার উপায়ে শমথ ভাবনা করা যায়। যেমন- বুদ্ধানুস্মৃতি ভাবনা, মরণানুস্মৃতি ভাবনা, মৈত্রী ভাবনা ইত্যাদি। বুদ্ধানুস্মৃতি ভাবনা হচ্ছে বুদ্ধ এবং বুদ্ধের গুণাবলীগুলোকে নিবিড় এবং একাগ্রচিত্তে স্মৃতিসহকারে পুন:পুন স্মরণ করতে থাকা। এভাবে মনচিত্তকে কেবল একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে বা ক্ষেত্রে স্থির করে রাখার চেষ্টা করা। আমরা জানি, প্রাণী মাত্রই আজ না হয় কাল না হয় পড়শু মরে যাবে। সেজন্য বৌদ্ধ শিক্ষায় বলা হয় যে- জগৎ অনিত্য। অর্থাৎ জগতের কোনকিছুই চিরস্থায়ী নয়। সুতরাং এ অনিত্য জগতের কোনকিছুর সাথেই আসক্তিপূর্ণ হওয়া উচিত নয়। এমনভাবে একাগ্রচিত্তে পুন:পুন নিবিষ্টমনে স্মরণ করা যে সকল “সত্ত্বা” – যেভাবে মরে যায়, আমারও সেরুপ কোন না কোনসময় মরে যেতে হবে। মৃত্যু সকল সত্ত্বার জন্যই অবধারিত। এটাই মরণানুস্মৃতি ভাবনা। মরণানুস্মৃতি ভাবনা করলে মনচিত্ত থেকে লোভ-লালসা হ্রাস পায়। মৃত্যুভয় কমে যায়। আবার মৈত্রী ভাবনায় জগতের সকল প্রাণীর মঙ্গল কামনা করা হয়। বিদর্শন ভাবনা উচ্চস্তরের ভাবনা। এর অনুশীলন লক্ষ্য হচ্ছে নিজের সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি, উচ্চতর জ্ঞান ও সম্যক ধারণা অর্জন করা। অর্থাৎ সোজা কথায় নিজের অন্দরমহলটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে গভীর অন্তর্দৃষ্টিপাতের সহিত পর্যবেক্ষণ করা। আমাদের চিত্তে উৎপন্ন যাবতীয় চিন্তাবলীকে গভীর মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করা। স্ব-ধর্ম সমূহকে বা নিজের মনচিত্তের এবং শরীরের প্রকৃত স্বরুপ কে চিহ্নিত করা ও পর্যবেক্ষণ করা, মনচিত্ত ও শরীরের নিজস্ব প্রকৃতিগত বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও স্বতস্ফূর্ত আচরণগুলো সম্বন্ধে জানা ও বোঝার চেষ্টা করা।

এভাবে একসময় গভীর একাগ্রতায় আবিষ্কার করা যায় কত ক্ষণস্থায়ী সবকিছুই। এতে জাগতিক মোহ হ্রাস পায়। জীবন ও জগত যে কতটা অসার-অনিত্য সে সম্বন্ধে স্বচ্ছ, গভীর এবং সম্যক ধারণা জন্ম নেয়। ফলত আমাদের মনচিত্ত কোনকিছু দ্বারা সহজে আর বিচলিত হয় না, আসক্ত হয় না, মোহিত হয় না। মনে একধরনের প্রশান্তিবোধ জন্মে। চিত্ত স্থির হয়, শান্ত হয়।সোজাকথায়- ভাবনার অর্থ হচ্ছে নিজেকে নিজে সম্যকভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করা। চারপাশের জগৎকে অনাসক্তরুপে দর্শন করা। সর্বোপরি- মনচিত্তকে অধিকতর একাগ্রতায় প্রতিষ্ঠিত করা। এই করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্বশান্তি কামনায় থাইল্যান্ডের বিখ্যাত ধম্মকায়া ফাউন্ডেশন বিশ্বব্যাপী অনলাইনে গণ ভাবনার আহবান জানায়। এতে রাজবনবিহারও সংশ্লিষ্ট ছিল। আমিও সেইসব সৌভাগ্যবানদের একজন ১৫/২০ দিন দৈনিক ৩০ মিনিট করে পুজ্য বনভান্তের দেহধাতু সাক্ষী রেখে বিশ্বশান্তি কামনায় “নিয়মিত ভাবনা-য়” অংশগ্রহণ করতে সুযোগ পেয়েছি।

লেখার প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে পড়েছি। শেষ করার আগে- যারা পড়ছেন এবং যারা আমাকে চিনেন তাদেরকে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া বহুআগেকার সময়ের অর্থাৎ বনফুল সময়কার একটি চমকপ্রদ সত্য ঘটনা শুনিয়ে দিই। এখন যেখানে বনফুলের অফিসকক্ষ,তার উপরের দোতলায় হাউসটিউটর ছিলেন একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি। ধরুন তার নাম দিকবলয় তঞ্চঙ্গ্যা (একটি ছদ্মনাম আরোপ করে দিলাম)। বনফুলের আমরা সবাই তাকে জানতাম নিখাদ ভদ্রলোক। তেমন একটা কথাবার্তা বলতেন না। চুপচাপ শান্তশিষ্ট প্রকৃতির। ভালো কবিতা লিখতেন। একদিন সন্ধ্যেকালীন বন্দনা-র সময়ে যখন পুরো বনফুল ক্যাম্পাসের বালক-বালিকারা প্রার্থনাহলে প্রার্থনারত সেসময় তিনি আমাকে তার কক্ষে ডেকে নিয়ে গেলেন। এরপরের দৃশ্যটি আমার জীবনের সবচেয়ে বিভৎস-বিভীষিকাময়-কুৎসিত “অ-স্মৃতি/দু:স্মৃতি”। তার কক্ষের খাটে আমাকে শুয়ে পড়তে বললেন। অনেকটা বাধ্য হলাম। এরপর একে একে তার সমস্ত কাপড়-চোপড় খুলতে লাগলেন। আমি ঠিক বুজে উঠতে পারছিলাম না কী হতে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর দেখলাম তিনি সম্পূর্ণ উলঙ্গ। তার গোপন অঙ্গটা “টিবুরুক টিবুরুক” করতেছে। আমাকে নির্দেশ দিলেন প্যান্ট-শার্ট খুলে ফেলতে। ওতটুকুন বাচ্চা ছেলে আমি, বেশ ভয় পেয়ে গেছি তখন। কি করবো বুজে উঠতে পারছি না।

তিনি নিজেই আমার পড়নের টি শার্ট-টা খুলে দিলেন। জোড় করে। আমার ভাগ্য ভালো ছিল বলেই হয়তো সেদিন আমার প্যান্ট টা আর খুলতে হয় নি। তিনি যৌনাবেগে এমনই উত্তেজিত ছিলেন যে, আমার টি শার্ট খোলামাত্রই তার গোপন অঙ্গটা আমার নাভি বরাবর আনলেন। অমনি তার গোপনঅঙ্গ থেকে হুড়হুড় করে বীর্যপাত হয়ে গেল- আমার নাভি-তলপেটজুড়ে। কী যে বিভৎস বিশ্রী এক “অ-স্মৃতি”, দু:স্মৃতি। সম্ভবত আমাকে তিনি ভুলিয়ে-ভালিয়ে বা জোড় করে পায়ুপথে (ধর্ষণ) করতে চেয়েছিলেন। আমার সৌভাগ্য যে, তার দ্রুত বীর্যপাত হওয়ায় আমি সেযাত্রায় তার ভোগ-কামনা-লালসা চিত্তের “পুরোপুরি” এবং নৃশংস শিকার হই নি। এরপরেই আমি দৌড়ে তার রুম থেকে বেরিয়ে পড়ি।

সেই ঘটনা পরবর্তী মাসখানেকের বেশি সময় পর্যন্ত আমি ঠিকঠাক ঘুমাতে পারতাম না। কারো কাছে কিছুই প্রকাশ করতে পারি নি। আমাকে যারা একেবারে ছোটবেলা থেকে চিনেন-জানেন তারা জানেন শৈশবে আমি আজকের দিনের মতন এতটা বাচাল ছিলাম না। খুব একটা কথা বলতাম না। লাজুক স্বভাবের ছিলাম। প্রায়শই আনমনা হয়ে থাকতাম। এর কারণ সম্ভবত সেই দু:সহ স্মৃতি। সেই দুঃসহ স্মৃতিটা আমি কখনোই ভুলতে পারি নি।বিষয়টা আমি কোনদিন কাউকে শেয়ার করতেও পারি নি। প্রায় ২০/২২ বছর ধরে আমি নীরবে বয়ে বেড়িয়েছি আমার জীবনের সেই দু:সহ স্মৃতি। পড়ে মোনঘর স্কুলে পড়ার সময় অর্থাৎ কৈশোরকালে, বিশেষত ক্লাস সিক্সে উঠার পর থেকে হঠাৎ দূরন্তপণায় পেয়ে বসে আমায়। ইতিমধ্যে ভুলেও গেছি সে ঘটনা। তবুও মাঝে মাঝে হুট করে আমার চিত্তে সেই বিশ্রী বীর্য তা-র কথা মনে পড়ে যেত। নাইন-টেনে পড়ার সময় আমি সহপাঠি বন্ধুদের কখনো কখনো হুটহাট করে পিঠে চাপড় মারতাম। এখনো মাঝে-মধ্যে আমি হুট করে কারণে-অকারণে চিল্লা-পাল্লা করি! আর পেটে হালকা-পাতলা এ্যালকোহল পড়লে কী যে হয়ে উঠি আমি নিজেও বুজে উঠতে পারি না।

আমার ধারণা- সেই ঘটনা-র মনস্তাত্ত্বিক আঘাত থেকেই আমি এমন করি, কেননা সেই ঘটনা আমি কখনোই কারো কাছে শেয়ার করে হালকা হতে পারি নি। আমি গ্রাজুয়েশন ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার পরে আমার জীবনের এক ঘনিষ্ঠতম মেয়েবান্ধবীকে (হুরি)কে প্রথম এই ঘটনা শেয়ার করি। আমার বিশ্বাস ছিল সে আমাকে হাল্কা করতে পারবে। কেননা তার সাথে পরিচয় হওয়ার পরে বিভিন্নসময়ে আমার নানা-ন মনস্তাত্তিক ধাক্কাগুলো সামলানোর ক্ষেত্রে সে আমাকে যেভাবে সাহস যুগিয়েছ তার জন্য আমি তার কাছে আজীবনের জন্য ঋনী। পরে অবশ্য ক্যাম্পাসে আমার কতিপয় জুম্ম ছোটভাইয়ের নিকটও ঘটনাটা শেয়ার করেছিলাম বোধহয়। আজ শেয়ার করলাম সকলের সাথে। কেননা- আমাদের অনেকের জীবনে-ই হয়তো এরকম অবর্ণনীয়-আপাত:অপ্রকাশযোগ্য নানা দু:সহ স্মৃতি-অস্মৃতি, ঘটন-অঘটন থেকে থাকে।

কেবল যৌন বিষয়ক নয়, অন্য আরো নানাবিধ আপাত:অপ্রকাশ্য ঘটনা-অঘটনা হয়তো আমাদের জীবনকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যায়, মানসিক ভাবে প্রচন্ড আঘাত করে, অস্তিরতা বাড়িয়ে দেয় বা আমাদের সামগ্রিক নিরাপত্তা বা স্বাভাবিক বিকাশের জন্য বেশ হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। নানাকারণে আমরা সেগুলো- এবংকি কাছেরজনদের কাছেও প্রকাশ করতে পারি না। এভাবেই হয়তো আমাদের যাপিত জীবনের এমনকিছু ঘটনাবলী থাকে যেগুলো আমাদের প্রচন্ড মানসিক আঘাত-উদ্বেগ-উঠকন্ঠা-নিরাপত্তাহীনতার কারণ হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু নানাবিধ দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান কারণে সেগুলো আপাত: অপ্রকাশযোগ্য।

কারো জীবনে এমন কিছু না ঘটুক, যাদের জীবনে এমন কিছু ঘটেছে তারা যেন আমার মতো সেইসব “কুট্টা”-গুলোকে ক্ষমা করার শক্তি অর্জন করতে পারে সে কামনা করি। জীবনে যা কিছুই আসুক, ঘটুক সবকিছু ইতিবাচকভাবে আত্মবিশ্বাসের সাথে মোকাবিলা করার আবশ্যকীয় এবং অব্যর্থ দ্রোণাস্ত্র হচ্ছে বই এবং ভাবনা। আমি ভাগ্যবান আমাকে উত্তমালংকার ভান্তে ধ্যান শিখিয়েছিলেন। এবংকি মাত্র ১০ মিনিটের সেই ধ্যান আমার সমগ্র জীবনে ইতিবাচক প্রভাব রাখবে বলেই আমি মনে করি। আমি দিকবলয় বাবুকে ক্ষমা করে দিয়েছি। আবার তাকে ক্ষমা করার শক্তি অর্জন করতে যেয়ে আবিষ্কার করেছি যে, আমার নিজেরই তো কত কত অপরাধ জমে গেছে কতো কারো কাছে। আমার জীবনসংশ্লিষ্ট সেরকম কেউ এই লেখা পড়ে থাকলে তারা আমায় ক্ষমা করুক। শেষান্তে নিবেদন জীবনযুদ্ধের প্রতি পদক্ষেপে ইতিবাচক থাকতে অবশ্যই নিয়মিত বই পড়ুন – ধ্যান করুন আর এইমুহুর্তে অতিঅবশ্যই করোনা বিষয়ক যাবতীয় সতর্কতা অবলম্বন করুন। বনভান্তের এক দেশনায় শুনেছি-

“অতীতের যা কিছু, ফেলে দাও অতীতে

কদাপি না দিও তারে পুনঃআবির্ভাব হতে।”

বৌদ্ধমাত্রই যে কোন কার্য বা প্রার্থনা শেষে একটি কথা অবশ্যই উচ্চারণ করেন –

সব্বে সত্তা সুখী হোন্তু

জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক

***লেখাটি ২০২০ সালের এপ্রিলে প্রথম প্রকাশিত হয় জুমজার্নালে। পাঠকদের জন্য এখানেও তুলে ধরা হল।

বাহারি বাইক নয়, জুম্ম তরুণের চোখে স্বপ্ন ছড়াক চে-র সাইকেল

0

লঞ্চযোগে মারিশ্যা থেকে ফিরছিলাম, লঞ্চ শুভলঙের কাছাকাছি যখন পৌঁছে…লঞ্চের ছাদ থেকে হা করে থাকিয়ে থাকি…লজ্জায়, ক্ষোভে ইচ্ছে করছিলো কাপ্তাই লেকের পানিতে ঝাঁপ দিয়ে মরে যাই। পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি-গেরস্ত-রাজবাড়ি ডুবিয়েছে যে জল সে জলে প্রজন্মের নির্লজ্জ লাফালাফি আর ফাঁকে প্রচন্ড বৃষ্টির দিনেও সানগ্লাস পড়ে রকমারি সেলফি-কুলফি-বালফি আর কী কী সব ফী সমেত হিন্দি মিউজিকের তালে তালে পিকনিক বোটগুলো কেমন দুলছিলো তা দেখতে দেখতে আনমনে গালি দিচ্ছিলাম লারমাকে!! এমন জাতিকে নিয়ে কেন যে অধিকারের স্বপ্ন দেখতে গেলেন, আমি বুঝি না!!

চাকমা ভাষায় “ফী” শব্দের অর্থ বিপদ/আপদ/কুফা!! যখন কোন গেরস্তের বাড়িতে অমঙ্গলসূচক কোন স্বপ্ন, অমঙ্গলসূচক কোন ঘটনা ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা থাকে তখন “ঘিলে-হোজোই” পানি দিয়ে শুদ্ধ হয়ে অথবা বাড়িতে ভিক্ষু ডেকে এনে মঙ্গলসূত্র পাঠ করে “ফী” কাটানো হয়। যেমন, ধরি কোন একটি গোজার লোক জঙ্গলে “হাট্টন্নে” যেয়ে বাঘের আক্রমণে নিহত হলেন। তখন সেই গোজার সমস্ত লোকেরা যে যেখানেই থাকুক জানাজানি করে “ফী” বা অশুভ লক্ষণ/বিপদ/আপদ/কুফা কে কাটিয়ে নেন। এরকম ঐতিহ্য এখনো চাকমা সমাজে প্রচলিত আছে। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে আমি যেবছর এসএসসি পরীক্ষা দিই সেবছর আমাদের “হুরোহুট্টে” গোজার কেউ একজন জঙ্গলে বাঘের/ভালুকের আক্রমণে নিহত হয়েছিলেন। এ ঘটনায় হুরোহুত্তে অধ্যুষিত আদামগুলোতে ঘিলে-হোজোই পানি দিয়ে “মাধা ধোনা” বা “ফী” ফেলাতে হয়েছিল।

রাঙ্গামাটি শহরটাকে বিশেষত্ব দিয়েছে যে “ফুরমোন”, আমি খেয়াল করেছি সেই ফুরমোনের পাদদেশ এবং চারপাশ ঘিরেই রয়েছে হুরোহুট্টে অধ্যুষিত আদামগুলো। যেমন- ফুরমোনের পূর্বপাশটাই রাঙাপান্ন্যে, ভেদভেদী, ঊলুছড়ি, হাদাছুড়ি, একেবারে পাদদেশে সাপছুড়ি, আমছুড়ি, শুয়োরছুড়ি, উত্তরের দিকে হুদুকছুড়ি, পশ্চিমে শেলছড়া। আরো একটু দূরে দূরে করে ছড়ানো হান্দবছড়া, দিয়োলিবাগ, শিলছড়ি, ধুট্টাঙ, তন্মিদুঙ এই আদামগুলোও হুরোহুট্টে অধ্যুষিত।যারা আমাকে কাছ থেকে চিনে, তারা ভালোই জানেন আমি কীরকম “ফাত্তো”! ছোটবেলায় মা আমাকে গালি দিতে দিতে বলতেন “দিন্নোবো ভাদঅ মাজও হুগুরও দগ তিদিক তিদিক ফাত্তো ন বেড়েলে হি ভাত্তুন অহজম ন অন্দে?” (“সারাটা দিন ভাদ্রের কুকুরের মতন তো তো না ঘুরলে কী পেটের ভাত হজম হয় না?”) এখন অবশ্য ফাত্তো বেড়াইতে বেড়াইতে নিরুদ্দেশ হলেও মা তেমন একটা আর দু:চিন্তা করেন না। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরবেই, এ আস্থাটুকু জন্মে গেছে হয়তো!!

যাই হোক, একটু “সেহর”/ সুযোগ পেলেই আমি এখনো ফাত্তো বেড়াতে ভালোবাসি। রাঙ্গামাটি জেলার সবকটি উপজেলা, বান্দরবান জেলার সবকটি উপজেলায় পা রেখেছি। সত্তা ছড়াটিকে কেন্দ্র করে বিস্তীর্ণ কাউখালী-বর্মাছড়ি অঞ্চল থেকে শুরু করে জুড়োছড়ির শলক লামনি, বরকলর থেগা উজোনি, লংগদু-বাঘাইছড়ির মেইনী-হাজলঙের গঙার, বিলেইছড়ির রেইংখং রিজেব কে কেন্দ্র করে যুগ যুগান্তরের যে সারাল্ল্যে জুম্ম আদামগুলো যখনই সুযোগ পেয়েছি তখনই ফাত্তো বেড়িয়েছি।

জমচুগ, ফুরমোন, ফালিটাঙ্যে, ঊড়িঙে মৌন, বিলেইছুড়ি মৌন কোনটাই বাদ দিচ্ছি না। নিজে তো ফাত্তো বেড়াই, অন্যদেরকেও উৎসাহিত করার চেষ্টা করি ফাত্তো বেড়ান্ন্যে নামতে। এ নিয়ে আমার নামে স্কুলবেলা থেকেই বেশ দুর্নামও আছে!! গেল ঈদের ছুটিতে ক্যাম্পাসের কয়েকটা ছোটভাইকে নিয়ে লম্বা একটা ফাত্তো বেড়ান্ন্যে দিয়ে আসলাম। প্রথম টার্গেট ছিলো ফুরমোন পাহাড়টার দক্ষিণ-পূর্ব পাশটা ঘিরে যে মৌজাগুলো রয়েছে সেই অঞ্চলগুলোকে কাভার করা। যেমন- আমছড়ি মৌজা, রঙ্যেছুড়ি মৌজা, কামিল্ল্যেছুড়ি মৌজা, ঝগড়াবিল মৌজা। রাঙ্গামাটির আসামবস্তি ব্রীজ থেকে শুরু করে কাপ্তাই রোডের শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ উত্তর-দক্ষিণমুখী ২২কিলোমিটারের যে রাস্তাটি এখন রাঙ্গামাটির এলিটদের কাছে বৈকালিক প্রমোদভ্রমণ বা বাইকবিলাসিতার হেতু তৈরী করেছে এই মৌজাগুলো সে অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত ।

পাহাড়ের বাস্তবতা এটাই! হাজার হাজার লোক শত কষ্ট-শ্রম-ঘাম এর বিনিময়ে কোনমতে জীবন নির্বাহ করছে।

ঝগড়াবিল মৌজাটাকে কেন্দ্র করেই রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর পরিকল্পনা করা হয়েছে। মাত্র বছর পাঁচেক হবে এই রাস্তাটি হয়েছে। স্থানীয় মানুষদের সাথে কথা বলে জানা যায়, রাস্তাটি হওয়ার পরে এই অঞ্চলের জীবনযাত্রায় দ্রুত কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বেশকিছু ইতিবাচক পরিবর্তনের সাথে সাথে কিছু নতুন হুমকী তৈরী হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে বটে কিন্তু স্থানীয় মানুষদের ভাগ্যে তেমন একটা পরিবর্তন আসেনি। আদামগুলোতে নেই প্রাইমারি স্কুল, বিদ্যুত পৌঁছায়নি। অথচ কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য যে বাঁধ সে বাঁধটি থেকে এই এলাকাগুলো একেবারেই হাতের নাগালের দূরত্বে অবস্থিত!! বলাবাহূল্য, এই আদামগুলোর সবগুলোই কাপ্তাই বাঁধের করাল গ্রাসে পুরান রাঙামাটির তলিয়ে যাওয়া জনপদ থেকে উঠে আসা উদ্বাস্তুদের তৈরী। ইদানিং রাঙ্গামাটি শহরের বাবুরা জমি কিনে গড়ে তুলছেন পর্যটন স্পট, ফলজ বাগান ইত্যাদি। উপর্যপুরি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে নতুন করে উচ্ছেদ হওয়ার আতঙ্ক ঘুরে-ফিরে আসছে স্থানীয় জনমনে। আর প্রত্যহ বিকেলে শহুরে তরুণরা বাইকে চড়ে এই রাস্তাটা ধরে একটা চক্কর দিয়ে আসেন।জুমঘরগুলোতে যেয়ে সেলফি মেরে ফেসবুকে আপলোড!! অনেকে নাকি জুমঘরগুলোতে যেয়ে কিছু অপকর্মও সেরে আসছেন। জানতে পারলাম, মাত্র কয়েকদিন আগেও নাকি কোন একটি গ্রুপ মদ-তদ খেয়ে রীতিমতো জুমঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে এসেছে!!

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যখন দীর্ঘ ছুটি থাকে তখন শহরে পড়তে আসা তরুণরা বাড়িতে ছুটিতে আসে। এই সময়গুলোতে এই রাস্তাটি হয়ে যায় অঘোষিত পর্যটন কেন্দ্র!! সামপ্রতিক সময়গুলোতে শুভলঙ ঝর্ণা আর এই রাস্তায় একবার ঘুরে আসলে কখনোই মনে হবে না যে, পাহাড়ে কোন জুলুম চলে…..!!! আমাদের তরুণ জুম্ম ভাই-বোনদের মনে এত ফূর্তি-রঙ্গ-ঢঙ্গ কোথা থেকে যে আসে আমি ভেবে পাই না! দুদিন পরপর সামপ্রদায়িক হামলা, সপ্তাহ না পেরোতে ধর্ষণ, মাস পেরোই কী পেরোই না ভূমি থেকে উচ্ছেদ!! তাও ক্ষণিক সুখের লাগি সেলফি-কুলফি-বালফি মার্কা আমাদের এই ভাবলেশহীন জীবনযাত্রা আমাকে বড়ই ব্যথিত করে। গম ন চেদেম!! মুইও আগঙ সে দলত!! মুইও যে তোমা মানুজ দ!!! / ভালো সাজতে যাবো না, আমিও আছি সে দলে!! আমিও যে তোমাদেরই লোক!!!

আমার কোন বাইক নেই! চালাইতেও পারি না। কোনদিন বাইক কেনার সামর্থ্য অর্জন করতে পারবো কি না জানি না!! আগ্রহ তেমন একটা নেই!! তবে বড় একটা পরিচিত সার্কেল থাকার সুবাদে কখনো কখনো সুযোগ পেলে আমিও বন্ধুদের বাইকে চেপে এই রাস্তাটা ধরে দু/এক চক্কর মেরে আসি। কিন্তু বিপত্তি বাধে যখন আসামবস্তি ব্রীজের উপর থাকি। মনে করুন, যেই একটা সেলফি তুলতে যাবো আসামবস্তি ব্রীজের উপর, ঠিক তখনি ব্রীজের নীচে হুট করে চোখ চলে যায়। দেখি আমার বড়ভাইটি সেখানে কোন একটি ট্রাকে গাছ আপলোড করছে। তখন আর আমার সেলফি তোলা হয় না!!

আসামবস্তি ব্রীজের গোড়ায় খানিক উত্তরের দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যায় ইয়া মোটা মোটা গাছের গুড়ি। সমগ্র রাঙ্গামাটি জেলা থেকেই প্রতিদিন এখানে নানান প্রজাতির গাছ আসে। সেগুলো ট্রাকে বোঝাই করে চিটাগাং বা ঢাকায় যায়। মূল্যবান ফার্নিচার থেকে শুরু করে অনেক কিছুই তৈরী হয়। আমাদের গ্রামে এই গাছের গুড়ি তোলার বড়সড় একটা শ্রমিকের দল আছে। আমার আপন বড়ভাই তাদেরই একজন। বিকেলের বেড়ানো শেষে যখন বাসায় ফিরি, সারাদিনের শ্রান্ত দেহটাকে একটুখানি স্নেহ দিতে দাদা তখন “এগপেগ” নিয়ে “সিংগবাই’ বসে থাকেন। সাথে তার ছোট্ট মেয়েটার খুনসুঁটি। আমি আমার ভাইঝির নাম রেখেছিলাম- রেগা! রেগা মানে সাঁকো!!

সেইমুহুর্তে যদি দাদাকে জিজ্ঞেস করি, আজ ইনকাম কেমন হলো?? উত্তর হবে বড়জোর ৩০০?! সেজন্যই বোধকরি ঢাকা শহরের ফার্নিচারের দোকানগুলোতে আমি আমার দাদার ফোঁটা ফোঁটা ঘাম দেখতে পাই!! এখন!!! বাইকওয়ালা আমার বন্ধু। বন্ধু মানে ভাই, পরমাত্মীয়!! তাহলে আমার “গাছতুলোন্ন্যে” বড়ভাইটি নিশ্চয়ই সেই বাইকওয়ালারও ভাই। তো, এক সহোদর ব্রীজের নীচে গাছ তোলে আরেক সহোদর ব্রীজের উপর সেলফি তোলে ব্যাপারটি কেমন কেমন না? আবার এক বাপ জুমে “মগদা দেগে সঙ দুগ গরে” / “মরি মরি কষ্ট করে” আর আরেকবাপের ছেলে বাইকে চড়ে শখের ফটোগ্রাফি করে ব্যাপারটা কেমন কেমন না?

ঠিক এভাবেই যদি আমরা চিন্তা করি, শুধু আসামবস্তি ব্রীজ কেন পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের চিত্রটাইতো এরকম। এক ভাই গাছ টানতে টানতে কষ্টে মরে যাচ্ছে-আরেকজন বনরুপা বাজারের শুকরের মাংস আর ‘রঙরাঙ’-র বোতলটা নিয়ে ফূর্তি করছে! একবোন জুম অথবা “ভুই’ ছুলতে/নিরানি দিতে ‘মগদা’ দেখতেছে আরেকবোন সেই জুমের উপর যেয়ে সেলফি মারতেছে!! আমার জুম্মো ভাইটির, আমার জুম্মো বাপটির, আমার জুম্মো বোনটির, আমার জুম্মো মা টির দু:খে সহভাগী হতে না পারি, অন্তত আমার আচরণে-আমার চলনে-আমার বলনে যেন সে অধিকতর দু:খ না পায়, অধিকতর কষ্ট না পায় সেভাবে তো অন্তত আমি থাকতে পারি!!

“ফী”-র কথা বলছিলাম। আপনার আমার জন্য যা বিনোদনের খোরাক, সেটা অন্য আরেকজনের কাছে “ফী” নয় তো? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটা আজ জুম্ম তরুণ প্রজন্মের জন্য অনেকবেশী জরুরী। এই যে, আসামবস্তি ব্রীজ, আসামবস্তি-কাপ্তাই রোড আপনার-আমার কাছে বৈকালিক বাইক ভ্রমণ বা সেলফি বিনোদনের খোরাক সেটা যে আরেক জুম্ম বাপ-ভাইয়ের কাছে “ফী” তা কি আমরা বুঝার চেষ্টা করছি? সেভাবেই সাজেক, আলুটিলা, নীলাচল, নীলগিরি, চিম্বুক, বগালেক, কেওক্রডং জুড়ে যে হরেকরকমের “ফী” জন্মেছে সেগুলো “ঘিলে-হোজোই” পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা তো এই প্রজন্মেরই দ্বায়িত্ব।

প্রজন্মের অনেকেই ঘিলে-হোজোই চিনেন না হয়তো। চিনে নিতে হবে! উপাই নেই। অন্যথা এই “ফি” গুলো আমাদের বংশ “উবোদ-যাবোদ” করে দিবে যে!ধনপুদির জন্য ঘিলেফুল পারতে যেয়েই রাধামন “কালাজামুরো” সাপের দংশনে বিষপ্রাপ্ত হয়েছিলো। রাধামনের উত্তরসুরি হবোই যদি “ফী” পরিষ্কার করার এই লড়াইয়ে মরি-বাঁচি লড়তেই হবে। চে গুয়েভারার একটা বাইক ছিলো। চে-র সাইকেল নামেই সবাই চিনে। “চে-র ডায়েরী” এবং “ডাক দিয়ে যাই” বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পড়া আমার প্রথমদিককার বইগুলোর দুটি।

এ দুটি বই পড়েই জানা যায়, ডাক্তারি পড়া শেষে কীভাবে চে ঘুরে বেড়িয়েছেন ল্যাটিন আমেরিকার পথে-প্রান্তরে। নোট নিয়েছেন অগণিত মানুষের কষ্টের দাগ আর সেই দাগ মুছার জন্য করণীয় কী হতে পারে সেগুলো। চে সাজতে যাওয়ার দরকার হয় না, পার্বত্য চট্টগ্রামের অগণিত জুম্ম বাপ-ভাই-বোনের কষ্টকে অণুধাবন করতে! অসংখ্য গণহত্যা, শতশত ধর্ষণ, পর্যটন ও উন্নয়নের নামে নিত্য বাপ-দাদার ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার গল্প তোমার-আমার চোখের সামনেই তো ঘটে যাচ্ছে প্রতিদিন। তাও কী আমরা আমাদের দৃষ্টি ওই বাহারি বাইকের উপরই রাখবো? একটা সেলফি, একটা বার্থ ডে পার্টির পিক, একটা রেস্টুরেন্টের চিকেন, একটা ব্যাচ পিকনিকের পিক নিয়েই কী ভরে রাখবো পুরো ফেসবুক টাইমলাইন? কোন অপরাধবোধ অথবা দ্বায়িত্ববোধ ছাড়াই?

লারমা আজ নেই! থাকলে নিশ্চয়ই বলতেন – বাহারি বাইক নয়; জুম্ম তরুণের চোখে স্বপ্ন ছড়াক চে-র সাইকেল।

***ফেসবুক পোস্ট হিসেবে লেখাটি লেখা হয়েছিল ২০১৪ সালের দিকে। পরে এটি জুমজার্নালে প্রকাশিত হয়। কিছুক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনা করে পাঠকদের জন্য এখানে তুলে রাখলাম

৭টি বৌদ্ধ বিহার এবং আমার দেখা রাঙ্গামাটি শহর

0

জন্ম এবং বেড়ে ওঠা রাঙ্গামাটিতে। দূরন্ত শৈশব আর উড়ন্ত কৈশোরে দেখা আমার সেই প্রিয় রাঙ্গামাটি শহর এখন কেমন আছে? এমন না যে, অনেকবছর হলো রাঙ্গামাটিতে যাই না। তাও কেন জানি মনে হয় যে, এ শহর আর আমার নেই! কেমন যেন অচেনা লাগে ইদানিং। ২০০৮ থেকে হিসেব করলে ঢাকায় আছি ৮/৯ বছরের মতন। খুব একটা বড় সময় না। বন্ধ/ছুটি এটা-ওটা সব মিলিয়ে প্রায়ই আসা-যাওয়াটা নিয়মিত। কিন্তু স্কুলবেলায় ফেলে আসা রাঙ্গামাটি আর এখনকার রাঙ্গামাটি শহরের পার্থক্যটা এখন আমার কাছে বেশ করে চোখে পড়ে। দেখতে দেখতে একেবারে চোখের সামনেই রাঙ্গামাটি শহরটার চিত্রপটে ভারী রকমের পরিবর্তন যে এসছে তা খুব সহজেই ধরতে পারি। সাম্প্রতিক সময়ে (২০১৭) রাঙ্গামাটিতে ভূমিধসে ব্যাপক প্রাণহানি এবং প্রাকৃতিক ক্ষয়-ক্ষতি অন্য সবার মতোন আমাকেও বেশ করে ভাবিয়েছে শহরটার অতীত-বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে। তাই এবার মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম বাড়িতে গেলেই পুরো শহরটাকে নিবিড় মনযোগে একচক্কর দিয়ে আসবো। গেল ঈদের ছুটিতে যেয়ে শহরটাকে একচক্কর দিয়ে এসেছি।

রাঙ্গামাটি শহরের পশ্চিমকোণায় আমাদের রাঙ্গাপানি গ্রামটি। শহরের ঐতিহ্যবাহী এলাকা। শহরের মধ্যে পড়লেও জীবনযাত্রা এবং অর্থনীতির বিচারে এটাকে এখনো গ্রাম বলেই ধরে নিতে হয়। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এখনো কৃষি অর্থনীতির উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। ব্যবসা-বাণিজ্য কিছু সম্প্রসারিত হলেও তেমন বিকশিত হতে পারেনি। খুব কম সংখ্যক চাকুরীজীবী পাওয়া যাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয় এবং মোনঘর শিশু সদন-এর অবস্থান গ্রামটির উত্তর ভাগটায়। তারও উত্তরে ভেদভেদী। পৌর এলাকার আওতায় চলে আসলেও এই এলাকার আদি বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা এখনো গ্রামীণ অর্থনীতির উপরে নির্ভরশীল। যদিও শহর সম্প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে এ দুটো গ্রামের চিত্রপটও খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। রাঙ্গাপানির দক্ষিণে আসামবস্তি এলাকা।

রাঙ্গামাটি শহরের প্রধান সড়কটিকে একটি সাপের মতন কল্পনা করা যায় যা পুরো শহরটিকে চক্কর মেরেছে। এর একপ্রান্ত যদি ভেদভেদী ধরি তবে ভেদভেদী – রাঙ্গাপানি – আসামবস্তি বেয়ে সড়কটি চলে গেছে ভেদভেদী – রাঙ্গাপানি – আসামবস্তি – স্বর্ণটিলা – তবলছড়ি – রিজার্ভ বাজার – কাঠালতলী – বনরুপা – পাবলিক হেলথ – কালিন্দীপুর – রাজবাড়ি – দেবাশীষ নগর – কল্যাণপুর – কলেজগেইট – ভেদভেদী এভাবে। পুরো রাঙ্গামাটি শহরটাকে ঘিরে থাকা বৌদ্ধবিহারগুলি একবার দর্শন করে আসবো এমনটা চিন্তা করে প্রথমে গেলাম আসামবস্তি। ছোটবেলা থেকেই প্রতিবেশী এই এলাকাটির প্রতি দারুণ ভালোলাগা কাজ করে। আমাদের গ্রামে কোনও নাপিতের দোকান ছিল না। বাবা প্রতিমাসে একবার করে বাড়ি আসতেন তার কর্মস্থল বিলাইছড়ি থেকে। প্রতি দু-এক মাস অন্তর চুল লম্বা হয়ে আসলে বাবার সাথে আসামবস্তি যেতাম চুল ছাঁটাই করার জন্য। তখন আসামবস্তি বাজারটি ছিল আসামবস্তি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির পাশে। বাজারটি মোটামুটি জমজমাট ছিলো। এখন আসামবিস্ত-কাপ্তাই রোড হওয়ার পর থেকে আসমবস্তিতে নতুন দুইটি বড় ব্রীজ আসামবস্তি এলাকাটাকে অঘোষিত ট্যুরিস্ট এলাকা বানিয়েছে।

রাঙ্গামাটির স্বনামধন্য রাজবন বিহার। ছবি: লেখক

যাই হোক পুরো রাঙ্গামাটি শহরটাকে একটা চক্কর দিলে ৭টি বৌদ্ধ বিহার পাওয়ায় যায়। আমি আর আমার এক বন্ধু মিলে আমরা প্রথমে গেলাম আসামবস্তি ধর্মচক্র বৌদ্ধ বিহারে। বিহারটির গেটে নামফলক দেখলাম না। তাই প্রতিষ্ঠা সাল কতো তা টুকে নিতে পারলাম না। ভিতরে প্রবেশ করতেই অদ্ভূত রকমের এক নিরবতা আর শান্তি খুঁজে পেলাম। বিহারটির অধ্যক্ষকে আগে থেকে চিনতাম। বিহারটি ১৯৭১/৭২ সালের দিকে প্রতিষ্ঠা করা হয় বলে জানালেন বিহারটির বর্তমান অধ্যক্ষ। আগে বিহারটি ছিল মাটির (গুদোম ঘর) ঘরের। এখন দোতলা বিল্ডিং হয়েছে। উপরে বুদ্ধাসন এবং বন্দনার স্থান। নীচতলায় ভিক্ষু শ্রমণদের আবাসিক কক্ষ। সাথেই লাগোয়া করে রয়েছে একটি অস্থায়ী পাঠশালা, যেখানে আশেপাশের বা কখনো কখনো দূর-দূরান্ত থেকে কচি কচি অনাথ ও অসহায় ছেলে-মেয়েরা বিনামূল্যে পড়তে আসে। স্কুলের পাঠ্য ছাড়াও পড়ানো হয় মারমা ভাষা ও সংস্কৃতি। কলেজ পড়ুয়া কিছু ছেলে আছে যারা এটাকে দেখাশোনা করে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মারমা পাড়ায় ঘুরতে যেয়ে আমি খেয়াল করেছি মারমাদের মধ্যে বিহারকেন্দ্রিক মাতৃভাষা শিক্ষার একটি ব্যবস্থা আছে। মারমাদের বিহারকেন্দ্রিক এই শিক্ষাব্যবস্থাটা আমাকে খুবই টানে।

পাহাড়ের প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারকে কেন্দ্র করে এভাবে প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষাসহ অন্যান্য অনানুষ্ঠানিক সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ গঠনের শিক্ষাগুলো দেওয়া যেতে পারে। কাপ্তাইয়ে অবস্থিত চীৎমরম বৌদ্ধ বিহারে আমার প্রায়শই যাওয়া হয়। সেখানেও দেখেছি বিহারে উপাসক-উপাসিকাদের প্রদত্ত দান-দক্ষিণার একটা নির্দিষ্ট অংশ দিয়ে অনাথ শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার ব্যয়ভার চালানো হয়। চীৎমরমে প্রায় ৬০ জনের মত শিক্ষার্থী থাকে যারা থাকা-খাওয়া বিনামূল্যে পায় এবং পাশের চীৎমরম সরকারি বিদ্যালয়, কাপ্তাই কিংবা কর্ণফুলী কলেজে পড়াশুনা করে। ব্যাপারটি সত্যিই দারুণ। রাঙ্গামাটির রাজবন বিহারে যে পরিমাণ দান পড়ে তার একটা ছোট্ট অংশ দিয়ে কমসে কম ৩০০ শিক্ষার্থীর পড়াশুনার ব্যয়ভার চালানোে যেতে পারে বলে আমার মনে হয়। আসামবস্তি ধর্মচক্র বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ মহোদয়ের সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করেছিলাম। কথাপ্রসঙ্গে এলাকাটার নাম কেন “আসামবস্তি” হলো তাও চলে এল।তিনি বললেন যে, একসময় এই এলাকাটায় কোন বাঙালি বসতি ছিল না। এলাকাটায় একটা স্ব-মিল আছে। সেখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে কাঠ চেরার জন্য গাছের গুড়ি আসতো, এখনো আসে। মূলত এই স্ব-মিল এবং বাজারটিকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে কিছু আসাম পরিবার আর মারমা পরিবার বসতি গড়ে তুলেছিল এখানে। একসময় বসতি বাড়তে থাকে। এখন মারমা, আসাম আর কিছু রাখাইন পরিবারের সাথে সাথে অনেক বাঙালি বসতিও হয়েছে এখানে। আছে কিছু চাকমা এবং বাঙালি বড়ুয়া পরিবারও। আসামরা পার্বত্য চট্টগ্রামে ঠিক কবে থেকে বসতি করা শুরু করেছে সঠিক জানি না।

পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের দলীয় সংগীতে একটা লাইন আছে এরকম –

“পাংখো-খুমী-লুসাই-মুরং-মারমা
তঞ্চঙ্গ্যা-বম-খেয়াং-চাক-ত্রিপুরা-চাকমা”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নবীনবরণ অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি তুলে ধরছেন আদিবাসী শিক্ষার্থীরা। ছবি কৃতজ্ঞতা- পিসিপি আর্কাইভস

পার্বত্য চট্টগ্রামভিত্তিক পুরনো লিটলম্যাগ বা বিভিন্ন প্রকাশনাতেও পার্বত্য চট্টগ্রামে উপরের এই ১১টি জাতির কথার উল্লেখ দেখা যায়। কিন্তু পাহাড়ে বর্তমানে এই ১১টি জাতি ছাড়াও কিছু সাঁওতাল বা সান্তাল, আসাম এবং গুর্খা বসতির সন্ধান পাওয়া যায়। প্রবীণ অনেকের সাথে বিভিন্ন সময়ে গল্পচ্ছলে জেনেছি যে মূলত পাহাড়ে যখন নতুন নতুন রাস্তাঘাট হচ্ছিল তখন শ্রমিক হিসেবেই আসাম, সাওতাল বা গুর্খারা পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছিল।

আমার মনে হয় যে তাদের জীবন-জীবিকার ধরণে তাদের ঠিক পাহাড়ি বা জুমিয়া বলে বলা যাবে না। যাই হোক আসামবস্তি থেকে আমরা চলে গেলাম তবলছড়ি। বিভিন্ন কারণে এই তবলছড়ি বাজারটিও আমার কাছে খুবই স্মৃতিবহ। আসামবস্তি থেকে তবলছড়ি যাওয়ার পথেই পড়ে রাঙ্গামাটি সরকারি বালিকা বিদ্যালয়। এই গার্লস স্কুলের পাশ দিয়ে মা’র সাথে কতবার যে তবলছড়ি বাজার গেছি!

একসময় আমাদের গ্রাম রাঙ্গাপানি থেকে তবলছড়ি পর্যন্ত সাম্পান চলতো। মূলত বাজার দিনে। তবলছড়ি বাজারে মা’র একটা পরিচিত স্বর্ণকারের দোকান ছিল।

আমাদের গ্রামের মহিলাদের অনেকেই বেইন (কোমরতাঁত) বুনে সংসার সামলাতেন। এমন অনেক দেখেছি যে, বেইন বুনার জন্য সুতা কেনার টাকা নেই। এই স্বর্ণকারের কাছ থেকে অনেকে কানফুল বা নাকফুল বন্ধক রেখে সুতা কাটার টাকা নিয়ে আসতেন। দিদির বা দাদার পরীক্ষা ফি বা স্কুল ফি’র জন্য মাকেও দেখেছি বিভিন্ন সময়ে এই স্বর্ণকারের নিকট বিভিন্ন অলংকার, যেমন – সোনার চেইন, নাকফুল, কানফুল, বালা প্রভৃতি বন্ধক দিয়ে টাকা নিয়ে আসতে।

যাই হোক, তবলছড়ি বাজার পার হয়ে যেতে না যেতেই পথে পড়বে শহরের বহু পুরনো বৌদ্ধ বিহার “আনন্দ বিহার”। নামফলকে উল্লেখ আছে আনন্দ বিহার ১৯৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত। মোনঘর শিশু সদনের অন্যতম পথিকৃৎ শ্রীমৎ প্রজ্ঞানন্দ মহাস্থবির রাঙ্গামাটি থাকলে এই বিহারে থাকতেন বলে মোনঘরের ছেলেদের সাথে এই বিহারের সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ। একসময় মোনঘর থেকে পাশ করা কলেজপড়ুয়া ছেলেদের অনেকেই এই বিহারে অবস্থান করে রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজে অধ্যয়ন করতেন। মোনঘরের সাবেক সিনিয়র বরেন্দ্রলাল ত্রিপুরার লেখা “সোনালী উষা, ধূসর গোধূলী” নামক মফস্বলী রোমান্টিক উপন্যাসটিতে রাঙ্গামাটির আনন্দ বিহার এলাকা, ডিসি বাংলো এলাকার সেসময়কার চিত্রগুলো পাওয়া যায়।

একটা সময় ছিল যখন রাঙ্গামাটির উঠতি তরুণ-তরুণীদের নিরাপদ প্রেমের ঠিকানা ছিল ডিসি বাংলো এলাকা বা তার আশেপাশের এলাকাগুলোে যেটাকে ছোটখাটো সমুদ্রপার বলে মনে হয়। এখন ডিসি বাংলো এলাকাটা অত্যধিক বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা হয়ে গেছে। আশেপাশে কোন পাহাড়ি এলাকা নেই। তাই সাধারণত পাহাড়িরা এখন এইসব এলাকা একটু এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে বলেই মনে হয়। এখনকার পাহাড়ি প্রেমিক -প্রেমিকা বা উঠতি বয়সীদের দেখা যায় আসামবস্তি ব্রীজ বা আসামবস্তি-কাপ্তাই রোডের ঐদিকে। কে জানে অনাগত দিনে আগামী দিনের পাহাড়ি প্রেমিক-প্রেমিকা বা উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েরা এইপথেও নিরাপদে ঘুরতে সাহস করবে কিনা! যাই হোক, আনন্দ বিহার দর্শন শেষে আমি আর শুভ্র রওনা দিলাম বনরুপামুখী। আমাদের পরের গন্তব্য শহরের একেবারেই প্রাণকেন্দ্র বনরুপার পাশেই কাঠালতলী এলাকায় অবস্থিত মৈত্রী বিহার।

কাঠালতলীতে অবস্থিত মৈত্রী বিহার এর প্রতিষ্ঠার সাল ১৯৬৭। আহামরি তেমন কিছু পেলাম না নোট নেওয়ার জন্য। মনে মনে শুধু ভাবছিলাম ১৯৬৭-র দিকে এই বিহারের আশেপাশের এলাকাগুলো কেমন ছিল??? তবলছড়ি থেকে বনরুপা যাওয়ার পথে একপাশে পাশ কাটিয়ে যেতে হয় রিজার্ভ বাজার এলাকাটিকে।রিজার্ভ বাজার এলাকাটি কাপ্তাই বাঁধের পানিতে তলিয়ে যাওয়া পুরাতন রাঙ্গামাটি শহরের বিলুপ্তির পর থেকেই পার্বত্যাঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র।রিজার্ভ বাজার লঞ্চঘাট হয়েই বিভিন্ন উপজেলার সাথে নৌভিত্তিক যোগাযোগ রক্ষা করে রাঙ্গামাটি। রিজার্ভ বাজারের পাশেই শহীদ আব্দুল আলী একাডেমী মাঠ। বাবার মুখে শুনেছি এই মাঠে নাকি স্বাধীনতার পরপরই একটি বড় জনসভা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই জনসভাতেই নাকি তিনি পাহাড়িদের পরামর্শ দিয়েছিলেন বাঙালি হয়ে যেতে।

পাহাড়িরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন সভাস্থলেই এবং সভাস্থল ত্যাগ করেছিলেন। জুম্ম জাতীয় চেতনার অগ্রদূত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা যেমন গণপরিষদ অধিবেশন চলাকালীন জাতীয় সংসদে দৃপ্ত কন্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন “একজন চাকমা কখনো একজন বাঙালি হয়ে যেতে পারেন না।” মা’র সাথে এই রিজার্ভ বাজারে যাওয়ার শৈশব স্মৃতিও আমার কাছে খুব আনন্দদায়ক। রিজার্ভ বাজার থেকেই মা বেইন বুনার সুতা কিনে নিয়ে আসতেন। মা’র পরিচিত অনেক সুতা দোকানি ছিলেন রিজার্ভ বাজারে। দেখতে দেখতে একেবারে চোখের সামনেই রিজার্ভ বাজার থেকে রাঙামাটির প্রধান বাজার হয়ে গেল বনরুপা। সেখানেও একটি কাহিনী আছে। একসময় রাঙামাটির প্রধান বাজার ছিল রিজার্ভ বাজার। এখন বনরুপা। রিজার্ভ বাজার এলাকাটা বাঙালি অধ্যুষিত। কোন একসময় সেখানে বাজার দিনে পাহাড়ি-বাঙালি সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়। তারপর থেকে পাহাড়িরা রিজার্ভ বাজার এড়িয়ে চলে এবং বনরুপায় চলে আসে মূল বাজারটি।

মৈত্রী বিহার দর্শন শেষ হলো। এরপরে আমরা গেলাম চাকমা রাজবাড়ি ও রাজ কার্যালয়ের পাশেই অবস্থিত চাকমা রাজবিহারে। রাজবিহার এর প্রতিষ্ঠাকাল হিসেবে উল্লেখ আছে ১৮৭৩। রাজবিহারে যাওয়ার পথে প্রথমেই পড়বে চাকমা সার্কেল চীফের কার্যালয়। কার্যালয়ের একেবারেই সম্মুখে বেশ কয়েকটি বড় বড় “আজার বিজি গাজ” দেখলাম। থুম্বোক খারা’র কথা মনে পড়ে গেল। আমি “আগাজা বিজি গুদেয়ে” পছন্দ করি। দেখলাম রাজবাড়ির ঘাটে বেশ বড়সড় একটি “আগাজা বিজি গাজ”, আছে একটি বয়সী ফুলসুমোরি গাজ’ও। ফুলসুমোরী গাছ দেখলেই আমার আবেগ উপচে পড়ে। কেনজানি এই বৃক্ষটিকে খুব খুব এবং খুব করে ভালোবাসি। আমার খুব শখ কোন এক পূর্ণিমাতে কোন এক জুম্মবীকে কোন এক ফুলসুমোরি গাছের নিরিবিলিতে আমার জীংহানির সবগুলো বলা অথবা না বলা কথাগুলো শুনিয়ে দেবো। রাজবিহার এলাকাটা চমৎকার নিরিবিলি পরিবেশ। আশেপাশে নির্মাণাধীন একটি চৈত্য দেখলাম। রাজবিহারে আমার পরিচিত এক ভিক্ষু আছেন। উনার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে আসলাম।

রাজবিহারে কিছু সময় কাটিয়ে আমরা পাশ্ববর্তী রাজবনবিহারে চলে এলাম। রাজবিহারের বিপরীতেই রাজবন বিহার এর খেয়াঙ ঘাট, যেখানে প্রতি বছর কঠিন চীবরদানের সময় বেইন বোনা হয়। রাজবনবিহার এসে এর প্রতিষ্ঠাকাল জানলাম ১৯৭৪ সাল। রাজবনবিহার নিয়ে স্মৃতি হাতরাতে গেলে অনেককিছুই চলে আসে। মুচকি হাসলাম মনে মনে এই ভেবে যে, একটা সময় অামি রাঙ্গামাটির রাজবনবিহারের কঠিন চীবর দানোৎসবে যেতাম কেবল ‘ডাব্য’ খেলার লোভে!

বনবিহার দেখা হয়ে গেল। এরপরে পার্টনার (আমার বন্ধু শুভ্র) এর “লদক-দদক” স্টাইলে চালানো বাইকে চড়ে আমরা চলে এলাম ভেদভেদীতে অবস্থিত সংঘারাম বৌদ্ধ বিহারে। বাতি জালালাম। কোন বিহারে যেয়ে বাতি জালালে আমার ছোটবেলায় শোনা একটি গানের কথা মনে পড়ে-

“আমরা নাকি বৌদ্ধ জাতি-
সবাই বলে সরল মতি,
অহিংসার নামটি ধরে
জালাই শুধু মোমের বাতি।”

যাই হোক সংঘারাম বৌদ্ধ বিহার এর বিহারাধ্যক্ষ শ্রীমৎ শ্রদ্ধালংকার মহাস্থবির। তিনি মোনঘর শিশু সদনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও বটে এবং বলা চলে মূলত তাঁর প্রত্যক্ষ পরিচর্যাতেই মোনঘর বড় হয়ে উঠেছিল। তিনি একাধারে চাকমা ভাষা ও বর্ণমালা বিশেষজ্ঞও বটে। সংঘারাম বিহারের প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৮৩।

ভেদভেদী সংঘারাম বিহার দর্শন শেষে আমরা রাঙ্গাপানি মিলনবিহার চলে এলাম। এর প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৭৪ সালে। মিলন বিহার যখন প্রতিষ্ঠা করা হয় তখন ভেদভেদীতে সংঘারাম বিহার হয়নি। ভেদভেদী এবং রাঙ্গাপানি এ দুই গ্রামের লোকজন স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে গড়েছিল বিহারটি। দুই গ্রামের লোকজনের মিলন, এই ধারণা থেকেই বিহারটির নাম হয় মিলন বিহার। এই মিলন বিহারকে কেন্দ্র করেই মোনঘর শিশু সদনটি প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল বলে জানি। আমাদের গ্রামটির একেবারে প্রবেশপথে অবস্থিত এই বিহারটির সাথে আমার কৈশোরিক বেশ স্মৃতি জমে আছে। এই বিহারে আমি প্রায় দুবছরের মতন শ্রামণ ছিলাম। আমাদের গ্রামে বনভান্তে দু’বার এসছিলেন বলে মনে আছে। ছোটবেলায় আমরা একটি গান গেতাম যা এরকম –

“আমা মন আন দোল, বনভান্তে দোল
সংসমারে আগি আমি নেই হনও জোল”

সাধকপ্রবর বনভান্তে। ছবি: রাজবন বিহার থেকে সংগৃহীত

গানটি সম্ভবত রণজিৎ দেওয়ানের লেখা। বনভান্তে রাঙ্গাপানি গ্রামবাসীকে ভালোবাসতেন। প্রতিবছর রাঙ্গাপানি গ্রামবাসী রাজবন বিহারের কঠিন চীবরদানের সময় একটি বাঁশের তৈরী হাতি বানিয়ে দান করতো। বনভান্তে নাকি আশীর্বাদ করতেন রাঙ্গাপানি গ্রামবাসী যেন একতাবদ্ধ এবং বলশালী হয়। বর্তমানে রাঙ্গামাটি শহরের মধ্যে নির্ভেজাল জুম্ম অধ্যুষিত এলাকা বলতে এই রাঙ্গাপানি গ্রামটিই কেবল আছে।

পুরো রাঙ্গামাটি শহর ঘুরে আমি ৭টি বৌদ্ধ বিহার পেয়েছি। অথচ কেবল রাঙ্গাপানি গ্রামের চারপাশেই হিসেব করে দেখেছি যে ৭টির মতোন মসজিদ হয়ে গেছে। অর্থাৎ খুব দ্রুতই রাঙ্গামাটির জনমিতি বদলে গেছে। আগামী ১০/১৫ বছরে তা আরো ব্যাপকভাবে বদলে যাবে বলে ধরে নেওয়া যায়।

আমার ফেলে আসা শৈশবের রাঙ্গামাটির চেহারা আর এখনকার রাঙ্গামাটির চেহারাতে অনেক ফারাক, অনেক অমিল। সেটা স্বাভাবিকই লাগতো যদি তার পরিবর্তনটা স্বাভাবিকভাবে হতো। কিন্তু আমরা দেখছি পরিস্থিতি ভিন্ন। হুট করেই বদলে যাচ্ছে রাঙ্গামাটির চেহারা, তার জনমিতি এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য। শহরটা সম্প্রসারিত হচ্ছে। ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে সেটেলার বসতি। জুম্মরা প্রায় সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। আগামীতে নিশ্চিহ্ন হওয়ার মতো উপক্রম হবে না তো??? রাঙ্গামাটির এই ৭টি বৌদ্ধ বিহারের অস্তিত্বও কি থাকবে???

** *লেখাটি ২০১৮ সালে প্রথম জুমজার্নাল এ প্রকাশিত হয়। আমাকে যারা পাঠ করতে চান তাদের জন্য লেখাটি তুলে রাখলাম।

পথে প্রান্তরে: পার্বত্য চট্টগ্রামের তঞ্চঙ্গা জনপদ

0

তঞ্চঙ্গ্যা মহিলা বা রমণীদের মুখে কেউ কি কখনো “ভায়ো” ডাকটি শুনেছেন? সম্বোধনের ক্ষেত্রে এমন মধু ডাক খুবই বিরল। যে “টিউনে” এই ডাকটি তঞ্চঙ্গ্যা রমণী বা মহিলারা দেয় সেই “টিউন”-তার মাঝে কি রহস্যময়ী মায়া যে লুকিয়ে থাকে তা যারা শুনেন নি তাদের বোঝানো সম্ভব নয়! সাধারণত নিজের আপন অথবা নিকটআত্মীয় ভ্রাতাকে অথবা পড়শি কোন যুবককে কিংবা কোন স্বল্প পরিচিত অথবা একেবারেই অপরিচিত আগন্তুক বা মেহমানকেও তঞ্চঙ্গ্যা রমণীরা “ভায়ো” বলে সম্বোধন করে থাকে, এরকমটা খেয়াল করেছি।

ছোটবেলা থেকেই খুব “ফাত্তো” আমি! অনেকে বলে যে, কেবল চেহারাটা নয়, আমার “হাচ্চোত” টা পুরোপুরি আমার বাবার মতোন। আমার বাবা যৌবনে খুবই “ফাত্তো” ছিলেন বোধহয়! অবশ্য ছোটবেলা থেকে লোকমুখে এমনটাই শুনে শুনে বড় হয়েছি যে, “ত আবেও গাবুরও অক্তত নাঙ গোজ্জে দ”/ “তোমার বাবাও যৌবনে নাম কামিয়েছিলো।” পাহাড়ের ঝড়ো আন্দোলনের শুরুর দিকে “শান্তিবাহিনীর” সদস্য হওয়া ছাড়া জীবনে নাম কামানোর মত কোনকিছু তিনি করতে পেরেছেন এরকম কিছুই আমি দেখি নি। কোনরকমে “ব-কলম” ডিগ্রীটা ছেড়েছেন! তবে বাবার অনেককিছুই আমার চেতনায় আজো রঙ মেখে দেয়, সে আমি বড় হয়ে খেয়াল করেছি। বাবা পাহাড়ের চিরাচরিত “চুচ্চেঙে খা” -টা ছেড়েছেন বহু বছর হলো।

শুনেছি যে, যখন “পানীয়” নেওয়ার বয়স ছিলো, সেসময় নাকি বাবার আওয়াজটা শুনলে গ্রামের লোকজন “উইয়ো নারেশ্যে এজের” বলে “চেরাগ” নিভিয়ে দিতো! বাবার সেই সোনালী যৌবনের যুগ এখন আর নেই। পেনশনে যাবো, পেনশনে যাবো করতে করতে তিনি আমাকে বুজিয়ে দিতে চান- “তোমার যুগটা শুরু হলো”! কেবল বাবা নয়, পাহাড়ের অনাদিকালের পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকার হিসেবে পূর্বপুরুষের ভিটে-মাটির প্রতি যে দ্বায় ও দেনা জমে গেছে তা শোধবোধ করার সময় যে আমাদের কালের তরুণদের সামনে চলে এসছে তা আমি বেশ করে বুজি এখন! তাই রণজিৎ দেওয়ানের “চব্বিশ বজরর হোচপানা”-র মতোই একবুক হোচপানা নিয়ে আমি “হিল চাদিগাঙ” – এর উত্তর-দক্ষিণ/পূর্ব-পশ্চিম যখন সুযোগ মেলে কোন প্রান্তকেই বাদ না রেখে “ফাত্তো” বেড়াতে নামি!

কোন একটা বড় “মোন” এ উঠার ক্লান্তি ও ধকল কাটিয়ে উঠতে “ফাগুন-চোত মাস্যে মিধে আভা” -টা যদি শরীরটাকে জুড়িয়ে দিয়ে যায় আর স্বস্তির একটা ঘুম ভেঙে যখন দেখতে পান রাত কেটে গেছে আর কবি ফেলাজেয়া চাকমা-র “হিজিঙৎ পুগোবেল” টা উঁকি দিতে শুরু করেছে আর আপনি কবি শিশির চাকমার “হুয়োর বর্গী” -শরীরে জড়িয়ে আনমনেই গাইতে থাকেন রণজিৎ দেওয়ানের -“ও মা জু জানাঙ তরে, তর বুগোত জাগা দোজ মরে” তখন অদ্ভূত এক শিহরণে পুরো শরীরটা কাটা দিয়ে যায়!

ফাগুন এর আগমনীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের নির্মল প্রকৃতি (ছবি: নান্টু চাকমা)

এরকম অসংখ্য সুখস্মৃতি আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমা আছে। শুনেছি প্রয়াত লারমা শিক্ষাজীবন শেষে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম চষে বেড়িয়েছিলেন এবং এই সব ঘুরে বেড়ানো অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি স্লোগান তুলেছিলেন – “শিক্ষা নাও-গ্রামে ফিরে চলো”।

যদিও এখনও গ্রামে ফিরে যাওয়ার মতোন বারুদ শহর থেকে সংগ্রহ করতে পারি নি তথাপিও পাহাড়ের অসংখ্য “সারাল্ল্যে আদাম” ঘুরে বেড়ানোর যে অভিজ্ঞতা সে ঝুলিতে পাহাড়ের তঞ্চঙ্গ্যা ভাই-বোনদের বেশকিছু এলাকাও ইতিমধ্যে কাভার হয়েছে।

বিভিন্ন জায়গাই ঘুরতে ঘুরতেই তঞ্চঙ্গ্যা আদাম, তঞ্চঙ্গ্যা সংস্কৃতি, ভাষা, সামাজিক রীতি-নীতি প্রভৃতি বেখেয়ালেই খেয়াল করে ফেলেছি! তাই কিছু পর্যবেক্ষণ চিহ্নিত করতে পেরেছি।

এই যেমন ধরুন- তঞ্চঙ্গ্যা রমণীদের এই “ভায়ো” ডাকটি! কী মধুর গো! আবার খেয়াল করেছি যে, সাধারণত তঞ্চঙ্গ্যা ছেলেরা বিয়ের ক্ষেত্রে নিজের থেকে বয়সে সামান্য বড়দেরকে বেছে নেয়। অর্থাৎ বরের চেয়ে কনেরা সাধারণত বয়সে একটু বড় হন।

খেয়াল করেছি যে, তঞ্চঙ্গ্যা ছেলেরা একটু রহস্যময়ী টাইপের হন। ইংরেজীতে “আনপ্রেডিক্টেবল” বলা যেতে পারে। অন্তত মোনঘরে পড়ার সুবাদে এবং পরবর্তীতে ক্যাম্পাসে পরিচিত হওয়া তঞ্চঙ্গ্যা ভাইদের দেখে আমার এরকমটাই মনে হয়েছে। শান্তিবাহিনীর দুইযুগেরও অধিক সংগ্রামে তঞ্চঙ্গ্যাদের ভূমিকা পজিটিভ নাকি নেগেটিভ সেটা নাকি শান্তিবাহিনীরা কখনোই বুজে উঠতে পারেন নি, এরকমটা আমি এক সিনিয়র বড়ভাইয়ের মুখ থেকে জেনেছি। অর্থাৎ পাহাড়ের চলমান সংগ্রামটাকে তারা কীভাবে মূল্যায়ন করছে তা বোঝা নাকি বড় দ্বায়। সমর্থন করছে কি করছে না তা বোঝা যায় না, মুখফুটে বিরোধিতাও তারা কখনো করেনি, আবার অংশগ্রহণ যে ছিলোনা তাও নয় এরকম একটি অবস্থা (এগুলো সাধারণ অর্থে পর্যবেক্ষণ, কোন সিদ্ধান্ত বা মতামত নয়)!

কোন তঞ্চঙ্গ্যা ছেলের মনে কী খেলা করতেছে সেটা ঠাহর করতে পারাও বোধহয় বেশ মুশকিল। তারা সাধারণত চুপচাপ প্রকৃতির হয়, অনেকেই ধার্মিক হয়.পরিশ্রমী হয়! কম কথা বলে। মনের গভীরেই লুকিয়ে থাকতে ভালোবাসে তঞ্চঙ্গ্যা ভাই ও বোনেরা। বাইরে থেকে কিছু বুঝতে দেয় না। এবারে শেষবার রাঙ্গামাটি যেয়ে একটি “মোন”- এ তঞ্চঙ্গ্যা পাড়া ঘুরে এসছিলাম! যে মোনটাই এবার উঠেছি, সেখানে ১৭টি পরিবারের বাস। ঘাগড়ার পূর্বপাশে এবং রাঙ্গামাটি সদরের পশ্চিম পার্শে পড়েছে এই এলাকাটি।

যারা বুজতে পারছেন না তাদের সহজ করে বুঝিয়ে দিই রাঙ্গামাটি-কাপ্তাই রোডে যখন ঘুরতে যান পশ্চিম দিকে তাকালে যে পাহাড়গুলো দেখতে পান আমি সে এলাকাগুলোর কথাই বলছি। রইন্যেছুড়ি মোন, কোজোইছুড়ি মোন, বল্টুগাছ মোন প্রভৃতি নিয়ে এ অঞ্চলটা। এই পাহাড় শ্রেণীটার উপরে উঠতে পারলে পূর্ব পাশে স্পষ্ট করে কাপ্তাইলেকের পানি, দক্ষিণে কাপ্তাই বাঁধ ও নেভীক্যাম্প অঞ্চল, পশ্চিমে ঘাগড়া-রইস্যাবিল এবং রাউজান-রানীরহাট-রাঙ্গুনিয়ার ইটভাটাগুলো ও রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম রাস্তার কিছু কিছু স্পষ্ট দেখা যায়।

এবেলা বেড়ানোর সময়টাতে নান্টু দা একটি দারুণ কথা বলেছে, – “চাকমাউন মত্তনদে শহর তোগেই তোগেই, আ তোনদঙ্যেউন মুড়োউগুরে হি দোলেই চাষবাজ গুরি হাদন্দি”! অর্থাৎ চাকমারা মরতেছে শহর খুঁজতে খুঁজতে, আর তঞ্চঙ্গ্যারা পাহাড়ের চূড়োয় আপন সাংস্কৃতিক সত্ত্বা ও চাষবাস নিয়ে কত ভালো করেই না বেঁচে আছে। কথাটি একটি সাধারণ পর্যবেক্ষণ। তবে আমি তা ধর্তব্যে নিয়েছি। কেননা আমিও খেয়াল করেছি যে, তঞ্চঙ্গ্যারা অধিকাংশই শিক্ষা-দীক্ষা নিয়েছে সত্য কিন্তু তারা “পাহাড়কে” ভুলে যেতে চায় নি। আমার ধারণা, পাহাড়ে চাষবাসের দিক থেকে পাহাড়ের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে তঞ্চঙ্গ্যারা।

তঞ্চঙ্গ্যা লোকালয়ে সাঁকো পার হচ্ছেন দুজন তঞ্চঙ্গ্যা রমনী। ছবি: লেখক

জুমচাষ থেকে শুরু করে হালচাষ, ক্ষেত-খামার, ফলজ বাগান, আদা-হলুদ, “মাইস্যবায়োর” বা বিলেতি ধনেপাতা প্রভৃতি অর্থকরী ফসল উৎপাদনেও তারা দৃষ্টান্ত রাখছে। সাধারণত “মোন” এ বসবাস করলেও তাদের “ঘর-দোর” বা বসত-বাড়ি গুলো তুলনামূলক অবস্থাসম্পন্ন মনে হয়েছে আমার কাছে। অধিকাংশ তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামে বিদ্যুত না থাকলেও “সোলার” ব্যবহার বেশ করে চোখে পড়েছে।

যদি একটি সরলরেখা টানি, রাঙ্গামাটির “ফুরমোন” পাহাড় থেকে সোজা উত্তরে গেলে কুদুকছড়ি- পাড় হয়ে, কেরেতকাবা মোন হয়ে ফুরমোন পাহাড় শ্রেনীটা উত্তরে খাগড়াছড়ির “আলুটিলা-এহদোচিড়ে মোনকেই” অণুস্মরণ করবে। আর “ফুরমোন”-র দক্ষিণ দিকটা অণুস্মরণ করলে তা কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান হয়ে কাপ্তাইয়ের “রাম-সীতা” পাহাড় হয়ে রাজস্থলী-বান্দরবানের দিকে চলে গেছে। ফুরমোনের দক্ষিণে কাপ্তাইয়ের জাতীয় উদ্যান পর্যন্ত সরলরেখা টানলে এর মধ্যবর্তী অংশে রাঙ্গামাটি সদর-ঘাগড়া-বড়ইছড়ির বিশাল একটা এলাকা পড়েছে। বিশাল এই এলাকাটি আবার উঁচুউঁচু পাহাড়ঘেরা এবং ভূমি-মালিকানার দিক থেকে প্রায় বেশিরভাগই “মৌজাভূমি”। অর্থাৎ ব্যক্তিগত রেকর্ডীয় ভূমি খুবই কম আছে। ব্যক্তিগত ভোগ-দখলীয় ভূমি থাকলেও সাধারণ মৌজাভূমির পরিমাণ বেশি। পুরো এলাকাটাই তঞ্চঙ্গ্যা অধ্যুষিত। অধিকাংশই আগে জুমচাষী ছিলো। বর্তমানে ফলজ বাগানে আগ্রহ বাড়ছে পাশাপাশি আদা-হলুদ-বিলেতি ধনেপাতার চাষ বেশি। পাহাড়গুলো থাকলেও প্রাকৃতিক বন ও গভীর জঙ্গল একেবারেই কমে এসেছে।

রাঙ্গামাটির এই অঞ্চলটিকে বাদ দিলে, বিলাইছড়ি উপজেলার অধিকাংশভাগজুড়ে তঞ্চঙ্গ্যাদের বসবাস দেখার মতোন। বিলাইছড়ি উপজেলার সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন হচ্ছে “ফারুয়া”! পুরোটাই তঞ্চঙ্গ্যা অধু্যষিত! এই ইউনিয়নটা আবার রেইংখ্যং রিজার্বের অধীনে। চাষবাস বলতে রেইংখ্যং এর দুপারে জুমচাষ আর কোথাও কোথাও “পাগোন্দি ভুই”! ফারুয়ার তঞ্চঙ্গ্যারা শিক্ষা-দীক্ষায় সমগ্র বিলাইছড়ি উপজেলার শিক্ষার-হারকে প্রতিনিধিত্ব করে।

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ার সংখ্যাও ভালোই। তবে রাজনৈতিক সচেতনতার দিক থেকে একটু পিছিয়ে আছে। তাদের যে ভূমির উপর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নি এই বিষয়টা অধিকাংশ শিক্ষিতরাও বুঝতে পারে না রাজনৈতিক অজ্ঞতার কারণে। অর্থাৎ তারা যে রিজার্ব ফরেস্টে বসবাস করছে, সেটা তারা জানে ঠিকই কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী যদি মৌজা-র স্বীকৃতি না মেলে তবে সরকার যখন ইচ্ছে তখনই তুলে দিতে পারবে এ এলাকার জুমচাষীদের সেকথা সচেতনভাবে খুব কমজনেই বুজে, এরকম মনে হয়েছে।

আবার দুঃখজনকভাবে ফারুয়ার লোকজন সেখানকার “সেটেলদের”-কে “সদর” ভাবতে শুরু করেছে এরকম খেয়াল করেছি। দুয়েকটি স্বীকৃত বিয়ের ঘটনাও ঘটেছে বোধহয়। এরকম স্বীকৃত বিয়ের ঘটনা চিৎমরম-র মারমাদের মধ্যেও দুয়েকটি শুনতে পেয়েছি! খাগড়াছড়িতে তঞ্চঙ্গ্যা আছে বলে জানি না। রাঙ্গামাটির কাপ্তাই আর রাজস্থলী উপজেলা তঞ্চঙ্গ্যা অধু্যষিত। বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলায় আছে ভালো তঞ্চঙ্গ্যা বসতি। এছাড়া বান্দরবান সদরের “নীলাচল” পর্যটন অঞ্চলটা তঞ্চঙ্গ্যাদের উচ্ছেদ করেই করা হয়েছে বোধহয়।

নীলাচলের আশেপাশে কিছু তঞ্চঙ্গ্যা পাড়া আছে। দক্ষিণ দিকে আরো তাকালে, লামা-আলীকদম উপজেলায়ও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তঞ্চঙ্গ্যারা। লামা-আলীকদমে যারা আছে তাদের অবস্থা একেবারেই খারাপ! অর্থনীতি বলতে কিছু নেই আর। জুমচাষের যুগ শেষ হয়ে এলো বলে! জুম-পাহাড়ের ১৪টি জাতি সম্পর্কে প্রত্যেকেরই সবসময় টুকটাক জানার চেষ্টা করা উচিত। এই যেমন আমি জেনেছি,- খেয়াংরা চন্দ্রঘোনা অঞ্চলে, পাংখোয়ারা বিলাইছড়ির সদরের আশেপাশে এবং জুরাছড়ি উপজেলার বসন্ত মোন ও দুমদুম্যে ইউনিয়নের দুএকটি গ্রামে (আগে নাকি সাজেকেও কিছু ছিলো), খুমী-লুসাইরা বান্দরবানের রুমা উপজেলায়, চাকরা নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায়, ম্রো এবং বমরা রুমা-থানচিজুড়ে। অবশ্য ম্রোরা লামা-আলীকদমের দিকেও ছড়িয়েছে।

চাকমা-মারমা-ত্রিপুরারা অবশ্য তিন জেলাতেই ছড়িয়ে আছে। আবার সান্তাল-অহমিয়া বা আসাম এবং গুর্খাদের আগে জুম্ম হিসেবে ধরা না হলেও তাদেরকে সাথে নিয়েই বর্তমানে বলা হয়ে থাকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৪ টি জাতি। সান্তালদের খোঁজ পাওয়া যায় খাগড়াছড়ির পানছড়িতে তবে লক্ষিছড়ি উপজেলার দুয়েকটি গ্রামেও থাকতে পারে, অহমিয়ারা রাঙ্গামাটি সদরের আসামবস্তি ও মাঝেরবস্তি এলাকায় এবং গুর্খারা তবলছড়ির মাঝেরবস্তি ও আনন্দবিহার এলাকার পার্শ্ববর্তী এলকাগুলোতে বসবাস করছে।

যে এলাকাটায় এবার গিয়েছিলাম সেখানে একটি বিশাল ঝরণা আছে। ধারণা করি উচ্চতায় শুভলঙের দ্বিগুণ হবে। শুভলঙ তো শুধু একটা ‘মুড়ো’ বা পাহাড় বেয়ে নেমেছে। এটি পুরো “মোন’-টিকে বেয়ে নেমেছে। সৌন্দর্যটাও অকৃত্রিম এবং এখনো পুরোপুরি বন্য। তবে বর্ষা ছাড়া পানি থাকে না। যাই হোক যতই ঘুরছি সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামটাকে দিনদিন আরো বেশি নিবীড়ভাবে দেখতে পাচ্ছি। লুকোনো হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা থেকে শুরু করে আগামীর সম্ভাবনা! আপনিও ঘুরতে থাকুন, পর্যবেক্ষণ করতে থাকুন এবং প্রস্তুতি নিতে থাকুন।

যে কোন বড় দুর্যোগ মোকাবেলা করার জন্য যে কোন ব্যক্তি এবং জাতির জন্যই আগাম প্রস্তুতি থাকাটা আবশ্যক! কে জানে আমাদের কপালে এরকম দুর্যোগ লেখা আছে কি নেই? তবু প্রাণপণে বিশ্বাস করতে শিখুন যে, – “মুরি আর বাজি এ দেজচান আমার”! ন চাঙ যেবার এই জাগান ছাড়ি….

***লেখাটি ২০১৭ সালের দিকে লেখা। প্রথম প্রকাশ করেছিল জুমজার্নাল। পাঠকদের জন্য এখানে তুলে ধরা হল..

বরকল, ফালিটাঙ্যে চুগ আ বরগাঙও আহভা

0

ফোনে গান বাজছিলো রণজিৎ দেওয়ানের-

“চেঙে মেয়োনী হাজলঙ কর্ণফুলি, শঙ্খ, মাতামুহুরী,
ঝড়ঝড়ঝড় ঝড়ঝড়ঝড় বোই যর ঢেউ তুলি”

আর আমি গান শুনতে শুনতে বরকল কলেজের বারান্দায় বই পড়ছিলাম-
“১৮.১০.২০০৩ তারিখ আমি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করি। সাক্ষাৎকারের সময় শেখ হাসিনা আমাকে বলেন যে, তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করতে আন্তরিক ছিলেন। তাই তিনি সন্তু লারমাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী হতে বলেছিলেন। কিন্তু সন্তু লারমা নিজে মন্ত্রী না হয়ে কল্পরঞ্জনকে মন্ত্রী করতে বলেছিলেন। তিনি আরো বলেন কল্পরঞ্জন মন্ত্রী হয়ে নিজের স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। চুক্তি বাস্তবায়নে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি দীপঙ্কর তালুকদার সম্পর্কেও মন্তব্য করেন এবং বলেন যে, দীপঙ্করও চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক ছিলেন না। এভাবে যাদের উপর চুক্তি বাস্তবায়নের দ্বায়িত্ব ছিলো, তারাই চুক্তি বাস্তবায়নে বাঁধা হয়ে দাঁড়ান”। (পৃষ্ঠা-৬৭, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আমার জীবন, ২য় খন্ড, শরদিন্দু শেখর চাকমা, সাবেক রাষ্ট্রদূত, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার)।

বইটি পড়া শেষ হয়ে এলে আনমনা হয়ে যাই। কলেজের মাঠটা একচক্কর দিয়ে এসে, কলেজমাঠের এককোণায় বসে পড়লাম একটা “ফুলসুমোরি” গাছের নীচে।জায়গাটা থেকে স্পষ্ট করে দেখা যায় “বরগাঙ” টা কীভাবে রাঙামাটিমুখী হয়েছে। দুইপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়। মাঝখান দিয়ে নীরবে বয়ে চলেছে বরগাঙ। বরগাঙটাও দেখছি, পাহাড়ও দেখছি, সাথে বিজু হাওয়ায় বিজুফুলের সৌরভ! আহ্!

চৈত্রের একেবারেই শেষ দিনগুলোতে প্রচন্ড খরতাপে পাহাড়গুলোকে দূর থেকে দেখলে কেমন জানি অসহায় অসহায় লাগে। অবশ্য আমি এসময়টাতেই পাহাড় চড়তে বেশি ভালোবাসি। যাই হোক, সূর্যটা একটু হেলে পড়লেই আমি আর রিটন দা ফালিটাঙ্যের পথ ধরবো এমনটাই কথা ছিল। কিন্তু কলেজে এইচএসসি পরীক্ষা চলছিলো এবং রিটন দা-র পরীক্ষার হলে দ্বায়িত্ব পড়েছিলো। তাই সেদিন ফালিটাঙ্যে ছোঁয়া কোনভাবেই যে সম্ভব হবে না তা মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, ঢাকা ফিরেই সংগ্রহে থাকা শরদিন্দু বাবুর বইগুলো আরও একবার চোখ বুলাতে হবে।

বরকল পাহাড়

আমার ধারণা একক লেখক হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের লেখকদের মধ্যে প্রকাশিত বইয়ের হিসেব করলে খুব সম্ভব শরদিন্দু শেখর চাকমার বইয়ের সংখ্যায় বেশি হবে। গোটা আট-দশেক বই আছে তাঁর নামে।

উপরের বইটিতে যে তথ্য তিনি হাজির করেছেন, তা একটু খতিয়ে দেখতে হবে এমনটা ভাবছিলাম। পরক্ষণেই আবার ভাবলাম, ধূর এ আর নতুন কি?? পাহাড়ে যুগে যুগে কারা দালালি করেছে আর কারা সংগ্রাম করেছে তা পাহাড়ের গণমানুষ ঠিকই জানেন।

প্রসঙ্গত মনে পড়ে গেল, তখন মোনঘরে ছিলাম। কল্পবাবু একবার মোনঘরে আথিতেয়তা নিয়েছিলেন। রাঙ্গাপানি খেলার মাঠে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিলো পাহাড়ের “প্রথম মন্ত্রী” মহাশয় কে।

একটা গান রচনা করে গাওয়া হয়েছিলো, গানের প্রথম কলিগুলো আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে- “মন্ত্রী বাবুউউ উ উ এলও আমা আদামত গম লাগের সুখ লাগের আমা মনানত”।

খুব সম্ভব রণজিত দেওয়ান অথবা পঠন চাকমার লেখা হতে পারে গানটি। গানটি গেয়েছিলেন মোনঘরের সুপরিচিত ক্রীড়াশিক্ষক অরুন কান্তি চাকমার মেয়ে সোমা চাকমা এবং অন্য আরেক সংস্কৃতিকর্মী পঠন চাকমার মেয়ে মেডোনা চাকমা, এরকম মনে আছে।

যাই হোক, কল্পবাবু মোনঘর অথবা পার্বত্যবাসীর জন্য কি কি করেছেন বা করতে পেরেছেন তা ঠিক বলতে পারবো না। কিন্তু তিনি জুম্ম জনগণের কপালে যে পেরেকটি ঠুকে দিয়েছেন বলে শুনেছি, তার জন্য আসলে তাঁর কোন ক্ষমা হয় না। সত্য কি না জানি না, তবে গ্রহণযোগ্য অনেক সিনিয়রজনের কাছে শুনেছি যে মূলত কল্পরঞ্জন চাকমার সময়েই পাহাড়ে স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজাদের পাশাপাশি তিন পার্বত্য জেলার ডিসিদেরকেও ক্ষমতা প্রদান করা হয় এবং এই দূরভিসন্ধিমূলক শাসকীয় কার্য সিদ্ধি করতে কল্পমিয়াই মুখ্য ভূমিকাটা রেখেছিলেন।

আগে হেডম্যানদের সুপারিশে স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র দিতেন কেবল তিন সার্কেলের চীফ বা রাজারা। কিন্তু কল্পমিয়া করলেন কি, কেবল সার্কেল চীফরা নয় এখন থেকে ডিসিরাও স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র দিতে পারবেন এই মর্মে ফরমান জারি। আর এখন আমাদের কপাল, অনেক জায়গায় সার্কেল চীফদের প্রদত্ত স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র দাপ্তরিকভাবে আমলেও নেওয়া হয় না আর। অনেক ক্ষোভের আগুন নিয়ে তাই গালি দিতে ইচ্ছে করে “হালার কল্প, বুদ্ধি ক্যানে এত স্বল্প”?

যাই হোক, রাঙ্গামাটির বরকল উপজেলাটিকে খুব সম্ভবত এখনো প্রত্যন্ত এবং দুর্গম একটি উপজেলা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাক্ষেত্রে এই উপজেলা বেশ পিছিয়ে ছিলো এতদিন। এখনো বৈ কি! তবে জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসে কেতু ওস্তাদের বরকল বরাবরের মতোই অসীম সাহসী লড়াই এখনো জিইয়ে রেখেছে তা বলা যেতে পারে বোধহয়। আমি প্রথম বরকল গিয়েছিলাম ২০০২ সালে, তখন ক্লাশ ফাইভের ছাত্র। এরপরে বেশ কয়েকবার যাওয়া-আসা হয়েছে। একবার গিয়েছিলাম বুয়েটের রিকন দা-র সাথে। সেবছর বরকল কলেজের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সাথে উচ্চশিক্ষা নিয়ে মতের সহভাগিতা করেছিলাম আমি আর পিসিপির কেন্দ্রীয় নেতা রিকন দেওয়ান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক মেধাবী মুখ এবং ছাত্রনেতা বাতায়ন চাকমা দা নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি এখন বরকল কলেজের প্রভাষক। এরপরে একবার গিয়েছিলাম দলবল হয়ে আমার ক্যাম্পাস মেটদের নিয়ে “থেগা” দর্শনে। প্রতিবারই ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা ও সৌন্দর্য প্রাপ্তি হিসেবে যোগ হয়। কিন্তু এতবার যাওয়া-আসা হলেও বরকলের “ফালিটাঙ্যে চুগ” উঠার সৌভাগ্য কখনোই হয় নি। এবার বিজুতে হুট করে একটা সুযোগ মিলে গেলো। তাও আবার সেই বরকল কলেজেরই শিক্ষক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা রিটন চাকমা দা-র মাধ্যমে। রিটন দা-র আরেকটি পরিচয় তিনি আদিবাসী গানের দল “মাদল”-র প্রতিষ্ঠাকালীন একজন সদস্য। বরকল সদর উপজেলা বাজারটির কিছুটা পুর্বে বেশ বড় একটি পাহাড়ের উপর বরকল রাগীব-রাগেয়া কলেজটি এইতো সবে কিছুদিন হলো যাত্রা শুরু করেছে। কলেজটি স্থানীয়রা নামকরণ করতে চেয়েছিলো “বড়গাঙ কলেজ” নামে। যুতসই নামই হতো তা।

বরকল উপজেলা পরিষদ ভবন

কিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য তা করা যায় নি। নামের জন্য কাম টা আটকে থাকুক, তা হতে পারে না, কেননা বরকলের দরকার ছিলো শিক্ষা। অন্যদিকে তথাকথিত দানবীর রাগীব সাহেব তার নামটা স্বীকৃতি না পেলে কিছুতেই অর্থ সহযোগিতা দিবেন না।

জনগণের তো সামর্থ নেই কলেজ প্রতিষ্ঠা করার! যে সরকার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের লোভ দেখায় সে সরকারের কাছে আমরা একটি কলেজ পাওয়ার ভরসা করতে পারি না কেন?

বরকল সদর উপজেলাটি “ফালিতাঙ্যে” পাহাড়টির একেবারে দক্ষিণ পাদদেশের কোলে গড়ে উঠেছে। বরকলের মাছ এর স্বাদ যে একবার পায় তার মুখে লেগে থাকে। বরগাঙের অমৃত স্বাদের মাছ এখনো এই বরকলেই পাওয়া যায়।

মিজোরামের লুসাই পাহাড় থেকে নেমে এসে জুম্মদের প্রিয় “বড়গাঙ” এই বরকল উপজেলার পাশ দিয়েই সাপের মতন রাঙামাটিমুখী হয়েছে। ঠিক কি কারণে উপজেলাটিকে বরকল নামকরণ করা হয়েছে তা সঠিক বলতে পারব না।

তবে ধারণা করা যেতে পারে বরহলগ/বড়কলগ থেকে বরকল উপজেলাটির নামকরণ হতে পারে। চাকমারা ঝরণা বা প্রপাতকে হলগ/কলগ বলেও অভিহিত করে থাকে। তাই বড়হলগ বা বড়কলগ থেকেই বরকল নামটির উৎপত্তি হয়েছে এমনটা ধরে নেওয়া যেতে পারে। বর্তমান বরকলের সদর উপজেলা অফিসের পাশেই বড় একটি শুকনো চাদারা (পাথুরে খাদ) আছে যা বেয়ে বর্ষার সময় কিছু পানিও নামে, তবে ঠিক ঝর্ণা বলা যাবে না আর। বোধহয় এটাই একসময় বড়হলগ বা বড় ঝরণা ছিলো। বিষয়টি ড: সুনীতি ভূষণ কানুগোর লেখা “ব্রিটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে চাকমা জাতির প্রতিরোধ সংগ্রাম” শীর্ষক বইয়ে উদ্ধৃত করা ড: বুকাননের নোটগুলো স্মরণ করে খতিয়ে দেখা যেতে পারে-

“বরকল জলপ্রপাত একসময়ে বাংলা প্রদেশের বৃহত্তম জলপ্রপাত ছিল। বর্তমানে এই জলপ্রপাত কাপ্তাই জলাধারে নিমজ্জিত হয়ে গেছে। ড: বুকানন জলপ্রপাতটির সৌন্দর্য বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেন,

I walked up about a mile to an higher ledge of rocks over which the river (The Karnaphuli) falls in various beautiful cascades …. The scenery is very beautiful when the river is much swollen and all the small cascades united it must be very granal.

রাঙ্গামাটি থেকে হরিণা পর্যন্ত সমগ্র পার্বত্য অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বুকানন লিখেছেন,

As i approached Hattea (Elephant Rock) the scenery became beautiful, and there it is highly romantic.”

(পৃষ্ঠা-১২, ব্রিটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে চাকমা জাতির প্রতেরোধ সংগ্রাম, ড: সুনীতি ভূষণ কানুনগো।)

আলাম্বা হচ্ছে বরকলের একটি গ্রাম। এর কাছাকাছি ইউনিয়ন হচ্ছে হরিণা, ভুষণছড়া আর আইমাছড়া। বরকলের এই এলাকাটার সৌন্দর্য নিয়ে কেবল বুকানন সাহেব নন, আরো অনেকেই বিমোহিত হন। এলাকাটা নিয়ে ভালো একটা চাকমা গানও আছে।

“ভালোকবজর আগে আলাম্বা আগারে বেড়া যিয়োঙ।
একদিন্ন্যে বেলান উধের, মুই এলুঙ মুড়ো লেজাৎ, ছড়া পারত।
জাগায়ান ভারি দোল লাক্কে। এনজান দোল জাগায়ান হুধু আগে হিজেনি”

(বহুবছর আগে আলাম্বার উজানে বেড়াতে গিয়েছিলাম। একদিন,সূর্য উঠছে আর আমি ছিলাম পাহাড়ের পাদদেশে, ছড়ার পারে। জায়গাটি অনেকসুন্দর ছিলো। এমন সুন্দর জায়গা কোথায় আছে?)

যদি ভুল করে না থাকি উপরের কথাগুলো সাবেক উপমন্ত্রী মণিস্বপণ দেওয়ানের গাওয়া খুব বিখ্যাত একটি চাকমা গানের প্রারম্বিক কথন। গানটির প্রথম কলিগুলো এরকম-

“রঙ বেরঙর তেন টোঙরি বঙপাদারে যাদন উড়ি
এনজান দোল জাগাগান হুধু আগে কিজেনি
পিনোন পিন্ন্যে খাদি বান্ন্যে গাভুর মিলা ঝাক
বানি শয্য ভুইয়ো সেরেন্দি হুধু যাদন আহজি আহজি
এনজান দোল জাগায়ান হুধু আগে কিজেনি”

(“নানা রঙের ঘাসফরিঙ নানান দিকে ছড়িয়ে উড়ে এমন সুন্দর জায়গা কোথায় আছে কে জানে পিনোন পড়া, খাদি জড়ানো রমনীরা ঝাঁক বেঁধে শর্ষে ক্ষেতের মাঝ দিয়ে কোথায় যায় হেসে হেসে এমন সুন্দর জায়গা কোথায় আছে কে জানে”)

অবশ্য আমার সবচেয়ে ভালো লাগে গানটির এই কলিগুলো…

“মনে মনে কেতকেত্যে র আমহক ওইনেই শুনি আগঙ
এগামনে অঘলক্কো চামনি গাজও ভেঙা ঢেলাৎ যার ডুগুরি”

(“আনমনে অবাক হয়ে শুনছি কর্কশ আওয়াজ মগ্ন হয়ে অঘলক পাখি চামার গাছের বাঁকা শাখে অনর্গল ডাকে”)

(বাংলাগুলো ঠিক অনুবাদ হিসেবে ধরে নিবেন না। বুঝার সুবিধার্থে আমার মতো করে বাংলা করার চেষ্টা করেছি মাত্র।)

কাপ্তাই বাঁধটি হওয়ার আগে বরকল বাজার টি বেশ ভালো একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্র ছিলো বলে ধরে নিচ্ছি। যেহেতু এই পথ দিয়ে লোকজন মিজোরাম বা ভারত পর্যন্ত আসা যাওয়া করতো আর বরগাঙ চ্যানেলটি সরাসরি পুরাতন রাঙ্গামাটি ও পুরাতন রাজবাড়ি-র সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলো। কাপ্তাই বাঁধটি হওয়ার পরে শলক দোর বাজার/ চুগুলোঙ বা বর্তমান শুভলঙ বাজারটি-র গুরুত্ব অত্যধিক হওয়ায় ধীরে ধীরে বরকলের অর্থনৈতিক গুরুত্বটা কমে এসছিলো সম্ভবত।

আবার তুলনামূলকভাবে বরকলের মাটিগুলো পাথুরে এবং ফসল উৎপাদনের হারটা অন্যান্য উপজেলার তুলনায় পিছিয়ে বলেই মনে হয়। প্রসঙ্গত, বড়কল উপজেলাটি নিয়ে একটি চিঠির কথা মনে পড়ে গেল। বহু আগে জুম ঈসথেটিক কাউন্সিল (জাক)-র একটি প্রকাশনায় এক পাঠকের চাকমা ভাষায় লিখিত একটি চিঠি পড়েছিলাম। সম্পাদকের উদ্দেশ্যে চিঠিপত্র বিভাগে চিঠিটি সম্ভবত লিখেছিলেন বরকল উপজেলার প্রথম বিসিএস অফিসার এবং বর্তমানে উপসচিব পদমর্যাদার শ্রদ্ধেয় কৃঞ্চকিশোর চাকমা। সম্ভবত চিঠি লিখেছিলেন রাঙ্গামাটি কলেজের ছাত্রাবস্থায়। চাকমা ভাষায় লিখিত চিঠির মূলভাষ্যটা ছিল এরকম যে, “অনুর্বর ভূমির বরকল উপজেলার শিক্ষা-দীক্ষা অর্থনীতিটা বেশ পিছিয়ে আছে। করণীয় কী??”

জাক-র পক্ষ থেকে বা জাকের সেই প্রকাশনাটির পক্ষ থেকে খুব সম্ভব সম্পাদক কবি সুহৃদ চাকমা চিঠি প্রেরককে উত্তর দিয়েছিলেন এরকমভাবে “তোমা বড় হল আন ধোয় ধোয় হিয়ো”। (“আপনাদের বড় মেশিনটি ঘষেমেঝে খেয়েন”)। চিঠিটি আমার মনে খুব করে দাগ কেটেছিলো বরকল সম্পর্কে জানতে! পরবর্তীতে কলেজে পড়ার সময় কৃঞ্চকিশোর চাকমাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি আমার বাল্যবন্ধু শুভকর এবং কৃঞ্চ আংকেল এর পুত্র চুয়েট পড়ুয়া অনুজ কৃতি চাকমার সুবাদে। পুরো বরকল উপজেলাজুড়ে কৃঞ্চবাবুর বেশ সুনাম।

কীভাবে তিনি আর্থিক দূরবস্থায় জর্জরিত পারিবারিক পরিচয়কে ছাপিয়ে পরিশ্রম আর মেধাবলে হয়ে উঠলেন প্রতিষ্ঠিত এবং সৎ সরকারি আমলা তা বিভিন্নসময়ে বিভিন্নজনের মুখে শুনেছি। কিছু কিছু লিটলম্যাগ এ তার কিছু লেখা-টেখাও পড়েছি বলে মনে হয়। তাঁর সম্বন্ধে যারা জানেন তারা নিশ্চয়ই বলবেন তিনি একজন নিখাদ ভদ্রলোক, গুণী এবং জ্ঞানী মানুষ। যাই হোক, সেদিন আর ফালিটাঙ্যে যাওয়া হচ্ছে না- রিটন দা নিশ্চিত করলেন। আমি আর রিটন দা পাহাড় চূড়োয় অবস্থিত কলেজের বারান্দায় বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলাম। এরই মধ্যে রাঙামাটি থেকে বিকেলের লঞ্চে বরকল চলে আসলেন রাসেল চাকমা দা।

রাসেল দা-ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা। রাসেল দা রাতে খাওয়ার জন্য কিছু টাটকা মাছ কিনে নিয়ে এসছিলেন। তাঁর পরীক্ষার হলে ডিউটি ছিলো পরেরদিন। দুর্গম হওযার কারণে কখনো কখনো কলেজেই তাঁবু গড়েন এখানকার শিক্ষক মহোশয়রা। রাঙামাটি থেকে প্রতিদিন আসা-যাওয়াটা বিরক্তিকর আর এখানে স্থায়ী থেকে যাওয়াটাও মনে সায় দেয় না এরকম একটি অবস্থা। গল্পচ্ছলে রাসেল দার নিয়ে আসা মাছগুলো “গঙ” করছিলাম আমি, রিটন দা, রাসেল দা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী কৃপায়ন চাকমা দা, ২০০৩-এই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকানো গ্রোমিকো দা প্রমুখ।

ছাত্ররা নয় বরকল কলেজের প্রাণ যেন এই শিক্ষকরাই। গল্প করতে করতেই জেনে নিলাম কলেজে যে কজন শিক্ষক আছেন, তাঁর মধ্যে সবাই কোন না কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী এবং বর্তমানে নবীন কলেজ শিক্ষক। কমবেশি প্রায় সবায়ই ছাত্রাবস্থায় পিসিপির সাথে কোন না কোনভাবে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে সবাই সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও পাহাড়ের বাস্তবতায় দারুণ রাজনীতি সচেতন। নিখাদ আন্তরিকতা নিয়ে সদ্য প্রতিষ্ঠিত কলেজটির হাল ধরার চেষ্টা করছেন। মনে মনে ভাবলাম, “এম এন লারমার চেতনা-হারিয়ে যেতে দিব না” এই স্লোগানে এরা কোন না কোন সময় নিশ্চয়ই কোরাস মিলিয়েছে। গ্রোমিকো দা-র জ্ঞানগর্ব সরেস ফাজলামির সাথে কৃপায়ন দা-র বিনয়ী সরল হাসি, সাথে রাসেল দা আর রিটন দা-র গাম্ভীর্য মাখা বিকেলটা নিমেষেই রাত হয়ে এসছিলো।

প্রচন্ড মিস করছিলাম ঢাকা বিশ্ববিধ্যালয়ের সাবেক মেধাবী মুখ ও ছাত্রনেতা প্রিয় বড়ভাই বাতায়ন চাকমা বা কার্তুজ দা কে! তিনি আর ত্রিজিনাদ দা-ই তো প্রথম আমাকে নিয়ে এসছিলেন এই কলেজের বারান্দায়। রাতে খাবার-দাবার এর পর্বটা সেরে আমি আর রিটন দা ঠিক করলাম পরের দিন দুপুর নাগাদ ফালিটাঙ্যে-র উদ্দেশ্যে আমরা রওনা হচ্ছি।

এরইমধ্যে খবর পেলাম ঢাকা পিসিপির ছোটভাই রিপরিপ বরকলের ছেলে এবং বিজুর ছুটিতে সে এখন বরকল অবস্থান করছে। বরকল বাজারের এক দোকানে চা খেতে গিয়েছিলাম, সেখানে কথাসূত্রে এই খবরটা দিয়েছিলো বরকল কলেজের ১ম ব্যাচের এক শিক্ষার্থী যে এখন পলিটেকনিক শেষ করে চাকরি খুজতেছে। আমি ছেলেটাকে ঠিক চিনতে পারি নি। সেই আগ বাড়িয়ে আমাকে বলেছিলো- “দা নমষ্কার, মরে চিনোর নি? উই সেক্কে বো আমা কলেজত লেকচার দোগিদে বাতায়ন স্যার ও লগে? আমি বরকল কলেজর ফার্স্ট ব্যাচ আই।” বেশ কিছুক্ষণ কথা বললাম তার সাথে। তখনই জেনে যাই যে, সে রিপরিপ এর বন্ধু।

তাদের ব্যাচটা ছিলো বরকল কলেজের ১ম ব্যাচ এবং সেই ব্যাচ থেকে একজন ছাত্র বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মনে মনে হাসছিলাম আমি! ভাবছিলাম উফ, আমার লেকচারটা কাজে লেগেছে নিশ্চয়ই! নাকি রিকন দা-র কথাগুলো? যাই হোক এটুকুই সেদিন আমরা বলেছিলাম যে, “বরকল কলেজের ১ম ব্যাচ হিসেবে, তোমাদের দ্বায়িত্ব হবে তোমাদের পরবর্তীতে যারা এই কলেজে পড়তে আসবে তারা যেন তোমাদের সফলতা দেখে গর্ব করতে পারে এবং উৎসাহিত হতে পারে।” আমি আর রিকন দা যখন বরকল কলেজে যাই তখন কলেজটা বাঁশের ছিলো সম্ভবত। এখন অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার চেষ্টা চলছে। দেখতে দেখতে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে এসছে। তাই অনেককেই ভর্তি করানো সম্ভব হয় না।

কলেজের প্রিন্সিপাল নৈচিং রাখাইন কলেজের উন্নতি নিয়ে খুবই আন্তরিক এবং সচেষ্ট। পাশাপাশি শিক্ষক এবং স্থানীয়রাও যে যার মতো আন্তরিক ভূমিকা নিয়ে চেষ্টা করছেন উপজেলায় শিক্ষা প্রসারে যেন কলেজটি ঠিকমতো ভূমিকা রাখতে পারে। যাই হোক, ছেলেটার মাধ্যমে রিপরিপকে খবর দিলাম পরেরদিন যেন সে প্রস্তুত থাকে ফালিটাঙ্যে যাওয়ার জন্য। রিপরিপ রাতে ফোন দিলো। জানালো সে প্রস্তুত এবং দুপুরে তার বাসায় নিমন্ত্রণ। আহ্, মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।

পরেরদিন সকালে পুরো উপজেলা বাজারটি এ মাথা- ও মাথা একচক্কর ঘুরে নিলাম। দুপুরের দিকে রিপরিপের বাবা প্রতিময় আংকেল এর সাথে পরিচয় হলো। দু’জনে মিলে জুড়ে দিলাম “পানজা নাগর”। সদা হাস্যজ্জ্বল প্রতিময় আংকেল এর সাথে গল্প করতে করতে জেনে নিলাম অনেক কিছুই। আমি সাধারণত বরকল, জুরাছড়ি আর বিলাইছড়ি বেড়াতে গেলে ২০০৭-২০০৮ এর জরুরী অবস্থার সময় কেমন ছিলো সেখানকার পরিস্থিতি তা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি। এবং এই বিষয়ে সাধারণ মানুষের কথোপকথন শুনেই আমি বুজে যাই “আপসহীনতার” নামে পাহাড়ে ১৯ বছর ধরে কীভাবে রচিত হচ্ছে প্রপাগান্ডা সাহিত্য(!) আর বিপরীতে কেনই বা জনসংহতি সমিতির পতাকাকে জুম্ম জনগণ নিরাপদ মনে করে।

যাই হোক, সেদিকে আর গেলাম না। জনসংহতি সমিতি-র এযাবৎ কালের আন্দোলন সংগ্রামে বরকল উপজেলার মানুষের বিশাল অবদান। নির্ভরযোগ্য সাংগঠনিক ভিত্তি এলাকা বটে! রিপরিপের বাবা প্রতিময় আংকেল এর সাথে গল্প শেষ হতে না হতেই রিটন দা’র ফোন। কলেজের ডিউটি শেষ। আর কিছুক্ষণ পরেই আমি, রিপরিপ আর রিটন দা মিলে আমরা যাচ্ছি বহুল কাঙ্ক্ষিত ফালিটাঙ্যে চুগ এর উদ্দেশ্যে। বাজার থেকে ছুড়িমাছ, সিদোল, মরিচ আর চাউল নিলাম। নিয়মিত পাহাড় চড়ি, তাই কোথায় গেলে কী নিয়ে যেতে হবে তা টুকটাক ধারণা আছে বৈ কি! সূর্যটা সবে পশ্চিমে হেলে পড়েছে এমন সময় পৌঁছে গেলাম ফালিটাঙ্যে চুগ এর কোলে এক জুম্মো ভাইয়ের মোনঘরে।

আশ্রয় চাইলাম, হলুদচাষী গেরস্ত এবছর হলুদের ভালো ফলন পেয়েছেন, হেসে হেসে বললেন “এম্বা মুড়োত গাই গাই থাঙ, তোমারে জাগা ন দিলে হারে জাগা দিদুঙ।” পাহাড়ের মানুষগুলোই এমন- “ঘর ছোট হতে পারে মন ছোট নয়, ধন না থাকতে পারে মন একটা থাকবেই।” বাড়ির পাশেই ছোট্ট একটা ঝিড়ি। গোসল সেরে নিলাম হাজার বছরের শ্রান্তি মাখানো পাহাড়ি ঝিড়ির জলে। প্রাণ জুড়িয়ে গেল। জোসনা মাখানো ফালিটাঙ্যের চুড়ো থেকে বরগাঙটা দেখতে দেখতে রিটন দা গীটারটা বের করলেন। গাইতে পারি না তবে গাইতে চাচ্ছিলাম-

বরকলও নাঙ শুন্নোনি লুজেই হিল-ও হুরে
 সিদু এল ম ঘরান দন্দছড়া ভিদিরে
 বরগাঙত্তুন ৩ মেল দূরত গোরস্থান আদামান
চেরোহিত্তে ভূয়ে জুমে মুড়োমুড়ি ছড়াগাঙ
আজার বজর ধরি এলং সিদু মনান থেব জনমান

গানটি কার লেখা বা গাওয়া জানি না। বাংলাটা বোধহয় এরকম করে করা যেতে পারে…

বরকলের নাম শুনেছো কি লুসাইহিল এর কাছে

সেখানেই ছিলো আমার ঘর দন্দছড়ার ভিতরে

বরগাঙ থেকে তিন মাইল দূরে গোরস্থান আদামটি

চারিদিক ক্ষেত আর জুম পাহাড় ছড়া আর গাঙ

হাজার বছর ধরে ছিলাম সেখানে মনটাও থাকবে জনমভর।

***লেখাটি লেখা হয়েছিল ২০১৭ সালের দিকে এবং জুমজার্নালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। পাঠকদের জন্য এখানে তুলে রাখলাম..

পাহাড়ের নতুন রঙের, নতুন সম্ভাবনা!

0

চুনীলালের শিল্পযাত্রার স্বপ্ন যেন ভঙ্গ না হয়…

পাহাড়ের শিল্পের যে দ্যুতি তা নিয়ে খুব কমই কাজ হয়েছে। চুনীলাল দেওয়ান সর্বপ্রথম পাহাড়ের অনুভূতিগুলো শিল্পের ফ্রেমে উপস্থাপণের প্রয়াস চালান। কলিকাতা আর্ট কলেজে একসাথে সময় কাটিয়েছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের সাথে। মূলত চুনীলাল দেওয়ানের হাত ধরেই পাহাড়ের উর্বর শিল্পসম্ভাবনার সন্ধান পাওয়া যায়। কেবল চিত্রশিল্পীই নন, তিনি একাধারে কবি, গায়ক, সুরকার, গীতিকার ও ভাস্কর ছিলেন। পাহাড়ের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে চুনীলালের স্বপ্নময় পদচারণা প্রজন্মের অনেককেই এখনো বেশ উৎসাহ যোগায়।

পরবর্তীতে শিল্পী কনক চাঁপা চাকমা পাহাড়ের রঙকে পরিচয় করিয়ে দেন মূলধারার শিল্পযাত্রার সাথে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় পড়ার সুবাদে তাঁর সে সুযোগটুকু তৈরী হয়েছে। তাঁর তুলির গতি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের শিল্প দরবারেও।

কনকচাঁপা চাকমার দুটি চিত্রকর্ম

কনকচাঁপার শিল্প ভাবনায় পাহাড়ের কোলে আবহমানকাল সৌন্দর্যের বেষ্টনিতে নিষ্পাপ মুড়িয়ে থাকা পাহাড়ী কন্যার অন্তর্দহন, উচ্ছাস, গহীনের শব্দগুলো উঠে এসেছে। তাঁর শিল্প ভাবনায় সবসময় খেলা করে বেড়ায় পাহাড়ী কন্যার নিষ্পাপ চাহনি অথবা নির্মল অবয়ব। পাহাড়ের “ফিগার” অধ্যয়নে তিনি এখনো পর্যন্ত বিনাতর্কে অদ্বিতীয় এবং অবিসংবাদিত। কখনো কখনো বৌদ্ধ ধর্মের গেরুয়া সারল্যের প্রতি ঝোঁক পাওয়া যায় তাঁর কাজগুলোতে। অবশ্য সবসময়ই তুলির গতিতে অবিরাম তিনি রঙের উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে দিচ্ছেন সাহসী এবং পরিণত ক্যানভাসে। গতিময় তুলিতে নির্বাক বয়ান দিয়ে যাচ্ছেন কিছু “সময়ের”। পাহাড়ের শিল্পযাত্রায় নিজের অবস্থান অনেক উঁচুতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন শিল্পী কনকচাঁপা চাকমা। পাহাড়ের শিল্পীদের জন্য অণুপ্রেরণার একটা জায়গাও তিনি নিশ্চয়ই প্রতিষ্ঠা করেছেন।

চুনীলালের সূচনা করা গন্তব্যে খুব কম পাহাড়ি শিল্পীই যাত্রা ধারাবাহিক রাখতে সক্ষম হয়েছেন।

দীর্ঘদিন ধরে তাই পাহাড়ের শিল্প মানেই খুব স্বাভাবিকভাবে কনকচাঁপা চাকমার অবস্থানই প্রতিষ্ঠিতভাবে প্রতিনিধিত্বমূলক বলে আখ্যায়িত করা যায়। তবে পাহাড়ের শিল্পময় অনুভূতিগুলোর বিকাশে যে কাজ একেবারেই হয়নি এমন নয়। কনকচাঁপার পরবর্তীতেও অনেকেই এগনোর চেষ্টা করেছেন পাহাড়ের শিল্প সম্ভার নিয়ে। অনেক প্রতিশ্রুতিশীল তরুণের আনাগোনাও নতুন করে পরিলক্ষিত হচ্ছে। একটু সচেতন দৃষ্টি আর যত্ন পেলেই পাহাড়ের শিল্পীরা মূলধারার শিল্পযাত্রায় যোগ করতে পারে বৈচিত্রময় পাহাড়ের সমৃদ্ধ শিল্পভাবনার নতুন নতুন অভিসন্ধর্ব।

যাই হোক,পাহাড়ের শিল্পচর্চার ধারাটা খুব বেশী বেগবান হয়ে উঠতে পারে নি, বিভিন্ন কারণে। তবে সেখানকার অব্যক্ত অনুভূতিগুলো সুযোগ মিললেই দেওয়াল ভাঙার উচ্চারণে উঠে আসার বিদ্রোহ দেখিয়েছে। ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় “হিল আর্টিস্ট গ্রুপ”। প্রতিষ্ঠার পর থেকে তারা পাহাড়ের শিল্পচেতনার সাথে সংযোগ ঘটানোর প্রয়াস চালিয়েছেন, দেশের শিল্পজগতের। এপর্যন্ত প্রায় ৬টি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন তারা পাহাড়ের শিল্পীদের নিয়ে।

গত ৯ ডিসেম্বর, ২০১৬ ইং থেকে ১৪ই ডিসেম্বর,২০১৬ ইং ঢাকার ধানমন্ডিস্থ দৃক গ্যালারিতে  “প্রকৃতি ও জীবন” শিরোনামে সফলভাবেই তারা সম্পন্ন করলো তাদের ৬ষ্ঠ শিল্পকর্ম প্রদর্শনী। বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ছিলেন উদ্বোধনী দিনের প্রধান অতিথি। আমার পরিচিত অনেক শিল্পীর কাজ দেখলাম প্রদর্শনীতে। ভালো লাগলো। ঘুরে আসা প্রদর্শনী এবং ইতোপূর্বেকার আমার ব্যক্তিগত আগ্রহের জায়গা থেকে পাহাড়ের শিল্প ও শিল্পীদের প্রতি স্বভাবসুলভ ঝোঁকের নিমিত্তে সম্ভাব্য ধারাবাহিক অনুস্মরণ চেষ্টার অভিজ্ঞতার আলোকে আমার চেনা-জানা মুখগুলোর শিল্পভাবনার সাথে কিছুটা সহভাগিতা করার খায়েশ হলো। সেই খেয়ালেই, এই লেখা….

শিল্পী ধনমনি চাকমার দু টি চিত্রকর্ম

পাহাড়ের শিল্প সম্ভাবনাকে আঁকড়ে ধরে পাহাড়ের অপরাপর শিল্পীদেরকে সাথে নিয়েই দীর্ঘদিন থেকে দেশের শিল্পজগতে পাহাড়ের শিল্পকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ব্রত নিয়ে কাজ করে যাওয়ার চেষ্টা করছেন পাহাড়ের অন্যতম সিনিয়র শিল্পী ধনমনি চাকমা। নিজে বিকশিত হওয়ার পাশাপাশি আগলে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন অন্যান্য শিল্পীদেরকেও। পাহাড়ের শিল্পীদের সংগঠিত করার চেষ্টায় তিনি বরাবরই উদ্যোগী ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছেন বলে জানি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রয়িং এন্ড পেইন্টিং বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করা এই শিল্পী ১৯৯৮ সালে প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী করেন রাঙ্গামাটি শিল্পকলা একাডেমীতে। ২০০৩ সালে তিনি দুইটি একক চিত্র প্রদর্শনী করেন। এপর্যন্ত ১০টিরও অধিক দলীয় শিল্প প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন।

অভিজ্ঞ এই শিল্পীর কাজের মধ্য দিয়ে পাহাড়ের প্রতি তার দ্বায়বোধ প্রস্ফূটিত হয়। শিল্পী ধনমনি চাকমার তুলিতে পাহাড়ের আবহমানকালের বিমূর্ত ভাবনাগুলো যেন মূর্ত হয়ে উঠে। তাঁর অনেক কাজেই দেখা যায় যে, জুম্ম নারীর কর্মক্লান্ত মুহুর্ত আদি অবয়ব নিয়ে ধরা দিতে চায় তার ক্যানভাসে। তিনি আঁকতে ভালোবাসেন ‘জুম’ আর ‘জুম্ম’ নারীর অবিচ্ছেদ্য বন্ধনকে। রঙ মাখেন বলিষ্ঠ সাহসে। হলুদের একটা ছড়াছড়ি আছে তাঁর রঙবিলাসে। সদ্যসমাপ্ত প্রদর্শনীতে তাঁর “রেস্ট” আর “জুম্মবী” শিরোনামের কাজগুলো তাঁর শিল্প অঙ্গীকার নিয়ে আমাদের বেশ উৎসাহী করে তোলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকাতার রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর্য নিয়ে পড়াশোনা করা শিল্পী লাভলী চাকমা পাহাড়ের অন্যতম সিনিয়র শিল্পী। ভাস্কর্য শিল্পে ঝোঁক দেখানো এই শিল্পী যেন পাহাড় থেকে নিয়ে আসা নির্যাস নিয়ে নিজেই নিজেকে ভাঙতে চান অন্য এক গড়ে নেওয়ার আকাঙ্খায়। অভিজ্ঞ এই ভাস্কর্য শিল্পী ১৯৯২ সালের হিল আর্টিস্ট গ্রুপের প্রথম প্রদর্শনী থেকে শুরু করে আজোবধি পাহাড়ের শিল্পের প্রতি তাঁর নিবেদন অব্যাহত রেখেছেন। এযাবৎ ১৫টিরও অধিক প্রদর্শনীতে তিনি শিল্পকর্ম প্রদর্শন করেছেন। “চাকমা অরনামেন্টস” নামে তাঁর একটি প্রকাশনাও আছে। সাহসী এই ভাস্কর তাঁর কাজের মাধ্যমে পাহাড়ের শিল্পকে প্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছেন আলোর যাত্রায়। তাঁর নিবেদন এবং অঙ্গিকার নিয়ে কোন সংশয় থাকার কথা নয়, উপরন্তু আমরা বাহবা দিতে বাধ্য হই বরঙ।

আলোচ্য প্রদর্শনীতে শিল্পীর কাঠনির্মিত ভাস্কর্য “আনটাইটেল” বা “শিরোনামহীন” কাজটিও আমাদেরকে কোন এক মমত্বমাখা খোদাইকার্যের ইঙ্গিত দেয়। ঠিকঠাক খোঁজ নেওয়া গেলে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শিল্প প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া এই শিল্পীকে হয়তো গুণী শল্পীদের কাতারে মাপতে চাইবেন অনেকে।

পাহাড় থেকে উঠে এসে শিল্পচর্চায় আগ্রহী হয়ে ওঠা সেইসব গুটিকয়েক স্বপ্নবাজ পাহাড়ি তরুণদেরই একজন শিল্পী রনেল চাকমা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় অধ্যয়ন শেষ করে তিনি এযাবৎ তিনটি একক চিত্র প্রদর্শনী করেছেন। ১০টিরও অধিক প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া এই শিল্পী এখনো রঙ-তুলি নিয়ে সমসাময়িকদের সাথে ঠিকে থাকার চেষ্টা নিরলসভাবে করে যাচ্ছেন ক্যানভাস আর শিল্পের প্রতি আবেগকে সম্বল করে। সদ্য সমাপ্ত প্রদর্শনীতে “ওয়েটিং”, “ম্রো ফেস্টিভেল” শিরোনামের কাজগুলো নিয়ে তাঁর ভাবনাজুড়ে মিশে থাকা পাহাড়ি জনপদের অকথিত কথনকেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তাঁর ছবিগুলোতে চমৎকার অঙ্গীকারকে লিপিবদ্ধ করে অযথা রঙের অপচয় না করেও তিনি তাঁর ভাবনাগুলো অনায়াসেই ফুটিয়ে তুলতে পারবেন বলে মনে করি।

পাহাড়ের সাম্প্রতিক সময়ের সম্ভাবনাময়ী শিল্পীদের একজন নান্টু চাকমা। বিভিন্নসময়ে বেশকিছু দলীয় প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের পাশাপাশি তিনি ২০০৯ সালে রাঙ্গামাটিতে একটি একক প্রদর্শনীও করেছিলেন। তাঁর কাজগুলোতে পাহাড়ের প্রতি নিখাদ মমতার চিত্র ফুটে উঠে। সেইসময় তিনি কেবল জলরঙের কাজ নিয়ে সাজিয়েছিলেন পুরো প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনীতে তাঁর চারটি চিত্রকর্ম তিনি হাজির করেছেন। খেয়াল করছি, শিল্পী নান্টু চাকমার তুলিতে গতি এসেছে, রঙ ব্যবহারে তিনি পরিণত এবং স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। তাঁর বিষয়বস্তুর গভীরে খোঁজ নিলে দেখা যায় সেখানে আস্ত একটা পাহাড় বসে আছে যেন! পাহাড়ের প্রতি নিখাদ ভালোবাসায় উদাসীন জীবন নিয়েই বোধহয় তিনি সাজাতে চান আরেক পাহাড়ের চুড়ো। পাহাড়ি ছড়ায় চপল জুম্ম নারীর নিবিড় কথোপকথনের মতোই তাঁর ছবির ক্যানভাসের মাঝেই তিনি ধরা দেন অন্য একটি চোখ নিয়ে, অন্য একটি অনুভূতি নিয়ে। ঘন-সবুজের কোলে ঐতিহ্যের চাঁদরে ঢাকা নিটোল পাহাড়ি গ্রাম কখনো কখনো তাঁর ছবির বিষয়বস্তু হয়, ঘুমিয়ে থাকা সারি সারি পাহাড়ের চিরন্তন মোহের টানে কখনো কখনো ছুট দেয় তাঁর দূরন্ত এবং ক্ষ্যাপাটে তুলি।

শিল্পী নান্টু চাকমার চিত্রকর্ম “রেইনিং ইন স্প্রিং”, এক্রিলিক।

জীবনবোধেও সাহসী উচ্চারণের দৃঢ়তা দেখানো এই শিল্পী মাঝে মাঝে ছিমছাম ক্যানভাসের উপরিভাগে নির্মাণ করেন নীল-সাদা-সবুজের লুকোচুরি। সেখানে মেঘেরা যদি ভেসে না বেড়ায়, তবে অস্তগামী সূর্যের খেয়ালিপণা নয়তো ভোরের নিষ্কলুষ হিমেল হাওয়ার স্বাদমাখা একটা সকাল আপনি খুজে নিতে পারবেন কখনো কখনো।

পাহাড়ের সরল এবং নিবিড় আলোছায়ায় তিনি গভীর মনযোগে খেলতে চান শিশুতোষ কৌতুহলে! কাজগুলো প্রাণবন্ত। সেন্স মেকিং। তাঁর কাজগুলোতে একটা প্রাণ আছে। সেই প্রাণ জাগিয়ে তুলতে তিনি তাঁর চেতনারই রঙ মাখেন হয়তো।

এইতো কদিন হলো জলরঙ ছেড়েছেন। এক্রিলিক মাধ্যমে তিনি নতুন ক্যানভাস নির্মাণ করার সাহস দেখাতে পারছেন, এটাই বা কম কীসে?? সদ্যসমাপ্ত হয়ে যাওয়া প্রদর্শনীতে শিল্পী নান্টুর “রেইনিং ইন স্প্রিঙ” শিরোনামের কাজটি দেখেই আপনার মনে হবে যে,

তুলি নিয়ে নিখুঁত অভিযান চালাতে তিনি সবকিছু ভুলে থাকতে পারবেন। গভীর মমতায় তিনি পাহাড়কে স্থান দেন ক্যানভাসে। তাঁর প্রতিশ্রতি এবং সাহসী অঙ্গীকার আমাদেরকে আশাবাদী করে বৈকি!

শিল্পী জয়দেব রোয়াজা দাদার সাথে সেভাবে ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। ক্যাটালগ পড়ে জানলাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “পেইন্টিং” -এ মাস্টার্স সম্পন্ন করা এই শিল্পী বেশকিছু দলীয় প্রদর্শনীর পাশাপাশি একক প্রদর্শনীও করেছেন। বিভিন্ন জায়গায় তিনি “পারফরমেন্স আর্ট” ও করে যাচ্ছেন নিয়মিত। গতবছরের হিল আর্টিস্ট গ্রুপের প্রদর্শনীতে যেয়ে তাঁর কাজের সাথে পরিচয় হওয়ার সুযোগ ঘটে। সেই থেকে তাঁর শিল্পভাবনাকে খেয়ালে রাখার চেষ্টা করেছি। বিনয়াবনত পর্যবেক্ষণের দাবি রেখেই বলতে চাই, পাহাড়ের শিল্পে যে সম্ভাবনা নতুন করে উঁকি দেয়, সে যাত্রায় জয়দেব দা অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেন অনায়াসেই। তাঁর কাজগুলো ভীষণ ভালো লাগে।

ভালো লাগার মতোন যে! তিনি কবে যে এত পরিণত শিল্পযাত্রা শুরু করেছেন তা আমরা অনেকেই খেয়ালও করতে পারি নি হয়তো। যাই হোক আমার মতো করেই আমি খুজে পেয়েছি যে, জয়দেব দা-র শিল্প ভাবনায় নিখাদ শিল্পের আনন্দ উপভোগ করার প্রবণতা আছে। অবশ্য পাহাড়ের গহীনে প্রবেশ করে তিনি বের করে নিয়ে আসেন আদি পাহাড়ের পাথরে মোড়ানো ছিপছিপে ছড়ার বহমানতা। কখনো তিনি আটকে থাকেন গুল্মরশ্মির শেকড়ে, সবুজ মিহি আগাছা হয়ে!গতির সাথে মিল রেখে কাঁচা সবুজের মিশেল তিনি নির্ধিদ্বায় ক্যানভাসে তুলে দিচ্ছেন। তার ভাবনায় সাহসী অঙ্গীকার আছে গহীন থেকে গহীনে প্রবেশ করার। তার ভাবনায় যেন সবসময়ই লুকিয়ে থাকে এক একটি “Haza Toisa”, এক একটি পাহাড়ি ছড়া।

কয়েকদিন আগেই তিনি জাপান থেকে পারফরমেন্স আর্টের একটা সফর করে আসলেন। পাহাড়ের শিল্পচর্চায় এই গুণী ও সম্ভাবনাময় শিল্পীর আন্তরিক যাত্রার প্রতি শুভ কামনা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার পরিচিত মুখ ভানরাম বম আমার স্কুলবন্ধু। রাঙ্গামাটির মোনঘরে পড়ার সময় আমরা তাঁকে ডাকতাম “আতে”, তাঁর ঘরোয়া নাম। নামটাও যে শিল্পমুখর!

চিত্রশিল্পী ভানরাম বম এর এক্রিলিক মিডিয়ার চিত্রকর্ম ‍”মিসআউট”

যতদূর জানি, বান্দরবানের রুমায় তাদের পুরো ফ্যামিলিটাই যেন একটা শিল্পের বন্ধন। যাই হোক, কাছের বন্ধু হিসেবে যতটুকু দেখেছি, আতের কাজে পরিপক্কতা আসছে। কবে কবে যেন জলরঙের খোলস ভেঙে ক্যানভাস বড় করার প্রয়াস পেয়েছেন!

বিভিন্ন মাধ্যমে তাঁর নিরীক্ষামূলক কাজগুলোয় বম জাতির উন্ন রুচি, মানবিকতা, অভিজাত সাংস্কৃতিক চৈতন্য, উঁচু সামাজিক মূল্যবোধের মানসপট ফুটে উঠছে যেন। হিল আর্টিস্ট গ্রুপের এবারের প্র্রদর্শনীতে তার “মিসআউট” শিরোনামের কাজটি তাঁকে অনেক উচ্চতর যাত্রায় সামিল হওয়ার আহবান জানাচ্ছে। বম, খুমী, ম্রোদের ব্যবহার্য পানি রাখার প্রাকৃতিক পাত্রগুলোর মাঝে হয়তো তিনি খুঁজে ফিরে পেতে চান,স্বতন্ত্র অনুভূতির স্বাদ। আতের শিল্পযাত্রা শুভ হোক!

পাহাড়ের আরেক নবীন শিল্পী জুলিয়ান এর কথা না বললেই নয়। ট্রাডিশনাল ক্যানভাসের পাশাপাশি জুলিয়ান কাজ করছে আধুনিক মাধ্যমগুলো নিয়ে। আমার স্কুল, কলেজ এবং বর্তমান ক্যাম্পাসেরও প্রিয়ভাজন অনুজ। প্রদর্শনীতে তাঁর “MN Larma” শিরোনামের মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার উপর করা কাজটি আমার দেখা তার কাজগুলোর মধ্যে সেরা বলা যায়। কেবল তারই নয়, আমার কাছে পুরো প্রদর্শনীটির অন্যতম সেরা কাজও এটি। নিখুঁত একটা প্রচেষ্টায় চেতনালব্ধ বুনন ফুটে উঠেছে এই কাজে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েল চারুকলায় অধ্যয়নরত এই নবীন শিল্পপথিক একাডেমিক শিক্ষার দক্ষতাকে পরীক্ষামূলক ভাবে প্রয়োগ করছেন এবং অবশ্যই আমাদেরকে আশান্বিত করছেন। “Winter” শিরোনামের গ্রাফিক্স এর কাজটি খুবই ভালো হয়েছে। সাহসী যাত্রা নিঃসন্দেহে। অনেক পরিণত লাগছে। জীবনবোধে শিল্পের প্রতি সততা রাখতে পারলে অনাগত আগামীতে শিল্পযাত্রায় এগিয়ে থাকবেন, এ বিশ্বাস আমি অবশ্যই করি। জুলিয়ানের চিত্রপটে বিষয়বস্তুর আয়োজনটা ভালো। রঙের ব্যবহারে বাহারি ঝলক আছে, তবে নিপুন হতে একটু সময় সে নিশ্চয়ই টানবে।

চিত্রশিল্পী জুলিয়ান বম এর শিল্পকর্ম “এম এন লারমা”

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় ভাস্কর্য বিভাগে অধ্যয়নরত অপর এক নবীন শিল্পী দিব্যআলো চাকমা বেশ প্রতিশ্রুতি নিয়েই শিল্পচর্চা শুরু করেছেন। সাম্প্রতিকসময়ে বিভিন্ন প্রদর্শনীতে তাঁর শিল্পকর্ম প্রদর্শন করছেন। এবারের প্রদর্শনীতে তিনি জলরঙের চারটি কাজ উপস্থাপন করেছেন। রাঙ্গামাটির বিখ্যাত বনরুপা বাজারের লঞ্চঘাট/জলঘাটতি-র গুরুত্ব রাঙ্গামাটির অর্থনীতিতে ব্যাপক। সেই সমতাঘাটের উপর করা তাঁর “সমতাঘাট” কাজটি রাঙ্গামাটির পাহাড়ি বাজারে পাহাড়ি ফসলের কথায় আমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাইবে।

জুমে উৎপাদিত ফসল নৌকাযোগে সমতাঘাটে নিয়ে আসে পরিশ্রমী জুম্ম নারী। জুম্মনারীর জীবনযুদ্ধে ঠিকে থাকার সেই নৌকাকে তিনি উপস্থাপণ করেছেন “বোট” শিরোনামের কাজেটির মাধ্যমে। এছাড়াও ইন্ডিজিনাস পিপল ১ ও ২ শিরোনামের কাজগুলোতেও মিশে আছে আদিবাসী জীবনের স্বাতন্ত্র। নবীন এই শিল্পীর তুলিতেও প্রতিশ্রতির মিশেল আছে বৈকি!

প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া অনেকের তুলিতেই গতি এবং প্রতিশ্রুতির মিশেল আছে, কিন্তু বিষয় নির্বাচনে কেউ কেউ খেই হারিয়ে ফেলছেন। আবার অনেকে বিষয়বস্তু ঠিকমতোন ধরতে পারলেও তার গভীরে যেতে পারছেন না। অনেকেই আবার দ্বিধান্বিত যেন রঙ মাখার যথার্থতা নিয়ে! ক্যানভাস, ফ্রেম এবং মাধ্যম বিষয়বস্তুর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা তাও খেয়ালে আসা উচিত।

অনেক চমকপ্রদ বিষয়বস্তু ভাবনায় আসছে, কিন্তু যথার্থ তুলি চালিয়ে, উপযুক্ত রঙ মাখানোর কাজ হয়তো করা যাচ্ছে না। সবকিছুর পরেও আমরা মোটাদাগে চিহ্নিত করবো প্রত্যাশিত “সম্ভাবনা”-কেই। অনেক প্রতিভাবান নবীন শিল্পীদের আগমনী রঙ পাহাড়ের ক্যানভাসে দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের শিল্পযাত্রায় তাঁদের অঙ্গীকার এবং প্রতিশ্রুুতি আমাদের জন্য খুবই স্বস্তিদায়ক।  এসবের দুর্বার আয়োজন চলতে থাকুক…

পাহাড়ের মেঘ, রোদ, হাওয়া, সবুজ, পাথর, ঝিড়ি, ছড়া, আলো-ছায়ার নিখুঁত ছাপ আমরা পাহাড়ের শিল্পীদের ক্যানভাসে উপভোগ করতে চাই। তাঁদের তুলিতে কোমল সৌন্দর্যের অর্ন্তমুখী আহবান থাকুক, নির্মল ব্যাপ্তি ছড়াক প্রত্যাশার রঙ। পাহাড়ের তেজোদীপ্ত সংগ্রাম, যুগান্তরের চেতনা, বঞ্চিত ইতিহাস এবং প্রতিরোধের বার্তাও উঠে আসুক আমাদের শিল্পীদের তুলিতে। শিল্পের প্রতি নিখাদ দরদ, বিশ্বাস এবং মনযোগ হয়ে উঠুক সময়ের “ক্রাইসিস”-কে উপলব্ধিতে নেওয়ার হাতিয়ার। তার যথাযথ প্রয়োগ ঘটুক শিল্পীদের মানসপটে, শিল্পভাবনায় এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনাচরণেও। সেই শিল্পবোধের প্রেরণা আমাদেরকে সাহস যোগাক সর্বত্র।

সিনিয়র শিল্পী কনকচাঁপা চাকমা, ধনমনি চাকমা, লাভলী চাকমা, রনেল চাকমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ কাজগুলোর সাথে সাথে জয়দেব দা-র কাজগুলোতে আমরা উপভোগ কললাম আলোছায়ার যাদু। নান্টুর কাজে পাওয়া যাচ্ছে নিবিড় অনুভূতি, ভানরাম-দিব্যআলোরা জানান দেয় স্বাতন্ত্র ও বৈচিত্রের, জুলিয়ান সেখানে সাহস দেখায় নতুন মাধ্যম নিয়ে, নতুন আঙ্গিকে, নতুন ক্যানভাসে কাজ করার। সবাইকে অভিনন্দন! আপনাদের তুলিতে বেঁচে থাকুক চুনীলালের শিল্পযাত্রার স্বপ্ন…

প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন প্রায় ২৭ জন নবীন-প্রবীণ শিল্পী। সীমিত জ্ঞানে সবাইকে আলোচনায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি।

জুলিয়ান বম, উদয়শংকর চাকমা, মিংকু চাকমা,  সাপু ত্রিপুরা, তিতাস চাকমা, নয়ন ত্রিপুরা, খিং সাই মং, নয়ন ত্রিপুরা, জয়তু চাকমা, লুম্বিনী দেওয়ান, এভলি চাকমা, সৌমিক দেওয়ান, নুমংসিং মারমা, তনিমা চাকমা, জেনিমং, মংখ্য সিং, নয়ন আলো চাকমা প্রমুখের কাজ প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে।

***লেখাটি ২০১৬ সালে জুমজার্নালে প্রথম প্রকাশিত হয়। পাঠকদের জন্য এখানেও তুলে ধরা হল..

জুম্ম তরুণের আড্ডাজুড়ে, “জুম”-ই থাকুক ঘুরে ফিরে

0

ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টের কারো একজনের টাইমলাইনে একটা প্রিয় চাকমা গানের লিরিক দেখলাম। খুব সম্ভব গানটি রণজিৎ দেওয়ানের।

“আমি এক ন্যুও জীংহানি গরিবোঙ,
আমি এক ন্যুও দিনোর পেগ অবং”

“আমরা এক নূতন জীবন গড়বো,
আমরা এক নতুন দিনের পাখি হবো”।

গানটি অনেকদিন ধরে শুনি না। কেবল এই গানটি নয় আরো কত কত সুন্দর সুন্দর চাকমা গান ইদানিং শোনা হচ্ছে না। কখনো গান শেখার সুযোগ হয়নি আমার, তবে আমার কাছের মানুষেরা জানে আমি কী রকম গানপাগলা মানুষ!! বন্ধু সার্কেলে হোক, ধোঁয়ার ধকলে হোক কিংবা পেগের পর পেগের আদলে হোক কোথাও কোন জমানো আড্ডা খুঁজে পেলেই আমি পারি না পারি গলা মিলাতে ভালোবাসি। ছোটবেলা থেকেই আড্ডাবাজ।

ছবি: নিউটন চাকমা

আমাদের গ্রামে “ফিবেক একাডেমী” নামে একটা স্থানীয় গানের তালিম নেওয়ার প্রতিষ্ঠান ছিলো। ফিবেক একাডেমীর আশেপাশেই আমরা প্রচুর আড্ডা দিতাম। সে সুবাদেই জানি, যারা চাকমা গানের উপর তালিম নেন, তারা এই গানটি অবশ্যই শিখেন! রাঙ্গামাটির বিভিন্ন স্থানীয় অনুষ্ঠানে শিশু শিল্পীরা এই গানটি প্রায়শই পরিবেশন করেন। গানটি আজ হঠাৎ করে আমার রাঙ্গাপানিতে ফেলে আসা আড্ডাময় কৈশোরিক বিকেলগুলোর কথা মনে করিয়ে দিলো।

কৈশোর কিংবা তারুণ্যের দিনগুলিতে আড্ডাই হচ্ছে সমস্ত ভাবনার প্রাণসঞ্চারকারী! এই আড্ডাগুলো থেকেই সৃষ্টি হয় কতকিছুর! গান হয়, কবিতা হয়, গল্প হয়, প্রেম হয়, বিরহ হয় আরো কতকিছুই তো হয়!! এই আড্ডাগুলোই ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের মনন গড়ে দেয়, ঠিক করে দেয় জীবনে চলার পথের নিশানা। ঢাকায় আসার পর থেকে ফেলে আসা রাঙ্গাপানির আড্ডাগুলো বেশ মিস করি। নটরডেম কলেজে পড়ার সময় বলতে গেলে, আড্ডাবাজি থেকে শ’হাত দূরে থাকতে হয়েছিলো।

ক্যাম্পাসে আসার পর থেকে বিপুল গতিতে আবার উদ্যম পাই আড্ডাবাজির! এখনো সারাদিন তৈ তৈ করে আড্ডাবাজি করে বেড়াই। আমার কেন জানি মনে হয় এই আড্ডাগুলোই আমাকে শেখায়, আমাকে ভাবায়….

পাহাড় থেকে অনেক জুম্ম শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য এখন ঢাকা শহরে অবস্থান করেন। জুম্ম শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ মেস বা ভাড়া বাসাবাড়িতে থাকেন। বিশেষত রাজাবাজার এলাকা, কাজীপাড়া-শেওড়াপাড়া-মিরপুর এলাকায় জুম্ম শিক্ষার্থীদের আনাগোনা বেশি। এগুলো বাদ দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, মোহাম্মদপুরের ট্রাইবাল হোস্টেল, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ইডেন মহিলা কলেজ, টিটিসি এবং বাসাবো বৌদ্ধ মন্দির এলাকায়; যেখানে আবাসিক সুবিধা আছে সেসমস্ত জায়গাগুলোতে জুম্ম শিক্ষার্থীরা অবস্থান করেন। সংগঠন করার সুবাদে উপরের সব এলাকা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেই কম বেশী যাওয়া-আসা হয়। খুব ভালো লাগে জুম্ম শিক্ষার্থীদের মধ্যকার পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা ও সংঘবদ্ধ থাকার প্রয়াসগুলো যখন চোখে পড়ে।

ঢাকায় আসার পর থেকেই জানতাম জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার বিপরীতে ন্যাম ভবনের সামনের রাস্তার আশেপাশে, খামারবাড়ি মোড়ের টিএন্ডটি মাঠ এলাকা প্রায় প্রতিদিনই প্রাণবন্ত থাকে জুম্ম তরুণ-তরুণীদের বৈকালিক শহুরে আড্ডায়। আবার আমাদের জগন্নাথ হলে একসাথে অনেক জুম্ম শিক্ষার্থীর অবস্থান থাকার সুবাদে প্রতিদিনই এখানে ভালো আড্ডা জমে ওঠে। অনেকসময় ক্যাম্পাসের বাইরে থেকেও জগন্নাথ হলে আমাদের অনেক বন্ধু-বান্ধবী এসে আমাদের সাথে আড্ডা জুড়ে দেন। কাছের ইডেন মহিলা কলেজ, বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ থেকে আসেন মেয়ে বন্ধুরা। হরেক বিষয়েই আলোচনা হয়। গালগপ্প হয়।কেন জানি আমার এই আড্ডাগুলোতে অনেকসময় “কী নেই” “কী নেই” বা কিছু একটা নেই টাইপের অনুভূতি হয়।

যখন নতুন নতুন হলে আসি, তখন জগন্নাথ হলের পুরাতন পূর্ব বাড়ি বিল্ডিং/সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য ভবনটি ছিল। আমরা জুম্ম শিক্ষার্থীরা থাকতাম – ৩২০, ৩২৩, ৩৭২, ৪৮৬ প্রভৃতি রুমগুলোতে। আর সিনিয়র-জুনিয়র আমরা সবাই মাঠে খেলাধূলা করে এসে একসাথে চা-নাস্তার আড্ডা জমিয়ে দিতাম হলের টেনিসকোর্টের একপাশে দক্ষিণবাড়ি লাগোয়া সিঁড়িটায়! আমরা জুম্ম শিক্ষার্থীরা সেখানে নিয়মিত বসতাম বলে হলের অন্যান্য শিক্ষার্থীরা সচরাচর কেউই সেখানে বসতো না।সবাই জানতো যে আমরা সেখানেই বসি। ঐক্যবদ্ধভাবেই!! গরম গরম পুড়ি, রঙ চায়ের সাথে আলোচনা জমে উঠতো। সিনিয়ররাই মূলত মধ্যমণি হয়ে থাকতেন। আমরা জুনিয়ররা হা করে থাকতাম আর মাথা নেড়ে যেতাম। সব আলোচনারই সর্বশেষ গন্তব্য হতো পার্বত্য চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম!! অবধারিতভাবেই!! এখনো বৈকি!!

লম্বা কোন ছুটিতে রাঙ্গামাটি গেলে ঘরে আমার একমুহূর্তও মন টিকে না। হয় কোথাও ঘুরতে বেড়োই নতুবা খুঁজে বেড়াই আড্ডার স্থল। রাঙ্গামাটি স্টেডিয়ামের গ্যালারিগুলোতে বিকেল হলে প্রতিদিন অনেক জুম্ম ছেলে-মেয়ের জটলা পড়ে। আবার সাম্প্রতিক সময়ে রাঙ্গামাটির আসামবস্তি ব্রীজেও অনেক ছোটবড় আড্ডার আসর চোখে পড়ে। বেশ বড় একটা পরিচিত সার্কেল আমার। তাই কোথাকার কোন আড্ডায় কী বিষয়ে জমে উঠছে আলোচনার খোড়াক…সেগুলো প্রত্যক্ষভাবেই পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ সাধারণত আমার হয়। সে সুবাদে জানি অধিকাংশ আড্ডাস্থলেই কমবেশি যে বিষয়গুলো আলোচনায় থাকে, “চিকু” , ক্ল্যাশ অব ক্ল্যান এর এ্যাটেক, সানি লিওন, ফেসবুক পিক আর স্ট্যাটাস, রক এন্ড মেটাল মিউজিক (ক্ষেত্রবিশেষে), ব্যাচ পিকনিক আয়োজনের প্রস্তুতি, বিসিএসের প্রিপারেশন প্রভৃতি! আমাদের প্রত্যহ জীবনের বিষয়গুলো, যা আমাদের জীবনের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিকভাবে জড়িত তা নিয়েই আমরা আড্ডা জমাই। তাহলে জুম্ম তরুণদের আড্ডাজুড়ে অন্যান্য যাই থাকুক না কেন কিঞ্চিৎ হলেও জুম পাহাড়ের কথা থাকাটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক।

কিন্তু আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ বলছে, পরিস্থিতি ভিন্ন! আমরা পাহাড়ের চলমান ঘটনাপ্রবাহগুলো থেকে এতটাই মুখ ফিরিয়ে রয়েছি যে, আমাদের আড্ডাগুলোই বলে দেয় – আমরা আপাদমস্তক কাঁদামাটিতে ডুবন্ত থেকেও তা অস্বীকার করে যাওয়ার ভ্রান্ত প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি মাত্র! অন্তত আমার ধারণা তাই!

শেকড়সন্ধানী জুম্ম তরুণদের পাঠ নিতে হবে শেকড়ের প্রতি অকৃত্রিম দ্বায়বদ্ধতার।

আমাদের আড্ডাগুলোতে কেন জানি চুনীলাল দেওয়ানের শিল্পসাধনা নেই, রণজিৎ দেওয়ানের গান নেই, কবি সুহৃদ চাকমার “বার্গী” কাব্যগ্রন্থ নেই, একসময়কার জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিলের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কথা নেই, একসময়কার জুমিয়া ভাষা প্রচার দপ্তর (জুভাপ্রদ)-র কথা নেই, গেংহুলী শিল্পীগোষ্ঠী বা গিরিসুর শিল্পীগোষ্ঠীর কথা নেই, “জুম্ম সংবাদ বুলেটিন” নামে পাহাড়ের সশস্ত্র সংগ্রাম চলাকালীন নিষিদ্ধ প্রকাশনার কথা নেই, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের মুখপত্র কেওক্রডঙের কথা নেই, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একসময়কার সাড়া জাগানো প্রকাশনা রাডার নেই, কাপ্তাই বাঁধে উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর কথা নেই, হারিয়ে যাওয়া গেংহুলীদের কথা নেই, কাউখালী গণহত্যায় নিহত তিন শতাধিক মানুষের কথা নেই, লোগাঙ গণহত্যার কথা নেই এমনকি সাম্প্রতিকতম ২০০৩ সালের মহালছড়ি সাম্প্রদায়িক হামলা, ২০১০ সালের বাঘাইছড়ির বুদ্ধপুদির কথা, খাগড়াছড়ি শহরজুড়ে সাম্প্রদায়িক হামলার কথা, মাটিরাঙ্গার তাইন্দং এবং নান্য়াচরের বগাছড়ির কথা নেই। সুজাতা ধর্ষণের বিচার হয়েছে কি? হয়নি, থুমাচিং মারমা কেন নিহত হলেন, বলিমিলে কেন মারা পড়ল তার খবর আমাদের আড্ডাই নেই। সাজেক, নীলাচল, নীলগিরি, চিম্বুক, বগালেক, কেওক্রডংসহ সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামটাকে যেভাবে পর্যটনের নামে গিলে ফেলা হচ্ছে তার কথা কে বলবে, তুমি আমি না বললে??? দীঘিনালায় বিজিবি ব্যাটালিয়ন ক্যাম্প স্থাপনের ফলে উচ্ছেদ হওয়া ২১টি পরিবারের কথা আমাদের আড্ডাগুলোতে স্থান নিলে কী আমাদের আড্ডাগুলো পঁচে যাবে?

৭০ দশককে বলা হয়ে থাকে, পার্বত্য চট্টগ্রামের রেঁনেসার যুগ। এ সময়েই সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারাটা বেগবান হয়েছে। কাপ্তাই বাঁধের আগ্রাসনে হঠাৎ নিঃস্ব হয়ে যাওয়া জুম্ম সমাজের মধ্যে প্রবল জাতীয়তাবোধ ও রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ হয়েছিল। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে সেসময়কার তরুণ ছাত্রসমাজ সমাজ পরিবর্তনে কান্ডারীর ভূমিকা নিতে পেরেছিলো। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। প্রায় সমসাময়িক ভাবে প্রতিষ্ঠা পায় পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ। মোনঘর শিশু সদন। পরবর্তীতে মোনঘর প্রতিষ্ঠানটিকে কেন্দ্র করে একঝাঁক সৃষ্টিশীল জুম্ম তরুণ গড়ে তোলেন জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিল। রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা, সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশ, শিক্ষার প্রসার সবদিকেই একটা জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতিফলন দেখা যায় এই দশকে। এই জাগরণটা বেশ কিছুকাল ধারাবাহিকও থেকেছে এবং তা সম্ভব হয়েছে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে জুম্ম তরুণ সমাজের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে। কী রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, কী সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, কী শিল্প-সাহিত্য ক্ষেত্রে সব জায়গাতেই তরুণদের স্বতঃস্ফূর্ত ও সক্রিয় অংশগ্রহণই ছিল এসময়কার সমাজ-রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের চালিকাশক্তি।

আমাদের মতোই সেসময়কার তরুণরাও হয়তো নানা জায়গায়-নানাবিষয়ে, নানাভাবে-নানাঢঙে-নানারঙে আড্ডা দিতো, গল্প জমাতো, আসর জমাতো। কাপ্তাই বাঁধ নিয়ে লেখা গানগুলো শুনলেই বোঝা যায় সেসময়কার তরুণদের আড্ডাজুড়ে এই বাঁধের প্রভাবটা কীরকম ছিলো!! মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাই বা কেন স্লোগান তুলেছিলেন “শিক্ষা নাও গ্রামে ফিরে চলো” অথবা “উচ্চমার্গীয় চিন্তা-সাধারণ জীবন” (Simple Living, High Thinking)। শিক্ষিত তরুণরা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে প্রাইমারি স্কুল গড়লো, অচল সমাজকে নাড়া দিতে থাকলো ধীরে ধীরে। জানেন তো, জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে পাহাড়ে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিলো সেটাকে অনেকেই বলে থাকেন হেডমাস্টার রেভ্যুলিউশন? জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সংগ্রাম চলাকালীন সময়টাতে জুম্ম সংবাদ বুলেটিন-এর মাধ্যমে রাজনৈতিক ঘটনাবলীর বিবরণ পাওয়া যেতো। আদামে আদামে চায়ের দোকানে, জুমো টুগুনে, দীঘোল লাঙেলোত, ফুলসুমোরি গাছের মিধে ছাভায়, ছড়াপাড়ে, হিজিঙে-হিজিঙে, লাল বইয়ের কথা, চেয়ারম্যান মাওর কথা কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো?

জন লেননের Imagine গানটি শুনেছেন? গানটি শুনতে থাকুন আর Imagine করুন। Only Imagine, যদি কিছু পান, তবে সেটা আপনার আড্ডায় যোগ করতে ভুলবেন না যেন!! Enemy at the Gates, মুভিটি অনেকেই দেখেছেন। সেখানে দেখানো হয়েছে যে, ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার বাহিনী যখন প্রচন্ড আঘাত হানতে হানতে রাশিয়ার লেলিনগ্রাড প্রায় দখল করে ফেলেছিল, সেসময় ক্রশ্চেভ রুশবাহিনীকে সামাল দিতে পারছিলেন না কোনভাবেই। হুকুম জারি করা হয় যদি কোন রুশ সেনা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানোর চেষ্টা করেন, তবে তাকে গুলি করে হত্যা করা। কঠোর সামরিক শৃঙ্খলা, জেনারেলদের উপর অত্যধিক চাপ প্রয়োগ সবকিছুই করার পরেও পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন আসছিল না। সমগ্র রুশ বাহিনীতে কেবল হতাশা, হতাশা আর হতাশা। চারিদিক থেকেই কেবল হতাশার খবর। রুশ প্রতিরোধ প্রায় বিপর্যস্ত। এমন সময়ে একটি আইডিয়া বাঁচিয়ে দেয় রুশ বাহিনীর অবশ্যম্ভাবী পরাজয় থেকে।

সেই আইডিয়ার নাম হচ্ছে “Hope”। আশাবাদী হওয়া। চারিদিক থেকে যখন পরাজয়ের, হতাশার খবর আসতে থাকে তখন এক রুশ সেনা একটি স্নাইপার নিয়ে জার্মান সেনা অফিসারদের উপর একের পর এক নিখুঁত আক্রমণ করতে থাকেন। পুরো রাশিয়ান বাহিনীতে সেই কাহিনীগুলো ফলাওভাবে প্রচার করা হয়। চারিদিকে এত এত হতাশার খবরে এই একটিমাত্র আশাজাগানিয়া/জয়ের/অর্জনের খবর পুরো রুশ সেনাবাহিনীকে চাঙ্গা করে তোলে। ধীরে ধীরে রাশিয়ানরা একটি স্নাইপার বাহিনী গড়ে তোলেন এবং একের পর এক জার্মান সেনা অফিসারদের কাবু করতে থাকেন। বদলে যেতে থাকে যুদ্ধক্ষেত্রের চিত্র। (স্মৃতি থেকে লেখা-বর্ণনায় ঈষৎ ভুল থাকতে পারে)

আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম সমাজেও আজ চারিদিকে কেবল হতাশা, হতাশা আর হতাশার খবর! এই বোন ধর্ষিত হচ্ছে, এই ভূমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে, এই পর্যটন কেন্দ্র, এই বিজিবি ক্যাম্প, এই সাম্প্রদায়িক হামলা!! তরুণদের মধ্যে এই নেই, সেই নেই, জুম্মবী বেজাতির সাথে পালিয়ে যাচ্ছে, গাভুজ্জ্যে নেশায় আসক্ত, পিসিপির কর্মীরা হেনতেন, রাজনৈতিক দলগুলো এমন তেমন। সুশীলরা এই সেই ব্লা ব্লা ব্লা ….

এই যে এত এত নেই, এত এত হতাশা তা কেবলমাত্র সমালোচনা করে পরিবর্তন সাধন করা যাবে না, সমাজপরিবর্তনে সর্বদা অংশীদার হতে হয় সক্রিয়ভাবে, রুশ স্নাইপারদের মতনই। নিরুপায়ের মতোই বলতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামের এমন হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতিতে আশার আলো সঞ্চার করতে জুম্ম তরুণেরাই একমাত্র ভরসা। নতুন একটি গান, নতুন একটি কবিতা, নতুন একটি উদ্যোগ, নতুন একটি কর্মসূচি, নতুন একটি বিশ্বাস এবং নতুন একটি আড্ডাই হোক সেই একমাত্র ভরসার নৌকা। এই নৌকায় পাত্তলী/হাল ধরার লোকজন যে খুব একটা নেই, সেও জানা কথা। তবু আমরা অনেক কিছু নেই এর ভীড়ে কিছু কিছু যা আছে সেগুলো নিয়েই স্বপ্ন দেখি, সেগুলো নিয়েই হোক আমাদের আড্ডাগুলো, সেগুলো নিয়েই হোক আমাদের প্রত্যহ জীবন, সেগুলো নিয়েই হোক আমাদের পথচলা………..

চেতনায় অবিরাম শেকড়ের টান-ই হোক জুম্ম তরুণের অণুপ্রেরণার উৎস। ছবি: রিকন দেওয়ান

দাবী করে বলতে চাই, পিসিপির নবীনবরণ কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে এখনো বেশ উঁচুমানের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা হয়ে থাকে। ঢাকা, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি কেন্দ্রিক বেশ কিছু প্রতিশ্রুতিশীল ব্যান্ড গড়ে উঠছে। জুম সায়েন্স, সিএইচটি অনলাইন ব্লগার এ্যান্ড এ্যক্টিভিস্ট ফোরাম প্রভৃতি নতুন নতুন সাইবার আইডিয়ার জন্ম হচ্ছে। গত তিন বছর ধরে বিঝুর সময়ে রাঙ্গামাটিতে তরুণদের উদ্যোগে চলচিত্র প্রদশর্নীর আয়োজন হচ্ছে। নিজেদের উদ্যোগেই আন্ডারগ্রাউন্ড মিউজিক্যাল শো হচ্ছে। পিসিপির প্রবল প্রতাপের যুগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিসিপির স্বতন্ত্র শাখা কার্যক্রম ছিলো না। এখন কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নয় পুরো ঢাকা শহরেই বেশ কয়েকটি ইউনিটে পিসিপির কর্মীরা কাজ করছে।

নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে ডকুমেন্টারি হচ্ছে, ফিল্ম হচ্ছে, ফটোগ্রাফী হচ্ছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে এই যে এই কিছু কিছু যা আছে সেগুলোতেই যদি আমরা আমাদের অংশগ্রহণগুলো জোরদার করতে পারি….দ্বায়িত্ব নিয়ে বলছি, যদি লাইগা যায় নয়, কেল্লাফতে অতি অবশ্যই হতে বাধ্য। Just try it man!!! Hurry…

যারা “আদাম্যে মেলা-মেব্বান”-এ কখনো গিয়েছেন, তারা অবশ্যই জানবেন কোন গ্রামে বিয়ের অনুষ্ঠান, সামাজিক-ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে গ্রামের যুবকরা কিরকম সামাজিকতাবোধের পরিচয় দেন। বলতে গেলে আমি বিভিন্ন জায়গায়তেই ঘুরে বেড়াই। সেসময় গ্রামের অর্ধশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে একধরণের প্রবল সামাজিকতাবোধ এবং জাতীয়তাবোধের প্রতিফলন আমি খেয়াল করি। একবার এক আদামে গিয়ে দেখলাম তরুণদের মোবাইলে মোবাইলে একটি কমন গান বাজছে। একটা বার্মিজ আন্ডারগ্রাউন্ড গেরিলা গ্রুপের ভিডিও ক্লিপ ইউটিউব থেকে ডাউনলোড করে দৃশ্যপট ঠিক রেখে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে বসানো হয়েছে কালায়ন দা’র একটা সংগ্রামী গান।

“ও ভেই গাভুর লগ বুরো ন ওয়ো-বয়জ
যেদক ওদঅ সাত মনান হাজা রাগেয়ো।”

কাজটি দেখলেই বোঝা যায় সেটি কাঁচা, কিন্তু আবেগ আর ভালোবাসায় ভরা। জন্মভূমির প্রতি এই দরদ ও মমত্ব নিয়ে যদি শহুরে শিক্ষিত তরুণরা এগিয়ে আসতেন কত আশা-জাগানিয়া কাজই তো হতে পারতো। আমাদের DSLR ওয়ালারা যদি তরুণীদের ফেসবুক প্রোফাইল বানিয়ে দেওয়ার চাইতে এভাবে সামাজিক-রাজনৈতিক চেতনার বিকাশে সহায়ক ফটোগ্রাফী-ভিডিওগ্রাফীতে মনযোগ দিতেন তবে নিশ্চয়ই তরুণদের ফেসবুকের ওয়ালে ওয়ালে কেবলই ঝুলে থাকতো “শিক্ষা নাও গ্রামে ফিরে চলো”! আমরা নিজেরাই এমন এক মনোজগৎ তৈরী করে নিচ্ছি যা আমাদের বাস্তবতার সাথে বেশ তফাতে অবস্থান করে। সেই মনস্তাত্ত্বিক জগৎটাকে ভাঙতে না পারলে সমাজ ভাঙার চেতনা আসবে কী করে? এই অচল মনোজগৎটাকে ভাঙতে আমাদের আড্ডাগুলোই হোক হাতিয়ার। আমিতো রাজনীতি করি। কিন্তু বন্ধু?? আড্ডাবাজি করতে আপনার রাজনীতি করা লাগে না, হুম? সেই প্রাণের আড্ডাটাই স্রেফ একটা শব্দ আর একটা স্বপ্ন লাগিয়ে নিও। শব্দটা হবে “জুম”, স্বপ্নটা হবে “জুমপাহাড়ের মুক্তি” ….

আমাদের জুম পাহাড়ের ভাঁজ চিরে শত শত বছর ধরে যে নিবিড় “সারাল্ল্যে আদাম” গুলো সেই আদামে আদামে বিপুল সংখ্যক তরুণ পড়ে আছেন দিশাহীন হয়ে। তারা অনেকেই জানেনই না যে তাদের অমিত সম্ভাবনার কথা। কিন্তু প্রকৃতির মাঝে নিরন্তর সংগ্রাম করে টিকে থাকার যে লড়াই, সে লড়াইটা তাদের রপ্ত করা থাকে প্রাকৃতিকভাবেই। হাজার ট্রেনিং এও প্রকৃতির শিক্ষা অর্জন করা যায় না, যদি প্রকৃতির সাথে মিশে থাকাটা না হয়। অন্যদিকে শহুরে শিক্ষিত তরুণরা পড়ে রয়েছে ভাবলেশহীন। এই শিক্ষিত তরুণদের পরিচয় হয়েছে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারণা আর তথ্য-প্রযুক্তির শক্তির সাথে। সমগ্র বিশ্বকে তারা বিশ্লেষণ করতে জানেন। তাই আদাম্যে গাভুজ্যদের সাথে শহুরে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে একটিবারমাত্র সংযোগটা যদি স্থাপন করা যায়, আমাদের আর ঠেকায় কে?

শাসক যত শক্তিশালীই হোক, শুধু আধোঘুম-আধো জাগরণ থেকে আমরা একবার জেগে দেখি, চোখ মেলে তাকাই ওই ফুরমোনটার দিকে, আলুটিলের দিকে আর কেওক্রডঙের দিকে, করণীয় কী তা খুঁজে পেতে সময় লাগে না আর!! গুণগুণিয়ে কখন যে গেয়ে ফেল…

“নাঙ তার, লারমা লারমা”

আদামে আদামে জুম পাহাড়ের প্রতি প্রচন্ড আবেগ আর দরদ নিয়ে জুম্ম ভাইয়েরা-জুম্ম বোনেরা, মায়েরা-বাপেরা পথ চেয়ে আছে, শহুরে শিক্ষিত তরুণরা আশা জাগানিয়া বার্তা নিয়ে রুক্কেঙ এর ভিতরে ফিরে যাবে, জুম পাহাড়ের বুকে ফিরবে স্বস্তির নিঃশ্বাস… আর আমরা সবাই মিলে গাইবো,-

“আমি এগ ন্যু জীংহানি গরিবোঙ,
আমি এগ ন্যুও দিনোর পেগ অবং”

***লেখাটি ২০১৫ সালের দিকে লেখা এবং প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল জুমজার্নাল এ।

মোনঘর, ৭০ দশক এবং জুম পাহাড়ের রেনেসাঁ

0

থেং-থেং, থেং-থেং, থেং-থেং
থেং, থেং, থেং, থেং, থেং, থেং, থেং, থেং…
থেএং, থেএএংং, থেএএএংং।

আবহমানকালের জুমপাহাড়ে তখন সবে ভোরের আলোক ফুটতে থাকে। আশা জাগানিয়া ভোরকে সাক্ষী রেখে রাঙামাটি শহরের পশ্চিম উপকন্ঠের এক কোণায় বহুবছর যাবৎ প্রতিদিন ঠিক এভাবেই রুটিন করে একটি ঘন্টা বেজে ওঠে। ঘন্টা’র উপর যখন শেষ বাড়িটি পড়ে “থেএএএএএংং”, সেই শেষ ধ্বনিটি মিলিয়ে যেতে না যেতেই বিশাখা ভবন, প্রজ্ঞা ভবন, সিদ্ধার্থ ভবন, জ্ঞানশ্রী ভবন, মৈত্রী ভবন, করুণা ভবন, আলোক ভবন, দীপ্তি ভবন, কৃঞ্চকিশোর ভবন, শান্তি ভবন থেকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সংহতি আশ্রিত কন্ঠে সমস্বরে ধ্বনিত হতে থাকে –

“বুদ্ধং স্মরণং গচ্ছামি
ধম্মং স্মরণং গচ্ছামি
সংঘং স্মরণং গচ্ছামি”

এরপরে তারা মনযোগ মাখানো কথামালায়, নিবিড় স্বতন্ত্র ধ্বনি এবং প্রবল আবেগের সুর মিশ্রিত শিহরণে গেয়ে চলে –

“আমা জাগা আমা ঘর
আমা বেগ’ মোনঘর
সুঘে-দুঘে ইধু থেই
বেক্কুন আমি ভেই ভেই”

বলছিলাম হিল চাদিগাঙ বা পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মোনঘরের কথা। উপরের কলিগুলো মোনঘরের প্রাতিষ্ঠানিক সংগীত যার বাংলা অর্থ –

“আমাদের জায়গা, আমাদের ঘর
আমাদের সবারই মোনঘর
সুখে-দুখে থাকি যেথায়
মোরা সবাই ভাই ভাই”

বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ও কবি সুগত চাকমা (ননাধন) রচিত ও বাবু ফনীন্দ্রলাল ত্রিপুরা সুরারোপিত এই গানটি প্রতিদিন ভোরে মোনঘর পড়ুয়া জুম্ম শিক্ষার্থীরা প্রাতঃসংগীত হিসেবে গায় এবং এর মাধ্যমেই ভোরের আলো ফুটার সাথে সাথে কর্মচঞ্চল হয়ে পড়ে পাহাড়ের কোলে নিবিড় আলোছায়ায় ঘেরা “মোনঘর শিশু সদন” ক্যাম্পাস।

“মোনঘর” কেবল একটি শিশু সদন বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, একটি চেতনার নামও বটে, আমিও সেই চেতনার এক গর্বিত গ্রাহক ও অংশীদার। প্রিয় মোনঘর, সশ্রদ্ধ প্রণতি! চাঙমা “মোন” এর বাংলা অর্থ পাহাড়। সাধারণভাবে মোন-এর উপর ঘর বা পাহাড়ের উপর ঘর-ই হচ্ছে “মোনঘর”। পাহাড়ের বহুল পরিচিত ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ কেন “মোনঘর” হলো তার পিছনে নিশ্চয়ই একটা যথার্থ ভাবনা বা ব্যাখ্যা নিহিত রয়েছে।

প্রসঙ্গত ফিরে যেতে হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং রাজনৈতিক ইতিহাস-এর নিকট। চেঙে, মেইনী, হাজলং, বরগাঙ (কর্ণফুলী), সাংগু, মাতামুহুরী, রেইংখ্যং, গোমতি, থেগা, সত্তা, শলক, সাজেক, মাজলঙ, সিজক প্রভৃতি ছোটবড় ছড়া/নদী বিধৌত পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐতিহাসিকভাবেই রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই তিনটি পার্বত্য জেলার সমন্বয়ে এক অখন্ড ও অবিচ্ছিন্ন ভৌগলিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিকাঠামোর সমষ্টি। এতদঅঞ্চলের ভৌগলিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সাংস্কৃতিক ও আবহমানকালের সামাজিক বিবর্তনের প্রেক্ষাপট এবং বিকাশের গতি ও ইতিহাস বাংলাদেশের মূল ভূ-খন্ডের সামগ্রিক বিবর্তন ও বিকাশের ইতিহাস, গতি এবং বৈশিষ্ঠ্য থেকে বহুদিক দিয়েই ভিন্ন ও স্বতন্ত্র।

ঐতিহাসিককাল থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করছে পাংখো, খুমী, লুসাই, মুরং, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, খেয়াং, চাক, ত্রিপুরা, চাকমা প্রভৃতি ছোট ছোট আদিবাসী জাতিসমূহ যাদের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ভাষা-ধর্ম, সামাজিক প্রথা ও রীতিনীতি। বৈচিত্রময় ভাষা-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ এসব ছোট ছোট জাতিসমূহের মধ্যে বলিষ্ঠ সামাজিক মূল্যবোধ এবং প্রথাভিত্তিক নিজস্ব আইন-কানুনও প্রচলিত রয়েছে। বিভিন্ন দিক দিয়ে প্রত্যেক জাতির নিজস্বতা ও বৈচিত্র্য থাকলেও ছোট ছোট এই জাতিসমূহের মধ্যে একটা সাধারণ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আর তা হচ্ছে জুমচাষ। “জুম” এবং “জুমচাষ”-কে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এসব জাতিসমূহের জীবন-জীবিকা, প্রথা-বিশ্বাস, রীতি-নীতি, কৃষ্টি-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ।

সামাজিক মূল্যবোধ, রীতিনীতি এবং প্রচলিত আইন-কানুন সবকিছুর মূলেও নিহিত রয়েছে জুম ও জুমচাষ ভিত্তিক জীবন-প্রণালী এবং সমাজ-সাংস্কৃতিক কাঠামো। পাহাড়ের উপর জুমচাষের মাধ্যমেই এসব জাতিসমূহ যুগ যুগ ধরে হিল চাদিগাঙ বা পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে বাধ্য সন্তান হয়ে প্রকৃতির সাথে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐতিহাসিককাল থেকেই ছোট ছোট এই ১১টি জাতির আবাসস্থল। এছাড়াও বর্তমানে কিছু অহমিয়া বা আসাম, গুর্খা এবং সাঁওতাল বসতি-র সন্ধানও পাওয়া যায় পার্বত্য চট্টগ্রামে। তাদেরকে হিসেবে ধরলে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৪টি আদিবাসী জাতির বসবাস রয়েছে।

যাই হোক, পার্বত্য চট্টগ্রামে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাস করা ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষী এই ছোট ছোট আদিবাসী জাতিগুলো পাহাড়ের উপর জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। জুমচাষ করতে হয় পাহাড়ে। জুমচাষীরা পাহাড়ে যে জুম করে সেই জুমকে দেখাশোনা করা, ফসল এর মৌসুমে ফসল সংগ্রহ প্রভৃতির জন্য অস্থায়ী একটি ঘর তৈরী করা হয়। এটাই হচ্ছে মোনঘর। এখানে বলাবাহুল্য যে স্থায়ী বসতির জন্য “জুমঘর” বা “মোনঘর” নির্মাণ করা হয় না, কেননা জুম এর ফসল তোলার কাজ শেষ হয়ে এলেই জুমচাষী “জুমঘর” বা “মোনঘর” থেকে নিজের গ্রামে ফিরে আসেন। জুম করা হয় গ্রামের কিছুটা দূরে। উর্বর ভূমি চিহ্নিত করে ঘন বাঁশঝার বা নিবিড় বনজঙ্গল সাফ করে গ্রামের অদূরে জুম চাষ করা হয়। চৈত্র মাসের (ইংরেজী এপ্রিল) শুরু বা মাঝামাঝিতে জুম চাষের জায়গা নির্বাচন করে তা পরিষ্কার করা হয়। কেটে ফেলা বনজঙ্গল চৈত্র মাসের শেষদিকে আগুনে পোড়ানো হয়।

বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসের দিকে জুমভূমি ফসল বুনার জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠে। এসময় জুমে ফসল বুনা হয়। আষাড়-শ্রাবণে জুমে নিড়ানি দিতে হয়, এসময় জুমে নতুন ফসলকড়ি আসতে থাকে। শতাব্দীর চিরহরিতে যেন মুড়িয়ে যায় প্রিয় জুমভূমি। ভাদ্র-আশ্বিন মাস জুম থেকে ফসল তোলার মৌসুম। পাকা ধানের সোনালী আভায় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে প্রিয় জুমপাহাড়। দখিনা মৃদু হাওয়ায় দুলতে থাকে নানান শস্য। হরেক রকম শস্যে ভরে থাকা জুমে তখন জুমচাষীরা মনের সুখে প্রকৃতির সাথে কথোপকথন জমিয়ে দেয়। ঐতিহ্যবাহী নানান গানের সুর ধরে জুম্ম রমণিরা। সব কষ্ট ভুলে ফসলের আগমনে মন জুড়িয়ে যায় জুমচাষীর।পাহাড়ে পাহাড়ে তখন ধ্বনিত হতে থাকে হেঙগরঙ, ধুধুক, শিঙে বা পুলুঙ এর সুর ও তাল। জুমচাষের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জুমে সাময়িক বা অস্থায়ীভাবে নির্মিত জুমঘরকেই চাঙমা ভাষায় মোনঘর বলা হয়ে থাকে।

এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, ১৮ শতকে ক্যাপ্টেন টি. এইচ. লুইন যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসক ছিলেন, তিনি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন – পার্বত্য চট্টগ্রামের ছোট ছোট জাতিসমূহের মধ্যে সংখ্যার বিচারে অধিক চাঙমারা বসবাস করে পাহাড়ের পাদদেশে ছড়ার ধারে। ঠিক সেভাবেই মারমা, তঞ্চঙ্গাদের গ্রামগুলোও গড়ে উঠে নদী বা ছড়াকেন্দ্রিক। তাই গ্রাম থেকে জুম কখনো কখনো অনেক দূরে হয়। সবকিছুর সুবিধার্থে ফসল আহরণ পর্যন্ত জুমে একটা অস্থায়ী ঘর নির্মাণ করে সেখানে কিছুদিনের জন্য বসবাসও করতে হয় কখনো কখনো।

এটাই চাঙমা ভাষায় মোনঘর বা জুমঘর। লুসাই, খেয়াং, খুমী, ম্রো, বম প্রভৃতি জাতিসমূহ তুলনামূক উঁচু পাহাড়ে গ্রাম গড়ে তুলে। ম্রো’রা সবথেকে উঁচু পাহাড়গুলোতেই সাধারণত বসবাস করে। কিন্তু তারাও গ্রাম থেকে অদূরেই জুম তৈরী করে। তাই জুমঘর বা মোনঘর এর “কনসেপ্ট” বা ধারণাটা সবার ক্ষেত্রেই মূলত একই। ত্রিপুরারা জুমকে বলে হোওক এবং জুমঘরকে বলে গাইরিঙ। মারমারা জুমকে বলে ওয়া। ম্রো’রা জুমকে বলে উহয়া। এভাবেই প্রত্যেকটি জাতি জুম এবং জুমঘরকে আলাদা আলাদা নামে ডাকলেও জুম এবং জুমঘরের সাথে ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক বন্ধন এর স্বরুপ প্রত্যেকটা জাতির ক্ষেত্রেই এক এবং অভিন্ন। বস্তুগত এবং আধ্যাত্মিক উভয় দিক থেকেই জুম এবং জুমঘরের সাথে জুম্মদের জনজীবন নিবিড় যোগাযোগ ও বন্ধনে জড়িয়ে থাকে।

কাঠামো এবং চেতনা উভয়দিক থেকেই পার্বত্য অঞ্চলের বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান “মোনঘর” এর নামকরণও ঠিক এরকম ধারণা থেকেই। জুমে যেভাবে একসাথে হরেক রকমের ফসল চাষ করা হয়, সেভাবেই মোনঘর শিশু সদন-এ পার্বত্য চট্টগ্রামের নানা ভাষাভাষী শিশুরা বড় হয়ে ওঠে একে অপরের সাথে নিবিড় আত্মীয়তার সম্পর্কে। সেখানে প্রয়োজনীয় পড়াশুনার পাশাপাশি তারা খুঁজে পায় ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন এবং সমাজ ও জাতীয় জীবনে বিকশিত হওয়ার শিক্ষা। এখানে বম, খুমী, মুরং বা ম্রো শিশুর সাথে পাশপাশি বেড়ে ওঠে ত্রিপুরা, চাকমা বা মারমা শিশু। খেয়াং মেয়ের সাথে খেলা করে পাংখোয়া মেয়ে। চাক ছেলের সাথে ভাব জমায় লুসাই ছেলে।

ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের নিবিড় মমতায় পাঠদান করছেন পদ্মা দিদিমনি। ছবি: লেখক

কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, এই প্রতিষ্ঠান কচি কচি জুম্ম শিক্ষার্থীদের মৌলিক মূল্যবোধ গঠন এবং মনন গড়ে তুলতেও প্রয়োজনীয় শিক্ষা দেয়। মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ হওয়ার অণুপ্রেরণা যোগায়।

জীবনাচারে শৃঙ্খলা, ন্যায়, ঐক্য ও সংহতি কেন প্রয়োজন সেই বোধ জাগিয়ে তুলে মোনঘর। মোনঘর স্বপ্ন বুনে এবং চেতনার রঙ ছড়িয়ে দেয় এক পাহাড় থেকে আরেক পাহড়ে, এক জুম থেকে আরেক জুম এ, সমগ্র হিল চাদিগাঙ জুড়ে। মোনঘর এর এ পথচলা অবিরাম গতিশীল থাকুক।

মোনঘর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৪ সালে। খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলাধীন “পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম” এর প্রতিষ্ঠাতা সদ্ধর্মাদিত্য শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথেরোর তিন গুণধর শিষ্য তথা পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা, ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের তিন আলোকবর্তিকা শ্রীমৎ বিমলতিষ্য মহাথের,

শ্রীমৎ প্রজ্ঞানন্দ মহাথের এবং শ্রীমৎ শ্রদ্ধালংকার মহাথের অসীম ধৈর্য ও কঠোর পরিশ্রমে তিলে তিলে পাহাড়ে শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে বাতিঘর এই প্রতিষ্ঠানটিকে গড়ে তুলেন।

প্রসঙ্গত, এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পাহাড়ের এই তিনজন শিক্ষাদূত একাধারে শিক্ষাবিদ, সমাজহিতোষী ও সমাজসংস্কারক এবং ধর্মীয় গুরু। তিনজনেই সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছেন পার্বত্য ভিক্ষু সমাজকে। ১৯৫৮ সালে রাজগুরু প্রয়াত অগ্রবংশ মহাথেরর হাতে প্রতিষ্ঠিত “পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ” পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিক্ষু সমাজকে সংগঠিত করে সমাজজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার ক্ষেত্র তৈরী করে দিয়েছিলো। শ্রীমৎ বিমলতিষ্য মহাথের, প্রজ্ঞানন্দ মহাথের এবং শ্রদ্ধালংকার মহাথের মহোদয় বিভিন্ন সময়ে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘকে নানাভাবে সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশ-বিদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সমাজ এবং অবহেলিত, বঞ্চিত আদিবাসী মানুষের কথা তুলে ধরতেও এই তিনজন মানবহিতৈষীর আত্মত্যাগ পাহাড়ের আপামর জনমানুষের হৃদয়ে নিশ্চয়ই চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।

ঢাকা’র বনফুল শিশু সদন, ভারতের কলকাতার বোধিচারিয়া স্কুল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন যথাক্রমে প্রজ্ঞানন্দ মহাথের এবং বিমলতিষ্য মহাথের। শ্রদ্ধালংকার মহাথের রাঙ্গামাটির ভেদভেদীতে গড়ে তুলেছেন সংঘারাম বৌদ্ধ বিহার। তিনি একাধারে চাকমা ভাষা ও বর্ণমালা বিশারদও বটে। পার্বত্য চট্টগ্রাম একসময় ব্রিটিশ শাসনাধীন ছিলো। সেসময় ব্রিটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি-১৯০০ প্রণয়ন করে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে শাসন বহির্ভূত এলাকা (Excluded Area) হিসেবে মর্যাদা দেয়। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশরা চলে যায় এবং অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তানের সাথে অর্ন্তভূক্ত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সেসময়কার সামন্তীয় নেতৃত্ব পরিস্থিতির দাবী অনুযায়ী সঠিক ভূমিকা রাখতে না পারায় ছোট ছোট আদিবাসী জাতিসমূহের ভবিষ্যত বিকাশের পথ অনেকটা সংকটের মুখে পড়ে যায়। অস্তিত্বের সংকটে নিমজ্জিত জুম্ম জনগণকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টায় সেসময় স্নেহকুমার চাকমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের যুবকরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে এবং অমুসিলম অধুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের সাথে সংযুক্তির দাবী জানায়। তারা রাঙ্গামাটি শহরে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে দিয়ে ভারতীয় পতাকাও উত্তোলন করে। অবশ্য এসকল প্রচেষ্টা যথাযথ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয় কেননা পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ তখন অশিক্ষা-কুশিক্ষা এবং অন্ধকারে নিমজ্জিত পিছিয়ে পড়া ঘুমন্ত অসহায় সমাজে বসবাস করছে।

হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়, অনিশ্চিত জীবন নিয়ে পাড়ি জমায় পার্শ্ববর্তী ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা এবং অরুনাচল প্রদেশে। ধ্বংস হয়ে যায় সমৃদ্ধ একটি জনপদ। বদলে যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সম্পূর্ণ ভূ-প্রকৃতি এবং জনমিতি। পুরনো রাঙ্গামাটি শহরকে মনে করে চাকমা রাজপরিবারের সদস্য এবং রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের তৎকালীন প্রভাষক কুমার সমিত রায় আক্ষেপের আবহে লিখেছেন –

হেল্লে আধিক্যে স্ববনে দেকখোং
পুরোন রাঙামাত্যে
তুত্তে বোইয়ের বার, শিমেই তুলো উড়ি যার
স্ববনে দেকখোং বরগাঙর পার।

(গতকাল হঠাৎ স্বপ্নে দেখলাম পুরাতন রাঙামাটি
প্রবল এলোবাতাসে শিমুলতুলা উড়ে যায়, স্বপ্নে দেখলাম বরগাঙ এর পার)

এরপরের কলি –

ভাজি উট্টে ভুইয়ানি, ভাজি উট্টে ঘরান মর
চিগোন কালর সমাজ্জেগুন বালুচরত খারা অদন

(ভেসে উঠেছে ধানখেতগুলো, ভেসে উঠেছে ঘরটি আমার
বালুর চরে খেলা করে ছোট্টবেলার সাথীরা আমার)।

পার্বত্য চট্টগ্রামের গণমানুষের জন্য মরণফাঁদ সর্বগ্রাসী কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে সেসময় জনমত গড়ে তুলে তার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা প্রয়াত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। ১৯৭২ সাল, সবে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ণের সময় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংবিধানে জুম্ম জনগণের বেঁচে থাকার জন্য সাংবিধানিক অধিকার চাইলেন। লারমার দাবীকে প্রত্যাখ্যান করা হলো। জুম্ম জনগণের ভবিষ্যত আরেকবারের জন্য অনিশ্চয়তা ও সংকটের দিকে ধাবিত হলো। এমন বাস্তবতায়, ১৯৭২ সালে এম এন লারমা, বীরেন্দ্রকিশোর রোয়াজা, জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) প্রমুখ এর নেতৃত্বে গড়ে উঠে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। সমিতির নেতারা নেমে পড়লেন জাতীয় সংগ্রাম গড়ে তোলার কাজে। গ্রামে গ্রামে প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হলো। সামন্তীয় বেড়াজালে অথর্ব হয়ে পড়ে থাকা জুম্ম জনসমাজকে জাগিয়ে তোলার জন্য সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম চষে বেড়ালেন জনসংহতি সমিতির নেতারা। সমগ্র জুম্ম সমাজে সংগ্রামী এক নতুন দিনের আশা। দিকে দিকে আন্দোলনের কথা ছড়াতে লাগলো।

এভাবেই আমরা দেখি ৭০ দশকে জুম্ম জাতীয় জীবনে সবদিক থেকেই এক নবদিগন্তের সূচনা হয়। ৭০ দশককে বলা হয়ে থাকে, পার্বত্য চট্টগ্রামের রেঁনেসার যুগ। এ সময়েই সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারাটা ভিত্তি পেয়েছে এবং সঠিক প্রবাহে গতিশীল থেকে বেগবান হয়েছে। কাপ্তাই বাঁধের আগ্রাসনে হঠাৎ নিঃস্ব হয়ে যাওয়া জুম্ম সমাজের মধ্যে প্রবল জাতীয়তাবোধ ও রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ হয়েছিল। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে সেসময়কার তরুণ ছাত্রসমাজ সমাজ পরিবর্তনে কান্ডারীর ভূমিকা নিতে পেরেছিলো। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। প্রায় সমসাময়িক ভাবে ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠা পায় মোনঘর শিশু সদন।

পরবর্তীতে মোনঘর প্রতিষ্ঠানটিকে কেন্দ্র করে জড়িয়ে থাকা একঝাঁক সৃষ্টিশীল জুম্ম তরুণ গড়ে তোলেন জুম ঈসথেটিক কাউন্সিল। ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত জুম ঈসথেটিক কাউন্সিল বা জাক পার্বত্য চট্টগ্রামের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশে অপরিসীম ভূমিকা রাখে। রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা, সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশ, শিক্ষার প্রসার সবদিকেই একটা জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতিফলন দেখা যায় এই দশকে। এই জাগরণটা বেশ কিছুকাল ধারাবাহিক থেকেছে এবং তা সম্ভব হয়েছে অতিঅবশ্যইভাবে জুম্ম তরুণ সমাজের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে। কী রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, কী সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, কী শিল্প-সাহিত্য ক্ষেত্রে সব জায়গাতেই জুম্ম তরুণদের স্বতস্ফূর্ত ও সক্রিয় অংশগ্রহণই ছিল এসময়কার সমাজ-রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের চালিকাশক্তি।

বলাই বাহুল্য যে, লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মাধ্যমে শুরু হওয়া রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামের সমান্তরালে ৭০ দশকে “মোনঘর” এর যাত্রা শুরু হয়েছিলো শিক্ষা-সাহিত্য-সমাজ-সাংস্কৃতিক রেঁনেসার ভিত্তিভূমি হিসেবে। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে যে, দীঘিনালায় বোয়ালখালী পার্বত্য চট্টল অনাথ আশ্রমে থাকাকালীন সময়ে মোনঘর এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শ্রীমৎ প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরর সরাসরি শিক্ষক ছিলেন শ্রী সন্তু লারমা। এম এন লারমা এবং সন্তু লারমা উভয়েই বেশ কিছুকাল দীঘিনালা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছিলেন। এক অর্থে বলা চলে মোনঘরকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল জুম ইসথেটিক কাউন্সিল বা জাক। জাক এর প্রথম নাম ছিলো রাঙ্গামাটি ঈসথেটিক কাউন্সিল। জাক প্রতিষ্ঠার মূলে যারা ভূমিকার রেখেছিলেন তাদের অধিকাংশই সরাসরি মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন এবং এখনো অনেকে আছেন। মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮০ সালে।

“বার্গী” কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা কবি সুহৃদ চাকমাকে আধুনিক চাকমা কবিতার জনক বলা যেতে পারে। তিনি ছিলেন মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়ের অন্যতম স্তম্ব। চাকমা সাহিত্যের বিকাশের ধারায় তিনি নতুন অনেক কিছুই যোগ করেছেন। ভাষা নির্মাণ, বিষয়বস্তু, শব্দশৈলীতে নতুনত্ব এনে চাকমা কবিতা রচনাক্ষেত্রে তিনি নিয়ে এসেছিলেন নতুন গতি ও স্টাইল। পার্বত্য চট্টগ্রামের গানের জগতে জীবন্ত কিংবদন্তি শিল্পী রণজিৎ দেওয়ান, আধুনিক চাকমা সাহিত্যের অন্যতম পথিক কবি সুহৃদ চাকমা,“গাঙ’-র নাঙ লোগাঙ” কবিতার রচয়িতা কবি মৃত্তিকা চাকমা, “হিল চাদিগাঙর পজ্জন” শোনানো সংস্কৃতিকর্মী ঝিমিত ঝিমিত চাকমা, “তে এব” কাব্যগন্থের রচয়িতা কবি শিশির চাকমা এরা সবাই মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়ের সরাসরি শিক্ষক ছিলেন এবং এখনো অনেকে আছেন।

একদিকে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রাম অন্যদিকে মোনঘর, পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বা পরবর্তীতে জুম ইসথেটিক কাউন্সিল এর মাধ্যমে ধর্ম-শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা প্রায় সমান্তরালেই প্রবাহিত হতে পেরেছিলো বলেই ৭০ আর ৮০-র দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সবদিক থেকেই একটা জাতীয় জাগরণের বীজ রোপিত হতে পেরেছিল।

যাই হোক, যেমনটা বলছিলাম – মোনঘর কেবল একটা শিশু সদন নয়, একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। মোনঘর একটি চেতনার নাম, জুম্ম জাতীয় জীবনের চেতনার বাতিঘর। পার্বত্য চট্টগ্রামের এমন কোন উপজেলা নেই যেখান থেকে এই প্রতিষ্ঠানে গরীব-ছিন্নমূল ও অসহায় জুম্ম ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে না। নাইংক্ষ্যংছড়ির চাকপাড়ার চাক শিশু, থানছি-র ম্রো পাড়ার ম্রো শিশু, রুমার কোন জুমিয়া বম পরিবারের সন্তান, রোয়াংছড়ির মারমা মেয়ে, বিলাইছড়ির পাংখোপাড়ার পাংখো ছেলে, চন্দ্রঘোনার খেয়াং ছেলে কিংবা থেগা-সত্তা পারের চাঙমা জুমিয়া ঘরের সন্তান অথবা মহালছড়ির ‘রুক্কেং’ বা দীঘিনালার ‘ফাগন্দি ভুই’ চাষী ঘরের অনাথ ছেলে, সকল ছিন্নমূল- গরীব ও অসহায় জুম্ম শিশুদের জন্য যেন নিরাপদ এক আশ্রয়স্থল এই মোনঘর।

মোনঘর প্রতিষ্ঠানটির কাঠামোগত নির্মাণটা নাকি গড়া হয়েছিলো কলকাতার রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতনের আদলে। সত্যিই, ফুরমোনের পূর্ব পাদদেশ হয়ে নেমে আসলে রাঙামাটি শহরের এককোণায় ছায়া নিরিবিলি পরিপাটি সুন্দর একটি গ্রাম রাঙাপান্যের বুক জুড়ে প্রতিষ্ঠিত মোনঘর ক্যাম্পাসটি যেন প্রকৃত অর্থেই এক শান্তির আবাসস্থল। পুরো মোনঘর ক্যাম্পাসটি ঘিরে রেখেছে নানা প্রজাতির বৃক্ষের সমারোহ। কৃঞ্চচুড়া, বড় বড় কাঠাল, আম, নিম, কড়ই, মেহগনি, বহেরা, চামার, হরিতকি প্রভৃতি বৃক্ষে ছেয়ে যাওয়া মোনঘর শিশু সদন ক্যাম্পাসটিতে বিদ্যালয়ভবন, খেলার মাঠ, বড় একটি পুকুর ছাড়াও রয়েছে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আবসিক ভবনসমূহ। জ্ঞানশ্রী, প্রজ্ঞা, দীপ্তি, মৈত্রী, করুনা প্রভৃতি ভবনগুলোর নাম দেখলেই বোঝা যায় পরম করুণাময় বুদ্ধের মৈত্রীময় দর্শনও এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম একটি দর্শন।

মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ছবি: নান্টু চাকমা

মোনঘরে আমি পড়াশুনা করেছিলাম ১৯৯৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত। আমি আবাসিক এবং অনাবাসিক উভয়ভাবেই মোনঘর এর শিক্ষার্থী ছিলাম। কিছুদিনের জন্য ছিলাম সেসময়কার মোনঘরের শাখা স্কুল বলে পরিচিত ঢাকাস্থ বনফুল শিশু সদনেও। মোনঘর নিয়ে এবং মোনঘরকে ঘিরে ভালো মন্দ হাজারো স্মৃতি আমার মানসপটে এখনো নিত্য খেলা করে বেড়ায়। আমার সমগ্র জীবনবোধে মোনঘরে পড়াকালীন ভালো-মন্দের মিশেলে গড়া অভিজ্ঞতাগুলোই সঞ্চিত পুঁজি যা বিনিয়োগ করে আমি কর্ষণ করে যেতে চাই আমার নিজের জুম।

প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষিকার সাথেই আমার কমবেশি ব্যক্তিগত নৈকট্য বা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো, যদিও আমি স্বভাবসুলভ ভালো বা মেধাবী ছাত্রদের মতোন শৃঙ্খলাপরায়ন বা নিয়মিত ছাত্র ছিলাম না বা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অত্যধিক ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতাম না।তারপরেও কেন যেন মোনঘরের সকল শিক্ষক-শিক্ষিকারা আমাকে স্নেহ করতেন, আমার যত্ন নিতেন। সেই ছোটবেলা থেকেই আমায় স্নেহ করতেন প্রয়াত কবি সুহৃদ চাকমার সহধর্মীনি অর্চনা দিদিমনি। প্রচন্ড ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী এই শিক্ষিকার স্নেহ আমার স্কুলজীবনের এক বড় প্রাপ্তি।

পাহাড়ের জীবন্ত কিংবদন্তি শিল্পী রণজিৎ দেওয়ান স্কুরবেলাই কেবল নয়, এখনো পর্যন্ত আমার অন্যতম বড় মেন্টর। ক্লাশ নাইন এ উঠার পরে বিজ্ঞান, কলা এবং ব্যবসায় শিক্ষা যেকোন একটি বিভাগ পছন্দ করতে হয়। আমি নাইনে উঠলে বেছে নিয়েছিলাম কলা বিভাগ, কেননা আমি গৈরিকা দিদিমনির কাছে ইতিহাস শিখতে চেয়েছিলাম। দীপ্তা দিদিমনি পড়াতেন ভূগোল। বিএসসি স্যার বা অমল তালুকদার স্যারকে মোনঘরের ছাত্ররা খুবই ভয় পেতেন। একবার তিনি হঠাৎ আমাকে বিজ্ঞান বিভাগের ল্যাব কক্ষে ডেকে পাঠালেন। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। যেয়ে ভয়ে ভয়ে বললাম, স্যার আসতে পারি? চেয়ারে বসিয়ে আমার জীবন গঠনের জন্য যেসব উপদেশ এবং নির্দেশনা দিলেন কোনদিন ভুলব না। মৃত্তিকা স্যার পড়াতেন বাংলা। একবার ক্লাশ শেষে তিনি যখন ক্লাশ থেকে বেরিয়ে যাবেন সেসময় পথ আগলে বললাম, “স্যার, রোমান্টিক হয়ে গেছি ইদানিং, কবিতা লিখতে ভালো লাগে, একটু পড়ে দেখে রিভিউ জানাবেন”! ক্লাশ এইটে বৃত্তি পরীক্ষার বিশেষ প্রস্তুতি কোচিং করাতেন ঝিমিত ঝিমিত স্যার। আমি কোচিং ক্লাশে নিয়মিত অনুপস্থিত। কোথায় যায়, কী করি কেউ বলতে পারে না! আমার উপর বিরক্ত প্রায় প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষিকা এমনকি ভবন হোস্টেল সুপার ভিক্ষুরাও।

আসলে বিষয়টা হয়েছে কী, মোনঘর ডাইনিং হলের বাবুর্চিদের সাথে আমার কীভাবে কীভাবে যেন ভাব জমে যায়, আর আমি বাবুর্চিদের সাথে “ধুন্দো আমুলি” হয়ে উঠি। অর্থাৎ “ডাবা” বা হুক্কায় অভ্যেস আমার সেই ক্লাশ এইটে! তাই ধুন্দো (হুক্কা) খাওয়ার লোভে স্কুল ক্যাম্পাস থেকে অদূরে বাবুর্চিদের আবাসস্থল গ্রামের দিকে চলে যেতাম একা একা, অবশ্য আমার সঙ্গে থাকতো সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু বা শরৎচন্দ্রের উপন্যাস। তাছাড়া বৃত্তি কোচিং করতো কেবল নির্বাচিত মেধাবী শিক্ষার্থীরা। অথচ আমি ঘুরতে ভালোবাসতাম ক্লাশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে। কিন্তু তারা তো আর কোচিং করে না। ক্লাশের ঢেঙমার্কা ছেলেপিলেরা আমি ছাড়া যে অচল! তাদের সাথে নিয়ে প্রায়শই, কোন আইডিয়া নিয়ে হানা দিতাম পার্শ্ববর্তী কারো বাগানে। এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়, এ বাগান থেকে ও বাগান। এমনটাই ছিলো আমার মোনঘর জীবন!

একবার ঝিমিত স্যার একান্তে অফিসকক্ষে ডেকে পাঠালেন, বললেন “দেখ পুত্র, বিধায়ক এর নাম শুনেছো? ক্লাশে তুমি কি অমনোযোগী, তোমার চেয়ে ঢের পাজি ছিলো এই বিধায়ক! সবাই যখন ক্লাশে, সে তখন থাকতো গাছের মাথায় বাঁশি হাতে। এখন সে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে বিদেশে পড়তে গেছে। দেশ-জাতির কাজ করতেছে। তুমিও চাইলেই নিজের জন্য সবার জন্য অনেক ভালো কিছু করতে পারবে। ভালোভাবে আগে পড়াশোনাটা শেষ করে নাও।” তিনি আরো বললেন, “কীর্তি নিশানের নাম শুনেছো? সে এখন ইউএনডিপির হেড হয়ে কীভাবে মানুষের উপকার করছে দেখ, মোনঘরের সন্তান হিসেবে তোমাদের উপরও একসময় দ্বায়িত্ব বর্তাবে সমাজের কাজে অগ্রণী ভূমিকা রাখার।”

খোকন বিকাশ বড়ুয়া স্যার, অরুপণ স্যার, জটিল স্যার, সুদর্শী স্যার কারো কথায় তো ভুলে যাওয়ার নয়। সেকেন্ড স্যার বা নীহার কান্তি স্যার এর কথা মনে আছে হালকা। ইংরেজী গ্রামার পড়াতেন। একবার একটা ভুল ধরলেন। কোন একটা বিষয়ে “Here in” লিখেছিলাম, বললেন “চেষ্টা গুরিলে ইংরেজীতে অনেক ভালো গুরি পারিবে য়ে, হালিক মনে রাকিতে হইবে যে Here এর সাথে কখনো in হইবে না য়ে। আরেকবার পুড়ি ফেলাইলে নম্বর কাটি দিবো য়ে”। লতিকা দিদিমণির কথা বিশেষ মনে করতে হয়। আমরা যখন ক্লাশ নাইনে সেবছর তিনি বিদায় নিবেন। তাঁর বিদায় সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের দ্বায়িত্ব নিলাম আমাদের ব্যাচ। পুরো অনুষ্ঠানের দ্বায়িত্ব আমাদের। বলা যায় আমার জীবনের প্রথম কোন আনুষ্ঠানিক “সাংগঠনিকতা”।

সেসময় আমি আবার ছিলাম রাঙ্গাপানি মিলন বিহারে শ্রামণ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দ্বায়িত্বও ছিলো আমার। বিদায় সম্ভাষণ পত্রটাও আমিই লিখেছিলাম। আমার বন্ধু অনুত্তম যখন বিদায় সম্ভাষণ পত্রটি পড়ছিলেন, তখন লতিকা দিদিমনির চোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ঝড়ছিলো, আর আমি মনে মনে পুলকিত বোধ করছিলাম, যাহ শালা নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর লিখেছি! মোনঘর এর বার্ষিক প্রকাশনা ছিলো “মোনসদক” এবং “মোনকধা”। ছাত্র-শিক্ষক সবাই লিখতেন। স্কুলবার্ষিকীটার নাম ছিলো প্রত্যাশা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ রচনা খুঁজে পাওয়া যাবে সেই প্রকাশনাগুলো থেকে। স্থানীয় বা বিভাগীয় এবং কি জাতীয় পর্যায়ে এ্যাটলেটিক্স, খেলাধুলা, চিত্রাঙ্কন সবক্ষেত্রেই মোনঘরের শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর কুড়িয়ে নিয়ে যায় অসংখ্য পুরষ্কার। জেলাপর্যায়ে আন্ত:স্কুল খেলাধুলার সবকেক্ষেত্রেই প্রায় চ্যাম্পিয়ন মোনঘরের এ্যাটলেটরা। বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজের স্কুলপর্যায়ের ডিসপ্লে প্রদর্শনীতে সবসময়ই সেরা। মাসিক দেওয়াল পত্রিকা বের হতো ভবনভিত্তিক। আমি সপ্তম এবং অষ্টম শ্রেণীতে থাকার সময় করুণা ভবন এর দেয়ালপত্রিকা “করুণা”-র সম্পাদক ছিলাম। অবশ্য ভবনের সুপার মহোদয় চাইতেন যে “তথাকথিত মেধাবী এবং ভালো” মার্কা অন্য একজন সম্পাদক হোক। কিন্তু আমজনতার রায় আমার পালে হাল দিতো এই আর কী! কত স্মৃতি, কত কথা! মোনঘর, প্রাণের মোনঘর। মোনঘর, আকুতির মোনঘর। মোনঘর, প্রণতির মোনঘর। প্রিয় মোনঘর, সশ্রদ্ধ বন্দনা।

সেই ভোর বেলায় ঘন্টাধ্বনি দিয়ে মোনঘরে কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়। সকাল ৯টার দিকে সকালের পেটপুজো “আলুমার্কা” বিখ্যাত সেই “ঘন্দ” দিয়ে। এরপরে বিকেল ৪.০০ টা পর্যন্ত স্কুল। এরপর বৈকালিক বন্দনা। বৈকালিক বন্দনাশেষে বিকেল ৫.০০ টার দিকে যখন পেট ‘কাউক কাউক’ করে তখন বহুল কাঙ্খিত বিখ্যাত সেই “ভাতের ঘন্টা” বেজে উঠে। হাতের তর্জনী বা মধ্যমা দিয়ে স্টিল বা মেলামাইনের প্লেটগুলো বিশেষ কোন অলিম্পিক প্রদর্শনীর মতো ক্যারিশমেটিকবাবে ঘুরাতে ঘুরাতে মোনঘর ডাইনিং হলের দিকে শতশত ছেলেমেয়ের এগিয়ে যাওয়া বা কারো কারো অস্থির দৌড়! এই তো মোনঘরের জীবন। মোনঘরে বিকেল নেমে আসে আবারো ঘন্টা নিয়ে! এরপর নিকষ কালো রাতিতে মোনঘরের চৌসীমানাকে প্রহরা দেয় যে প্রহরীরা, তারা নিয়ম করে প্রতি ঘন্টায় বাজিয়ে যান সেই “থেং” ধ্বনিটি। ৮ টা বাজলে ৮টি থেং, ১০ টা বাজলে ১০টি থেং, ১২ টা বাজলে ১২টি থেং। এই থেং থেং ঘন্টাধ্বনিটা আমাদের সবাইকেই জাগিয়ে তুলে, সারারাত ধরে সতর্ক রাখে এবং ভোরের আলোক নিয়ে আসে।

শতাব্দীর অজস্র কোলাহলের ভিড়ে মোনঘরের এই থেং থেং ধ্বনিটাই হয়ে উঠুক জুম পাহাড়ের বেঁচে থাকার গান, সংহতির সুর এবং নতুন ভোরের প্রারম্ভিকা…

“আমা জাগা আমা ঘর
আমা বেগ’ মোনঘর”!

বিশেষ দ্রস্টব্য: এই লেখাটি মোনঘর শিশু সদন এর পুনর্মিলনী-৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ উপলক্ষে প্রকাশিত ‘মোনকধা’ নামক স্মারকগ্রন্থে প্রকাশিত। লেখাটির প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনা করে পাঠকদের জন্যও নিবেদন করলাম। মোনকধা-য় প্রকাশিত লেখাটিতে দু’একটি অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়ে গেছে। যেমন – জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সেখানে চাথোয়াই রোয়াজার নামও উল্লেখ আছে। বস্তুত চাথোয়াই রোয়াজা ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ থেকে নির্বাচিত হয়ে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালের সে নির্বাচনে জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা এম এন লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তরাঞ্চল হতে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেসময় জনসংহতি সমিতির নেতাকর্মীরা স্লোগান দেন এম এন লারমা জিন্দাবাদ, চাথোয়াই রোয়াজা জিন্দাবাদ, জনসংহতি সমিতি জিন্দাবাদ (তথ্য-মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জীবন ও সংগ্রাম, হিমাদ্রী উদয়ন চাকমা, ২০০৯)। আবছা স্মৃতি থেকে চাথোয়াই বাবুকে জেএসএসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উল্লেখ করেছি। এখানে তা সংশোধন করা হয়েছে। মোনঘর থেকে বারবার তাগাদা আসার কারণে আমার পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে লেখাটি তৈরী করতে হয়েছে বিধায় অনেক তথ্যে যথাযথ তথ্যসূত্র উল্লেখ করতে পারি নি বা আমি নিজেও যাচাই করার সযোগ পাই নি। আবার আমার পাঠানো লেখার কিছু তথ্য এবং বাক্যে মোনকধার সম্পাদক শশাঙ্ক দা কিছু সংশোধনী দিয়েছেন। তাই লেখাটির তথ্যগুলোর পাশাপাশি লেখাটির মূল স্পিরিটটাই প্রাসঙ্গিকভাবে বিবেচ্য। কোনপ্রকার ত্রুটি থাকলে দুঃখিত!

ঐতিহাসিক তিনটি দলিল এবং জুম্ম জনগণের লড়াই সংগ্রাম

0

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐতিহাসিককাল থেকে বিভিন্ন পাহাড়ি জাতির আবাসস্থল।

এতদ অঞ্চলের ভৌগলিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সাংস্কৃতিক ও আবহমানকালের সামাজিক বিবর্তনের প্রেক্ষাপট এবং বিকাশের গতি ও ইতিহাস বাংলাদেশের মূল ভূ-খন্ডের সামগ্রিক বিবর্তন ও বিকাশের ইতিহাস, গতি এবং বৈশিষ্ট্য থেকে বহুদিক দিয়েই ভিন্ন ও স্বতন্ত্র।

ঐতিহাসিককাল থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করছে পাংখো, খুমী, লুসাই, মুরং, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, খেয়াং, চাক, ত্রিপুরা, চাকমা প্রভৃতি জাতিসমূহ যাদের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ভাষা-ধর্ম, সামাজিক প্রথা ও রীতিনীতি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐতিহাসিককাল থেকেই এই ১১টি জাতির আবাসস্থল। এছাড়াও ব্রিটিশআমল থেকে কিছু অহমিয়া বা আসাম, গুর্খা এবং সাঁওতাল বসতি-র সন্ধানও পাওয়া যায় পার্বত্য চট্টগ্রামে।

তাদেরকে হিসেবে ধরলে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৪টি আদিবাসী জাতির বসবাস রয়েছে। বৈচিত্রময় ভাষা-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ এসব জাতিসমূহের মধ্যে বলিষ্ঠ সামাজিক মূল্যবোধ এবং প্রথাভিত্তিক নিজস্ব আইন-কানুনও প্রচলিত রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহকে কয়েকটি স্তরে ভাগ করে খতিয়ে দেখা যেতে পারে।

যেমন- প্রাক ব্রিটিশ যুগ, ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনকালের সময়কার পার্বত্য চট্টগ্রাম, দেশবিভাগের পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বা পাকিস্তান শাসনামলের পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং পাকিস্তান ভাগ হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের পার্বত্য চট্টগ্রাম।

প্রাক-ব্রিটিশ শাসন, ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী সময়কাল প্রত্যেকটা সময়েই পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ রয়েছে। সেই ঘটনাপ্রবাহ সঠিক অনুসন্ধান করে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের পথে এগোতে পারে।

ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে আসে ১৬ শতকে। ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে আসার আগপর্যন্ত সময়কালে পার্বত্য চট্টগ্রাম মূলত একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে অস্তিত্বমান ছিল।

“উল্লেখ্য যে, ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে JOA DE BARROS নামের এক পর্তুগীজ ঐতিহাসিকের একটি মানচিত্র থেকে তৎকালীন CHAKOMA বা চাকমা রাজ্যের অবস্থান সম্পর্কে সুষ্পষ্ট প্রমাণ মিলে।

এ মানচিত্রে চাকমা রাজ্যের অবস্থান বা সীমানা দেখানো হয়েছে – উত্তরে ফেনী নদী, দক্ষিণে নাফ নদী, পূর্বে লুসাই হিলস, এবং পশ্চিমে সমুদ্র।

এটাই ষোড়শ শতকের মধ্যবর্তীকালের চাকমা রাজ্যের সীমারেখা বলা যায়।” (তথ্যসূত্র-মুখবন্ধ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আইন সংহিতা, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ-২০১০)

ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে আসার আগপর্যন্ত সময়কালের স্বাধীন চাকমা রাজ্যের কিছু চিত্র পাওয়া যায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড: সুনীতিভুষণ কানুনগো রচিত “ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে চাকমা জাতির প্রতিরোধ সংগ্রাম” শীর্ষক মূল্যবান ঐতিহাসিক গ্রন্থে। গ্রন্থটির ২৩ পৃষ্ঠায় লেখা আছে-

“পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাংশে এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে চাকমা রাজ্য গঠিত ছিল। চট্টগ্রামের প্রথম চীফ হেনরি ভেরেলস্ট-এর বিবরণ অনুসারে উত্তরে ফেনী নদী থেকে দক্ষিণে শংখ নদ, পূর্বে কুকি রাজ্যের সীমানা থেকে পশ্চিমে নিযামপুর রোড পর্যন্ত সমগ্র ভূভাগ চাকমা রাজ্যের অর্ন্তভূক্ত ছিল।

তিনি লিখেছেন, ‘…All the hills from the Pheni river to Sangu and from Nigampur Road to the hills of the Kuki Raja’ প্রখ্যাত পরিব্রাজক ড: ফ্রান্সিস বুকানন ১৭৯৮ খ্রীস্টাব্দে চাকমা রাজা তব্বৌক খানের রাজত্বকালে চাকমা রাজ্য পরিভ্রমণে এসেছিলেন।

তিনি লিখেছেন যে পশ্চিমে রাঙ্গুনিয়া থেকে পূর্বে বরকল পর্যন্ত সমগ্র ভূভাগ চাকমা রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল । (The Property of Taubboka (Tabbak Khan) The Chakma Raja.’ তিনি আরো লিখেছেন যে, চেঙ্গী এবং কাচালং নদীদ্বয়ের উপত্যকা চাকমা রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। ”

ঐতিহাসিক তথ্যবিবরণীর আলোকে এটা সুস্পষ্ট যে, আজকের যে পার্বত্য চট্টগ্রাম সেটা একসময়কার স্বাধীন চাকমা রাজ্য। ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে আসার পরেই মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্তিত্বমান স্বাধীন রাজ্যের মর্যাদা বিলুপ্তি ঘটতে থাকে।

স্বাধীন চাকমা রাজ্য অর্থ এই নয় যে, সেসময় পার্বত্য চট্টগ্রামে কেবল চাকমারা বসবাস করতো। এ প্রসঙ্গে ‘ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে চাকমা জাতির প্রতিরোধ সংগ্রাম’ শীর্ষক সুনীতিভূষণ কানুনগো রচিত ঐতিহাসিক গ্রন্থের ১৪ এবং ১৫ পৃষ্ঠায় বর্ণিত “অন্যান্য পার্বত্য জাতিসমূহের সাথে সম্পর্ক” শীর্ষক অধ্যায়টির চুম্বক অংশের বিবরণসমূহ অবতারণা করা যেতে পারে-

“পার্বত্য চট্টগ্রামে বহু সংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে। চাকমা রাজ্যেও এ সকল জাতিগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। চাকমারা শান্তিপ্রিয় জাতি। অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোর সাথে তাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল।

চাকমা রাজ্যের উত্তরেও বহুসংখ্যক ত্রিপুরার বাসস্থান ছিল। ধর্মীয় দিক দিয়ে চাকমা এবং ত্রিপুরার মধ্যে পার্থক্য ছিল। ত্রিপুরারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী আর চাকমারা হলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।

এই ধর্মীয় বিভেদ থাকা সত্ত্বেও চাকমাদের সাথে ত্রিপুরাদের কোন সময়েই সম্পর্কের অবনতি হয় নাই। চাকমাদের সাথে ত্রিপুরাদের সুসম্পর্ক বর্ণনা প্রসঙ্গে মিঃ জে পি মিলস লিখেছেন – “In every way their (the tripus) material culture appears to be identical with that of the chakma.

মারমারা প্রধানত চাকমা রাজ্যের দক্ষিণে বোমাং রাজ্যের অধিবাসী। বেশ কিছু সংখ্যক মারমা চাকমা রাজ্যের উত্তরাংশে বসবাস করে। চাকমাদের সাথে মারমাদের সম্পর্ক যথেষ্ট হৃদ্যতাপূর্ণ না হলেও অমিত্রসুলভ ছিল না।

চাকমা রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্বে রোসাঙ্গ (আরাকান) রাজ্যের অবস্থান। উভয় রাজ্য পরষ্পরের সন্নিহিত হলেও দুর্লঙ্ঘ পর্বত শ্রেণী উভয় রাজ্যের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে।

এতদসত্ত্বেও চাকমাদের সাথে রোসাঙ্গবাসীদের সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। ১৭২৪ সালে চাকমা রাজ্য মোগলদের দ্বারা আক্রান্ত হলে চাকমা রাজ জল্লাল খাঁ দলবলসহ রোসাঙ্গ রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন।

কিছুদিন পর তিনি চাকমা রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন। রোসাঙ্গ (আরাকান) রাজ তাঁকে রাজা উপাধিতে ভূষিত করেন।”

চাকমা রাজ্য কয়েকটি বন্য জাতি দ্বারা বেষ্টিত ছিল। এ বিষয়টা লক্ষ্য করে ড বুকানন লিখেছেন, “The chakma Territory is surrounded by the savage tribes”

৩১ ডিসেম্বর,১৫৯৯ সালে ব্রিটেনের রানী প্রথম এলিজাবেথ থেকে অনুমতি নিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে। ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনাধীনে চলে যায়।

সে সময়কার চাকমা রাজা ছিলেন জব্বর খাঁ এবং তাঁর রাজধানী ছিল চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়াস্থ সুখবিলাসে। ১৮৫৮ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের আগপর্যন্ত দীর্ঘ সময়কাল ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন স্থায়ী হয়।

ব্রিটিশ শাসনামলে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্রিটিশ শাসনাধীনে চলে গেলেও বস্তুত ব্রিটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে সরাসরি শাসন করতে পারে নি। ব্রিটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে চাকমারা বারবার রুখে দাঁড়িয়েছে।

“চাকমা স্বাধীনতা সংগ্রামীরা দুটি কৌশল নিয়ে অগ্রসর হয়। প্রথমত, ব্রিটিশ সৈন্যদের চাকমা ভূখন্ডে প্রবেশ করতে বাধা প্রদান করা। দ্বিতীয়ত, নিজেদের ভূখন্ডে ক্ষমতা সুসংহত করা।

চাকমা প্রতিরোধ বাহিনীর নেতা ছিলেন রাজা শের দৌলত খা স্বয়ং। দ্বিতীয় প্রধান নেতা ছিলেন রাঙ্গুনিয়া ভূখন্ডের দেওয়ান রনু খান। বুকাননের বিবরণ অনুসারে রনু খান ছিলেন চাকমাদের মধ্যে খুব প্রভাবশালী (a powerful man among the chakmas) ।

অপর একজন শীর্ষ স্থানীয় নেতা ছিলেন কোন্নো খান। বুকাননের বিবরণানুসারে তিনি রাজার প্রধান দেওয়ান (The chief Dewan of Raja)। অন্যান্য নেতারা ছিলেন বুলোব, ছুরি,এবং তুথং। (পৃষ্ঠা-৩৬, ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে চাকমা জাতির প্রতিরোধ সংগ্রাম)।

“ব্রিটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে চাকমা সংগ্রামীদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাজা স্বয়ং। শের দৌলত খা, জান বক্স খান এবং তব্বৌক খান এই তিন রাজাই পুরুষানুক্রমে ব্রিটিশ কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন।

সুতরাং ইংরেজ সরকারের শত্রু হিসেবে তাঁরা চিহ্নিত। রাজা তব্বৌক খানের (তব্বর খান) পরাজয়ের পর প্রকৃতপক্ষে সমগ্র চাকমা ভূখন্ডে ব্রিটিশ আধিপত্যের প্রতিষ্ঠা হয়। চাকমা ভূখন্ড বাঙ্গালা প্রেসিডেন্সি প্রদেশের অর্ন্তভূক্ত হয়। যে রাজা নিজের রাজ্য থেকে কর আদায় করতেন তিনিই করদ রাজায় পরিণত হলেন।

রাজার ক্ষমতা হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মর্যাদারও হানি ঘটানো হলো। ইংরেজ প্রশাসনে তাকে ‘চীফ’ বা গোষ্ঠী প্রধান হিসেবে পরিচিতি দেওয়া হলো।

রাজার পরিচিতির পরিবর্তনের সাথে সাথে রাজ্যের পরিচিতিরও পরিবর্তন ঘটে। চাকমা রাজ্যকে সরকারিভাবে চাকমা সার্কেল ঘোষণা করা হয়। ব্রিটিশ আধিপত্য বিস্তারের সাথে সাথে চাকমা ভূখন্ডেরও ক্রমসংকোচন শুরু হয়।

ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সমতলবাসী চট্টগ্রামীরা সন্নিহিত পার্বত্য অঞ্চল যতটা দখল করা যেতে পারে ততটাই দখল করতে আরম্ভ করে।” (পৃষ্ঠা- ৫৫, ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে চাকমা জাতির প্রতিরোধ সংগ্রাম)

“১৮৭৩ সালে চাকমা ভূখন্ডকে দ্বিখন্ডিত করার প্রস্তাব আলোচনার জন্য গৃহীত হয়। ১৮৮৪ খ্রীস্টাব্দে চাকমা রাজ্যের উত্তরাংশ নিয়ে নতুন মং সার্কেল গঠিত হয়। এভাবে চাকমা রাজ্য ক্রমশ সঙ্কুশিত হতে থাকে।” (পৃষ্টা-৫৬, ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে চাকমা জাতির প্রতিরোধ সংগ্রাম)

“১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দ অবধি প্রায় ৩০ বছর সময়কালকে চাকমা রাজ্যের চাকমাদের সাথে কোম্পানির বৈরীতা ও সংঘাতের যুগ হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে।

পরবর্তী প্রায় ৬১ বছর অর্থাৎ ১৭৯৯ খ্রীস্টাব্দ থেকে ১৮৬০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজাদের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনে কোন বড় ধরনের হস্তক্ষেপ করে নি এবং রাজারা অনেকটা স্বাধীনভাবে অভ্যন্তরীণ প্রশাসন পরিচালনা করেন।” (তথ্যসূত্র-মুখবন্ধ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আইন সংহিতা, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ-২০১০)

মূলত ব্রিটিশ সরকার ১৮৬০ খ্রীস্টাব্দে স্বাধীন চাকমা রাজ্যকে ব্রিটিশভূক্ত বাংলার সাথে যুক্ত করে। ব্রিটিশ শাসনকার্যের সুবিধার্থে ১৮৬০ সালের ১ আগস্ট Act of XXII of 1860 বলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্ভূক্ত করে ব্রিটিশ সরকার স্বাধীন চাকমা রাজ্যকে ব্রিটিশভূক্ত বাংলার সাথে যুক্ত করে।

১৮৬০ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্রিটিশ শাসনাধীন পৃথক একটি জেলা হিসেবে শাসিত হতে শুরু করে। (তথ্যসূত্র-পার্বত্য চট্টগ্রাম আইন সংহিতা)

১৮৬০ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য বেশ কিছু আইন বলবৎ ছিল। যেমন- রেইডস অব ফ্রন্টিয়ার ট্রাইব এ্যাক্ট ২২ অব ১৮৬০, এ্যাক্ট ৪ অব ১৮৬৩, রেগুলেশন ৫ অব ১৮৭৩, রেগুলেশন ৩ অব ১৮৮১ প্রভৃতি।

সকল বলবৎকৃত আইনগুলো বাতিল করে ১৯০০ সালের ১লা মে,পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি প্রণীত হয়। প্রখ্যাত এই আইনের ধারা ৩৪ অনুসারে বহিরাগত অজুম্মদের/অপাহাড়িদের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে জমি ক্রয় বা বন্দোবস্ত নিষিদ্ধ ছিল।

ধারা ৫১ অনুসারে অজুম্ম/অপাহাড়ি কেউ পার্বত্যবাসীর স্বার্থের বিরোধী কোন কাজে লিপ্ত হলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে তাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বহিষ্কার করা যেতো। এই আইনের ধারা ৫২ অনুসারে জেলা প্রশাসকের অনুমতি ব্যাতীত কোন অজুম্ম/অপাহাড়ি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ বা বসবাস করতে পারতো না,

তবে হেডম্যান এর সুপারিশ এ জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে বসবাস করা যেতো। ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইনেও পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনের ক্ষেত্রে এই মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকে (তথ্যসূত্র- পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীকারের সন্ধানে, ১৯৯৭, বিপ্লব চাকমা)।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্রিটিশ আধিপত্যের শুরু থেকেই যে প্রতিরোধ যুদ্ধ জারি ছিল তা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাংগঠনিক রুপ লাভ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম জারি রেখেছিল পরবর্তীতেও।

ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন সময়ে কিছু রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টাও হয়েছে। ১৯১৫ সালে রাজমোহন দেওয়ানের নেতৃত্বে গঠিত হয় “চাকমা যুবক সমিতি”। ১৯১৮ সালে ঘনশ্যাম দেওয়ানের নেতৃত্বে গঠিত হয় “চাকমা যুবক সংঘ”।

১৯২০ সালে কামিনীমোহন দেওয়ানের নেতৃত্বে গঠিত হয় “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসমিতি”। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসমিতি ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত সামাজিক-সাংস্কৃতিক কার্যকলাপে সীমিত ছিল।

১৯৩৯ সালে যামিনীরঞ্জন দেওয়ান ও স্নেহ কুমার  চাকমার নেতৃত্বে এই সংগঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু হয়। ১৯৩৯ সালেই চাকমা রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় শরৎচন্দ্র তালুকদার ও সুনীতিজীবন চাকমার নেতৃত্বে গড়ে উঠে “পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র সমিতি”।

এভাবে ব্রিটিশ শাসনামলের শেষের দিকে এবং ১৯ শতকে এসে আধুনিক রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটতে থাকে পার্বত্য চট্টগ্রামে (তথ্যসূত্র- পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা, প্রদীপ্ত খীসা, সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৬)।

ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ ত্যাগ করলে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ই আগস্ট ভারত স্বাধীনতা প্রাপ্ত হয়। অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তানের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়।

১৯৪৭ সালের ১৭ই আগস্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাটি পাকিস্তানের ভাগে পড়েছে বলে সরকারীভাবে ঘোষণা দেওয়া হয় (তথ্যসুত্র-পৃষ্ঠা-৩৪, পার্বত্য চট্টগ্রামের একাল সেকাল, ২০০২, অঙ্কুর প্রকাশনী, শরদিন্দু শেখর চাকমা, সাবেক রাষ্ট্রদূত)।

সেসময় পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের সাথে অর্ন্তভূক্তির জন্য জোর প্রচেষ্টা চালান স্নেহ কুমার চাকমা। উল্লেখ্য যে, ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের সময় স্নেহ কুমার  চাকমার নেতৃত্বে ১৫ই আগস্ট রাঙ্গামাটিতে উড়ানো হয় ভারতীয় পতাকা ।
(তথ্যসূত্র: পৃষ্ঠা-৩৪, আমি ও আমার পৃথিবী, ২০১৩, ড: মানিকলাল দেওয়ান, সাবেক চেয়ারম্যান, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ)।

স্নেহ কুমার চাকমাকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আধুনিক রাজনৈতিক চেতনার বিকাশে অন্যতম পথিকৃৎ বলা যেতে পারে। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর পাকিস্তান শাসনামলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ বহিরাগত শাসকদের বিরুদ্ধে বরাবরই সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছে, রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে।

পাকিস্তান শাসনামলেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছাত্র-যুব সংগঠনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৫৬ সালে মৃণাল কান্তি চাকমা ও অনন্ত বিহারী খীসার নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘হিল স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন’।

১৯৫৭ সালে চট্টগ্রামের কানুনগো পাড়ায় এক ঐতিহাসিক ছাত্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই ছাত্র সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা।

এসময়কার জুম্ম ছাত্রনেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- অনন্তবিহারী খীসা, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, সুধাকর খীসা, জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা প্রমুখ (তথ্যসূত্র- পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা, প্রদীপ্ত খীসা, সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৬)।

১৯৬২ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন হয় এবং জুম্ম জনগণের জীবনে নেমে আসে অভাবনীয় দুর্ভোগ। পাকিস্তান সরকারের এই নির্মম প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেন তখনকার ছাত্রনেতা মানবেন্দ নারায়ণ লারমা।

১৯৬২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে এক পাহাড়ী ছাত্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি অনুসারে শাসনবহির্ভূত এলাকা হিসেবে যে মর্যাদা পার্বত্য চট্টগ্রাম ভোগ করে আসছিল তা পাকিস্তান সরকার ১৯৬৩ সালে বাতিল করে দেয়।

১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকারের নিবর্তনমুলক আইনে গ্রেফতার হন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। এভাবে ৬০দশকে এসে জুম্ম জনগণের উপর নিপীড়ন ও আগ্রাসনের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
(তথ্যসূত্র-স্মারকগ্রন্থ, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জীবন ও সংগ্রাম, ২০০৯, এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন)।

১৯৬৫ সালের ১৮ জুন চট্টগ্রামে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘ট্রাইবাল স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন’ যা পরবর্তীতে পাহাড়ী ছাত্র সমিতি হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। (তথ্যসুত্র- পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা, প্রদীপ্ত খীসা)

অবশ্য পাহাড়ী ছাত্র সমিতি প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে অন্য তথ্যও পাওয়া যায়। প্রসঙ্গ: পাহাড়ী ছাত্র সমিতি ও গিরিসুর শিল্পী গোষ্ঠী, শীর্ষক প্রবন্ধে পাহাড়ী ছাত্র সমিতির সাবেক কর্মী এবং পাহাড়ের গুণী শিল্পী রণজিৎ দেওয়ান লিখেছেন-

‍‍”তৎকালীন পূৃর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণ পূর্বাংশে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৩ ভাষাভাষি শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর অনুন্নত আদিবাসী জুম্ম জনগণকে আধুনিক শিক্ষায়, রাজনৈতিক ও সমাজ সচেতনতায় জাগিয়ে তুলে বিশ্ব সভায় মর্যাদা ও স্থান লাভের মহান লক্ষ্য নিয়ে জন্ম লাভ করে Tribal Student Association।

এর পুরোধা ছিলেন জুম্ম জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের স্বপ্নদ্রষ্টা অবিসংবাদিত নেতা প্রয়াত এম এন লারমা (M.N Larma) এবং আরো অনেক প্রগতিশীল ছাত্র নেতা কর্মী। এর কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছিল ঢাকায়।

পরবর্তীতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এর কার্যালয় স্থানান্তর করা হয়। ১৯৬২ সালে ১৩ নভেম্বর Tribal Student Association এর বদলে এর নতুন নামকরণ করা হয় Hill Student Association । পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে বাস্তবতার প্রয়োজনে এবং সাংগঠনিক কাজের সুবিধার্থে Dhaka থেকে রাঙ্গামাটিতে কেন্দ্রীয় কার্যালয় নিয়ে আসা হয়।

রাঙ্গামাটিতে স্থানান্থর হলেও কয়েকটি বছর এর কার্যক্রম খুব একটা পরিলক্ষিত হয় নি।। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে পুনরায় কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়।‍‍” (তথ্যসূত্র-প্রসঙ্গ: পাহাড়ী ছাত্র সমিতি ও গিরিসুর শিল্পী গোষ্ঠী, রণজিৎ দেওয়ান, জুমজার্নাল)

১৯৬৬ সালের ডিসেম্বর মাসে অনন্তবিহারী খীসা এবং জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতীয় কল্যাণ সমিতি’ । ১৯৭০ সালে গঠিত হয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি, যার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এবং জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা।

১৯৭০ সালের ১৬ই মে রাঙ্গামাটিতে গঠিত হয় “রাঙ্গামাটি কমিউনিস্ট পার্টি”, যার প্রথম এডহক কমিটির সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা, ভবতোষ দেওয়ান, যতীন্দ্রলাল ত্রিপুরা, অমিয়সেন চাকমা ও কালীমাধব চাকমা প্রমুখ নেতা। (তথ্যসুত্র- পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা, প্রদীপ্ত খীসা)

মানবেন্দ নারায়ণ লারমা ১৯৭০ সালের পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট ঐতিহাসিক ৪ দফা দাবীনামা পেশ করা হয়।

এটাই জুম্ম জনগণের পক্ষে বাংলাদেশ সরকারের নিকট প্রথম আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক দাবী। উল্লেখ্য যে, ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাকাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
(তথ্যসূত্র- মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জীবন ও সংগ্রাম, ২০০৯, এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন)

১৯২০ সালে কামিনীমোহন দেওয়ানের নেতৃত্বে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসমিতির নাম কিছুটা পরিবর্তন করে ১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে গঠিত হয় জুম্ম জনগণের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসে অভূতপূর্ব এবং বলিষ্ঠ রাজনৈতিক চেতনা সঞ্চারকারী রাজনৈতিক সংগঠন “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি”।

১৯৭২ সালের ২৪ জুন রাঙ্গামাটির ইন্দ্রপুরী সিনেমা হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির এক কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বিরাজমোহন দেওয়ান। এই সম্মেলনে জনসংহতি সমিতির ৬০ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়।

কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে বীরেন্দ্রকিশোর রোয়াজা এবং মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ।

এই কমিটিতে আরো ছিলেন- হ্লাথোয়াই প্রু, হীরালাল চাকমা, সুতকর্মা কার্বারী, বীরেন্দ্রলাল রোয়াজা, মং হ্লা প্রু চৌধুরী, যতীন্দ্রলাল ত্রিপুরা, সনৎকুমার চাকমা, প্রীতিকুমার চাকমা, সুকৃতিরঞ্জন চাকমা, অর্ধেন্দু বিকাশ চাকমা, কংজসাই, উহ্লা প্রু প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ ।
(তথ্যসূত্র: পৃষ্ঠা-৪০, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা, প্রদীপ্ত খীসা)।

ব্রিটিশ শাসনকাল থেকে পাকিস্তান শাসনামল বিভিন্নসময়ে বিভিন্ন সংগঠনের আবির্ভাব ঘটলেও মূলত ১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি মূলত জুম্ম জনগণের লড়াই সংগ্রামকে আধুনিক রাজনৈতিক আন্দোলনে রপান্তরিত করতে পারে এবং

পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জাতিসমূহকে একত্র করে সুনির্দিষ্ট দাবী-দাওয়া এবং রাজনৈতিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং আদর্শগত সাংগঠনিক প্রচেষ্টা নিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি পারিচালনা করতে থাকে।

১৯৭২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি জুম্ম জনগণের পক্ষে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট যে স্মারকলিপি দেওয়া হয় তা জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসে ঐতিহাসিক ৪ দফা নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক ৪ দফা দাবীনামা ছিল নিম্নরূপ –

১. পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল হবে এবং ইহার একটি আইন পরিষদ থাকবে।
২. উপজাতীয় জনগণের অধিকার সংরক্ষণের জন্য ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির অনুরূপ সংবিধিব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে থাকবে।
৩. উপজাতীয় রাজাদের দপ্তর সংরক্ষণ করতে হবে।
৪. পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয় নিয়ে কোন শাসনতান্ত্রিক সংশোধন বা পরিবর্তন যেন না হয়, এরূপ সংবিধিব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে থাকবে।

পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের ২৪ শে এপ্রিল বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের পক্ষে এম এন লারমা ৪ দফা দাবীর বিস্তারিত তুলে ধরে তা পেশ করেন। সেটা নিম্নরূপ –


বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ণ কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবীর
আবেদন পত্র

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবী শাসনতন্ত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভাবী শাসনতন্ত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনতান্ত্রিক অধিকার যাতে গৃহীত হয় তজ্জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি প্রতিনিধি দল ১৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ ইংরেজী তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম প্রধান মন্ত্রীর নিকট একটি স্মারক লিপি প্রদান করেন। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ এই স্মারক লিপিখানি মনে-প্রাণে সমর্থন করি এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে নবজীবনের প্রতীক্ষায় রয়েছি। স্মারকলিপিতে নিম্মলিখিত চারটি বিষয় উত্থাপন করা হয়েছে –

১. পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল হবে এবং ইহার একটি আইন পরিষদ থাকবে।
২. উপজাতীয় জনগণের অধিকার সংরক্ষণের জন্য ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির অনুরূপ সংবিধিব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে থাকবে।
৩. উপজাতীয় রাজাদের দপ্তর সংরক্ষণ করা হবে।
৪. পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয় নিয়ে কোন শাসনতান্ত্রিক সংশোধন বা পরিবর্তন যেন না হয়, এরূপ সংবিধিব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে থাকবে।

ষ্মারকলিপিতে বর্ণিত “চারটি বিষয় হলো” পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের জাতীয় অস্তিত্বের চাবিকাঠি। নিজস্ব আইন পরিষদসহ স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পরিণত করার জন্য আমরা আমাদের দাবী উত্থাপন করছি।

বছরকে বছর ধরে ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ শাসনের দিন থেকে ১৯৭১ সালে পকিস্তান ধ্বংসের দিন পর্যন্ত আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীরা খুবই দুর্বিসহ জীবন যাপন করছি, যার ফলে আমাদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে এবং আমাদের জাতীয় উন্নতি ব্যাহত হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি পৃথক শাসিত অঞ্চল । কিন্তু ভাগ্যের এমন নির্মম পরিহাস যদিও পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের “ উপজাতীয় জনগণের আবাসভূমি” হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল। তথাপি বাস্তবে ইহা মিথ্যা এবং প্রহসন ছাড়া আর কিছুই ছিলনা।

বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি পৃথক শাসিত অঞ্চলরূপে রাখার জন্য, শাসনের সুবিধার্থে আইন প্রয়োগের জন্য ১৯০০ সালে ব্রিটিশ সরকার “১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি” ঘোষণা করেন।

এই শাসনবিধি ছিল পুরোপুরি ত্রুটিপূর্ণ। এই শাসনবিধি একটি অগণতান্ত্রিক শাসনবিধি। এই শাসনবিধিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের প্রতিনিধিত্বের কোন বিধি ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। বাংলাদেশের গভর্ণরের হাতে সমস্ত ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে এই শাসনবিধি দ্বারা।

গভর্ণর খুবই শক্তিশালী। তিনি যেকোন সময়ে যখন মনে করেন পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসন ও শান্তির পক্ষে ইহা প্রয়োজন ও উপযোগী এবং উপযুক্ত তখন তিনি পার্বত্য  চট্টগ্রামে আইন প্রয়োগ করেন, নতুন রুলস ও রেগুলেশন বাতিল করেন।

গভর্ণর হলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন পরিষদ। গভর্ণর আইন প্রণয়ন করেন এবং তার জেলা প্রশাসন ইহা কার্যকরী করেন। ফলে পৃথক শাসিত অঞ্চল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসন ব্যবস্থা অর্থহীন হয়ে পড়ে।

সর্ব ক্ষেত্রে আগের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ পিছিয়ে পড়ে থাকলো। বৃটিশ সরকার আমাদের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের হতভাগা জনগণকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে।

জনগণের কন্ঠ স্তব্দ করে দেবার জন্য বৃটিশ সরকার একটি অদ্ভূত অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবর্তন করে। জনগণ গভর্ণর ও তার প্রশাসনের দয়ার উপর নির্ভর করে বাস করতে থাকে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণকে বঞ্চিত করে বৃটিশ সরকার বাইরের মানুষকে প্রশাসন বিভাগে নিয়োগ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসন কার্য চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে এবং এইভাবে কালক্রমে বহিরাগতদের প্রভাব জেলা প্রশাসনে প্রাধান্য লাভ করে থাকে।

ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র অর্থাৎ বাজার ,নদী-বন্দর প্রভৃতি সমস্ত ব্যবসা কেন্দ্রসমূহ বহিরাগতদের হাতে চলে যায়। এই রূপে রাজনৈতিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ বহিরাগত ব্যবসায়ীদের শোষণের শিকারে পরিণত হয়।

বৃটিশ সরকারের ন্যায় পকিস্তান সরকারও পার্বত্য চট্টগ্রামের হতভাগ্য জনগণকে রাজনৈতিক নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক শোষণ থেকে উদ্বার করার জন্য এগিয়ে আসেননি। বরঞ্চ পক্ষান্তরে স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শাসিত অঞ্চলের সত্তাকে চিরতরে লুপ্ত করে দেবার পথ প্রশস্থ করে দেয়।

অন্যায় অবিচার সমস্ত জেলায় চরম নৈরাজ্য ও ভীতির রাজত্ব সৃষ্টি করে। কাপ্তাই বাঁধের ফলে ৯৯ হাজার ৯ শ ৭৭ জন মানুষ ১৯৬০ সালে গৃহ হারা জমি হারা হয়ে যায়। সরকার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও উপযুক্ত পুনর্বাসনের কোন ব্যবস্থা বাস্তবায়িত করেননি।

স্বৈরাচারী পকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মতামত যাচাই না করে ১৯৬৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শাসিত অঞ্চলের সত্তাকে চিরতরে মুছিয়ে দেবার জন্য পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে একটি শাসনতান্ত্রিক সংশোধনী প্রস্তাব পাশ করিয়ে নেয়।

স্বৈরাচারী পকিস্তান সরকারের অগণতান্ত্রিক এবং নিপীড়নমূলক সিদ্বান্তের বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ কোন প্রতিবাদ করতে পারেনি। সুতরাং শেষ পর্যন্ত অনন্যোপায় হয়ে জন্মভূমি চিরতরে ত্যাগ করে প্রায় পঞ্চাশ হাজার নরনারী ১৯৬৪ সালে ভারতে আশ্রয় পাবার আশায় সীমান্ত পাড়ি দেয়।

বেআইনী অনুপ্রবেশ পার্বত্য চট্টগ্রামে ভয়াবহভাবে বৃদ্বি পায়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনসংখ্যা ছিল ৯৪.৪৭%,অমুসলমান ২.৫৯% এবং মুসলমান ২.৯৪%।

মুসলমান ও অমুসলমান জনসংখ্যা কিছু অংশ ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিম বাসিন্দা আর বাদবাকী অংশ ছিল বাইরে থেকে আগত ব্যবসায়ী ও সরকারী কর্মচারীবৃন্দ।কিন্তু গত ২৪ বছরে বহিরগতের সংখ্যা অসম্ভব রকমভাবে বেড়ে যায়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ বার বার পকিস্তান সরকারকে বেআইনী অনুপ্রবেশ বন্ধ কওে দেবার জন্য অনুরোধ জ্ঞাপন করে। বহিরাগতদের দ্বারা বেআইনী জমি বন্দোবস্থী ও বেআইনী জমি দখলের পথ নীরবে খুলে দেয়।

“১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি” বেআইনী অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে পারেনি,পারেনি বেআইনী জমি বন্দোবস্থী ও বেআইনী জমি দখল বন্ধ করে দিতে।

এই শাসনবিধি অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শাসিত অঞ্চলের সত্তা জনগণের যুগযুগ ধারে পিছিয়ে পড়ে থাকা অবস্থার কোন পরিবর্তন এনে দিতে পারেনি। কালক্রমে এই পৃৃথক শাসিত অঞ্চলের সত্তা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের নিকট অভিশাপ হয়ে দাড়ায়।

জনগণের অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে পৃথক শাসিত অঞ্চলের স্বত্ত্ব যথেষ্ট নয়। ইহা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের জাতীয় অস্তিত্বের নিরাপত্তাবোধ এনে দিতে পারে নি।

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ব্যতিত পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণ করা যাবে না। এই জন্য আমরা চারটি বিষয় উত্থাপন করে নিজস্ব আইন পরিষদ সম্বলিত একটি আঞ্চলিক ম্বায়ত্ত্ব শাসনের দাবী তুলে ধরছি। সুতরাং

ক) আমরা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা সমেত পৃথক অঞ্চল হিসেবে পার্বত্য অঞ্চল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পেতে চাই।
খ) আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের অধিকার থাকবে এই রকম শাসনব্যব্স্থার প্রবর্তন চাই।
গ) আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণ হবে এমন শাসন ব্যবস্থা আমরা পেতে চাই।
ঘ) আমাদেরও জমি স্বত্ব-জুম চাষের জমি ও কর্ষণযোগ্য সমতল জমির স্বত্ব সংরক্ষিত হয় এমন শাসনব্যবস্থ আমরা পেতে চাই।
ঙ) বাংলাদেশের অণ্যান্য অঞ্চল হতে এসে পার্বত্য চট্টগ্রামে যেন কেহ বসতি স্থাপন করতে না পারে সে জন্য শাসনতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থার প্রবর্তন চাই।

আমাদের দাবী ন্যায়সঙ্গত দাবী। বছরকে বছর ধরে ইহা একটি অবহেলিত শাসিত অঞ্চল ছিল। এখন আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ পার্বত্য চট্টগ্রামকে গনতান্ত্রিক পৃথক শাসিত অঞ্চল অর্থাৎ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল হিসেবে বাস্তবে পেতে চাই।

ভারত তার বিভিন্ন জাতি সমূহের সমস্যা সমূহ সমাধান করছে। ভারতের জাতিসমূহ বড় বা ছোট সকলে শাসনতান্ত্রিক অগ্রাধিকার পাচ্ছে।ভারেতের জাতি সমূহ ক্রমাণ্বয়ে ইউনিয়ন টেরিটরি এবং রাজ্য পর্যায়ের মর্যাদার অধিকারী হতে চলেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নও তার জাতি সমূহের সমস্যার সমাধান করেছে।

পাকিস্তান সরকার আমাদিগকে নির্মমভাবে নিপীড়ন করে। গত ২৪ বছর ধরে আমরা সকল মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলাম।রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক, শিক্ষা অর্থাৎ প্রত্যেকাট বিষয়ে আমরা আগের মতো পিছিয়ে পড়ে রয়েছি।

এখনো আমাদেও পার্বত্য চট্টগ্রামে হাজার হাজার মানুষ অর্ধনগ্ন পরিবেশে বাস করছে। এখনো হাজার হাজার মানুষ আদিম যুগের পরিবেশে বাস করছে। এখন নিপীড়নকারী স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারের দিন আর নেই।

আমরা স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারের সব রকমের নিপীড়ন ও অত্যাচার থেকে মুক্ত হয়েছি। আমাদেরও বাংলাদেশ এখন মুক্ত।

উপনিবেশিক শাসনের জোয়াল ভেঙ্গে গেছে।এখন আমাদের গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ চারটি মূল নীতি— গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে উর্ধ্বে তুলে ধরে  উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে।

আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণও বাংলাদেশের অন্যান্য অংশের ভাই-বোনদের সাথে এক যোগে এগিয়ে যেতে চাই। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ মনে করে এবং বিশ্বাস করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের যুগযুগান্তের অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা তুলে দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণের অধিকার দেবেন।

তারিখঃ রাঙ্গামাটি                                                                          জয়বাংলা

২৪ এপ্রিল ১৯৭২ সন                                                          মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা

                                                                               গণপরিষদ সদস্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

                                                                                              এবং
                                                                             আহ্বায়ক, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি

(তথ্যসুত্র-পৃষ্ঠা ১৩১, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জীবন ও সংগ্রাম, ২০০৯, এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন)

এখানে প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশের গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে ১৯৭২ সালের ১০ই এপ্রিল। বাংলাদেশের গণপরিষদের প্রথম স্পীকার মনোনীত হন শাহ আব্দুল হামিদ।

গণপরিষদ অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন ১৯৭২ সালের ১১ই এপ্রিল ড: কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ১৭ই এপ্রিল।

এই কমিটির নিকটই ১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে স্মারকলিপি প্রদান করে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের পক্ষে ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর নিকট পেশকৃত ঐতিহাসিক চার দফা দাবীনামা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে নতুনভাবে পেশ করা হয়।

এটি জুম্ম জনগণের জীবনে এক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দলিল যা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সংগ্রামের প্রকৃত স্বরুপ তুলে ধরতে ঐতিহাসিক সাক্ষ্য দিয়ে যাবে।

১৯৭২ সালে গণপরিষদের অধিবেশনসমূহে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জুম্ম জনগণের অধিকারের পক্ষেই কেবল নয় অধুনা স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের সকল নাগরিক তথা শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষের অধিকারের জন্য তাঁর সুচিন্তিত ঐতিহাসিক প্রস্তাবনা সমূহ দৃঢ়ভাবে তুলে ধরেছিলেন।

বলা হয়ে থাকে যে, বাংলাদেশের সংবিধান রচনার সময় গণপরিষদ বিতর্কে যে বিতর্ক হয়েছে তার ১৬ আনার ১৫ আনাই একা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাই করেছিলেন। প্রস্তাবিত খসড়া সংবিধানে জুম্ম জনগণকে নাগরিক হিসেবে বাঙালি বলে অভিহিত করা হয়।

নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের সকল নাগরিক বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন এরকম প্রস্তাবনা সংবিধানে গৃহীত হওয়ার প্রতিবাদে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর লারমা গণপরিষদের অধিবেশন বর্জন করেন এবং দৃঢ় উচ্চারণে বলেছিলেন-

“আমি যে অঞ্চল থেকে এসেছি, সেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশে বাস করে আসছে। বাংলাদেশের বাংলা ভাষায় বাঙালিদের সঙ্গে আমরা লেখাপড়া শিখে আসছি।

বাংলাদেশের সঙ্গে আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের কোটি কোটি জনগণের সঙ্গে আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সব দিক দিয়েই আমরা একসঙ্গে একযোগে বসবাস করে আসছি। কিন্তু আমি একজন চাকমা। আমার বাপ, দাদা, চৌদ্দ পুরুষ- কেউ বলে নাই, আমি বাঙালি।” (গণপরিষদ বিতর্ক, ৩১ অক্টোবর, ১৯৭২)

১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর নতুন সংবিধান বিল গৃহীত হয়। ১৯৭২ এর ১৬ই ডিসেম্বর থেকে এই সংবিধান কার্যকর হয়। এরই মধ্য দিয়ে নতুন করে জুম্ম জনগণের আত্মপরিচয়ের সংকট শুরু হলো।

১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধান অনুসারে ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণ নির্বাচনের কিছু আগে ১৯৭৩ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু রাঙ্গামাটিতে আসেন এবং একটি জনসভা করেন।

সেখানে তিনি সবাইকে বাঙালি হয়ে যাওয়ার আহবান জানান। উপস্থিত জুম্মরা সাথে সাথেই সভাস্থল ত্যাগ করে চলে যান। (তথ্যসূত্র-পৃষ্ঠা ১৩৪, জীবনালেখ্য,২০১১, স্নেহকুমার চাকমা)

১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চল থেকে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। আর দক্ষিণাঞ্চল থেকে জয়লাভ করেন চাথোয়াই রোয়াজা চৌধুরী। জনগণের মুখে ধ্বনিত হলো-

এম এন লারমা জিন্দাবাদ
চাথোয়াই রোয়াজা জিন্দাবাদ
জনসংহতি সমিতি জিন্দাবাদ

(তথ্যসূত্র-এম এন লারমার জীবন ও সংগ্রাম, হিমাদ্রী উদয়ন চাকমা, স্মারকগ্রন্থ, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জীবন ও সংগ্রাম,২০০৯)

জনসংহতি সমিতি একদিকে নিয়মতান্ত্রিক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল অন্যদিকে জুম্ম জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে বিকল্প রাজনৈতিক উপায়ও খুঁজতে হচ্ছিল। ১৯৭৩ সালের ৭ই জানুয়ারি জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখা শান্তিবাহিনী গঠিত হয়।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত হয় বাকশাল। সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনী বিল পাসের মধ্য দিয়ে দেশের অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক দাবী-দাওয়া যেন তুলে ধরতে পারেন সেজন্য লারমা বাকশালে পর্যন্ত যোগ দিয়েছিলেন।

কেন তিনি বাকশালে যোগ দেন জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন- “পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ভূল ধারণা এবং ভ্রান্ত নীতি কিছুটা হলেও পরিবর্তনের জন্য আমি বাকশালে যোগ দিয়েছি” (তথ্য-পৃষ্ঠা ৯৩, আমি ও আমার পৃথিবী, ড: মানিকলাল দেওয়ান)।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। জুম্ম জনগণের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথও রুদ্ধ হয়ে আসে এবং জনসংহতি সমিতি সম্পূর্ণ সশস্ত্রভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে।

তথাপিও ৭৫ পরবর্তী সকল সরকারের শাসনামলেই একদিকে আন্দোলন অন্যদিকে সরকারের সাথে আলোচনা অব্যাহত ছিল। ১৯৮৭ সালে জনসংহতি সমিতি সরকারের নিকট পাঁচ দফা দাবী নামা উত্তাপন করে। যা ছিল নিম্নরূপ-

 জুন্ম জনগণের পক্ষে

গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিকট
পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির
পাঁচ দফা

দাবীনামা



পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি
পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।
পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে জুন্ম জনগণের পক্ষে গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিকট পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির দাবীনামা।

চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, বোম, লুসাই, মুরং, পাংখো, খুমী, খিয়াং ও চাক ভিন্ন ভাষাভাষি এই দশটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতির আবাসভূমি পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম। যুগ যুগ ধরিয়া এই দশটি ভিন্ন ভাষাভাষি জাতি নিজস্ব সমাজ, সংস্কৃতি ও ভাষা লইয়া এই পার্ব্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করিয়া আসিতেছে। বিশ্বের প্রত্যেকটি জাতি বড় হউক আর ছোট হউক সব সময়ই নিজস্ব ধ্যান-ধারণার মাধ্যমে স্বীয় জাতীয় সংহতি ও জাতীয় পরিচিতি অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাইয়া আসিতেছে। পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের দশটি ভিন্ন ভাষাভাষি জুন্ম জনগণও ইহার ব্যতিক্রম নহে।

ভারতের বৃটিশ সরকার এই মর্মকথা অনুধাবন করিতে সক্ষম হওয়ায় ১৯০০ সালের ৬ই জানুয়ারী ‘‘ ১৯০০ সালের পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি’’ প্রণয়ন করিয়া পার্ব্বত্য চট্টগ্রামকে একটি পৃথক শাসিত অঞ্চলে পরিণত করে এবং ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে ‘‘ ১৯০০ সালের পার্ব্বত্য চট্টগ্রামকে পৃথক শাসিত অঞ্চল রূপে ঘোষণা করে।

১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসে বৃটিশ সরকার পাকিস্তান সরকারের হস্তে পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের শাসন ক্ষমতা অর্পণ করিয়া চলিয়া যায়। পাকিস্তান সরকার সংশোধিত ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনকে অস্তবর্তীকালীন শাসনতন্ত্র হিসাবে গ্রহণ করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শাসনের স্বীকৃতিও প্রদান করে। পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র গণ-পরিষদ কর্তৃক ১৯৫৬ সালের ২৯শে  ফেব্রুয়ারীতে গৃহীত হয় এবং পাকিস্তানের এই প্রথম শাসনতন্ত্রেও ‘‘ ১৯০০ সালের পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি’’ দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি পৃথক শাসিত অঞ্চলরূপে ঘোষণা করা হয়। ১৯৬২সালের ১লা মার্চ পাকিস্তানের দ্বিতীয় শাসনতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। এই দ্বিতীয় শাসনতন্ত্রে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ও ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান শাসনতন্ত্রে ব্যবহৃত ‘‘ পৃথক শাসিত অঞ্চল’’ শব্দের পরিবর্তে ‘‘ উপজাতীয় অঞ্চল’’ শব্দ ব্যবহার করিয়া ‘‘১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি’’ কে পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের শাসন পরিচালনার আইন ঘোষণা করিয়া পার্ব্বত্য চট্টগ্রামকে ‘‘ উপজাতীয় অঞ্চলের মর্যাদার স্বীকৃতি’’ দেওয়া হয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এই স্বাধীনতা যেন সকলের নিকট অর্থপূর্ণ হইতে পারে তজ্জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের দশ ভিন্ন ভাষাভাষি জুন্ম জনগণ দেশ ও জাতির পুনর্গঠনের মহান কর্মকান্ডে নিজেদেরকে আত্ম নিয়োগ করিয়া বাংলাদেশের উপযুক্ত নাগরিক হইয়া বাঁচিয়া থাকিতে চাহিয়াছিলাম। কিন্তু তদানীস্তন বাংলাদেশ সরকার জুন্ম জনগণের সকল প্রকারের আবেদন ও বাসনা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা ও অবজ্ঞা প্রদর্শন করিয়া এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শাসিত অঞ্চলের সত্ত্বা চিরতরে লুপ্ত করিয়া দিয়া ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর বাংলাদেশের প্রথম শাসনতন্ত্র ঘোষণা করে। ফলে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও ভূমির স্বত্ব সংরক্ষণের যতটুকু আইনগত অধিকার ‘‘ ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি’’ তে নিহিত ছিল তাহাও ক্ষুন্ন হইয়া যায়।

বৃটিশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ‘‘ ১৯০০ সালের পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি’’ ঔপনিবেশিক, অগণতান্ত্রিক ও ত্রুটিপূর্ণ। এই শাসন বিধিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের প্রতিনিধিত্বের কোন বিধি ব্যবস্থা গৃহীত হয় নাই। এই জন্য জুম্ম জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শাসিত অঞ্চলের সত্ত্বা যথেষ্ট নহে। বস্তুতঃ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ব্যাতিরেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নতি সাধনসহ দশ ভিন্ন ভাষাভাষি জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও ভূমির অধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভবপর নহে। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব অর্থাৎ দশ ভিন্ন ভাষাভাষি জুম্ম জনগণের সংহতি, সংস্কৃতি, সামাজিক সংগঠন, অভ্যাস, প্রথা প্রবাদ, ভাষা সংরক্ষণ এবং ভূমি স্বত্ব অর্থাৎ পাহাড় ও সমতল ভূমির স্বত্ত্ব সংরক্ষণের জন্য সর্বোপরি জুম্ম জনগণের সকল প্রকারের পশ্চাৎপদতা অতি দ্রুতগতিতে অবসান করিবার উদ্দেশ্যে জুম্ম জনগণের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কর্তৃক ৫ (পাঁচ) দফা দাবী গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিকট উপস্থাপন করা গেলঃ-

১। ক) পার্বত্য চট্টগ্রামকে প্রাদেশিক মর্যাদা প্রদান করা।
খ) নিজস্ব আইন পরিষদ সম্বলিত প্রাদেশিক স্বায়ত্ব শাসন পার্বত্য চট্টগ্রামকে প্রদান করা।

গ) প্রাদেশিক আইন পরিষদ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত হইবে এবং প্রদেশ তালিকাভূক্ত বিষয়ে এই প্রাদেশিক আইন পরিষদ প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের অধিকারী হইবে।
ঘ) দেশ রক্ষা, বৈদেশিক, মুদ্রা ও ভারী শিল্প ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ প্রশাসন, পুলিশ, শিক্ষা স্বাস্থ্য, কৃষি,বনজ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, মৎস্য, অর্থ, পশু পালন, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্ষুদ্র শিল্প, বেতার ও টেলিভিশন, রাস্তা-ঘাট, যোগাযোগ ও পরিবহণ, ডাক, কর ও খাজনা, জমি ক্রয়-বিক্রয় ও বন্দোবস্তি, আইন-শৃঙ্খলা, বিচার, খনিজ তৈল ও গ্যাস, সংস্কৃতি, পর্যটন, স্থানীয় স্বায়ত্ব-শাসন, সমবায়, সংবাদপত্র, পুস্তক ও প্রেস, জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ, সীমান্ত রক্ষা, সামাজিক প্রথা ও অভ্যাস, উন্নয়নমূলক কার্য্যক্রমসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য সকল বিষয়ে প্রাদেশিক সরকারকে প্রত্যক্ষ প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ও ক্ষমতা প্রদান করা।
ঙ) আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও প্রদেশ যাহাতে নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে কাজ করিতে পারে তজ্জন্য কেন্দ্র ও প্রদেশের ক্ষমতা স্বতন্ত্রভাবে তালিকাভূক্ত করা।
চ) পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের নাম পরিবর্তন করিয়া পার্ব্বত্য চট্টগ্রামকে ‘‘জুম্ম ল্যান্ড’’  নামে পরিচিত করা।
ছ) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিবর্তন করা।

২। ক) গণ-ভোটের মাধ্যমে পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মতামত যাচাইয়ের ব্যতিরেকে পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের বিষয় লইয়া কোন শাসনতান্ত্রিক সংশোধন বা পরিবর্তন যেন না হয় এই রকম শাসনতান্ত্রিক সংবিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন করা।
খ) বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল হইতে আসিয়া পার্ব্বত্য চট্টগ্রামে যেন কেহ বসতি স্থাপন ও ভূমি ক্রয়, বন্দোবস্তি করিতে না পারে সেই রকম শাসনতান্ত্রিক সংবিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন করা।
গ) পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসী নন এই রকম কোন ব্যক্তি যাহাতে বিনানুমতিতে পার্ব্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করিতে না পারে তজ্জন্য শাসনতান্ত্রিক সংবিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন করা।
ঘ) আভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতিরেকে বাংলাদেশের অপরাপর অংশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন বিপদের সম্মূখীন হইলেও পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের প্রদেশিক সরকারের সুপারিশ ব্যতীত পার্ব্বত্য চট্টগ্রামে যেন জরুরী আইন অথবা সামরিক আইন জারী করা না হয় সেই রকম শাসনতান্ত্রিক সংবিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন করা।
ঙ) প্রাদেশিক সরকারের সকল সরকারী, আধা সরকারী ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপুর্ণ পদে পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী নন এমন কোন ব্যক্তিকে যেন নিয়োগ না করা হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত কর্মকর্তাকে প্রাদেশিক সরকারের সুপারিশ ব্যতিরেকে অন্যত্র বদলী যেন না করা হয় সেই রকম শাসনতান্ত্রিক সংবিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন করা।

৩। ক) ১) ১৭ই আগষ্ট ১৯৪৭ সাল হইতে অত্র দাবীনামা উপস্থাপনের দিন পর্যন্ত যাহারা বেআইনীভাবে পার্ব্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ করিয়া পাহাড় কিংবা সমতল ভূমি ক্রয় বা বন্দোবস্তি বা বেদখল করিয়াছে অথবা পাহাড় কিংবা সমতল ভূমিক্রয়, বন্দোবস্তি ও বেদখল করিয়া বসতি স্থাপন করিয়াছে সেই সকল বেআইনী বহিরাগতদেরকে পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম হইতে সরাইয়া লওয়া।

২) অত্র দাবীনামা উপস্থাপনের পরবর্তী দিন হইতে বাংলাদেশ সরকার ও পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তিপত্র সম্পাদিত না হওয়া পর্যন্ত যাহারা বেআইনীভাবে পার্ব্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ করিয়া পাহাড় কিংবা সমতল ভূমিক্রয়, বন্দোবস্তি ও বেদখল করিয়া বসতি স্থাপন করিয়া থাকিবে সেই সকল বেআইনী বহিরাগতদেরকেও পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম হইতে সরাইয়া লওয়া।

খ) পাকিস্তান শাসনামলের প্রারম্ভ হইতে বাংলাদেশ সরকার ও পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তিপত্র সম্পাদিত না  হওয়া পর্যন্ত পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের যে সকল নরনারী ভারত ও বার্মা রাষ্ট্রে চলিয়া যাইতে বাধ্য হইয়াছে অথবা চলিয়া যাইতে বাধ্য হইবে তাহাদের সকলকে পার্ব্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত করা।

গ) কাপ্তাই বাঁধের জলসীমা সর্বোচ্চ ৬০ (ষাট) ফুট নির্ধারিত করা এবং কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্থ উদ্ভাস্তুদের সুষ্ঠু পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।

ঘ)১) পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির কোন সদস্যের বিরুদ্ধে যদি কোন প্রকারের মামলা, অভিযোগ, ওয়ারেন্ট ও হুলিয়া থাকে অথবা কাহারও অনুপস্থিতিতে কোন বিচার নিস্পন্ন হইয়া থাকে তাহা হইলে বিনাশর্তে সেই সব মামলা, অভিযোগ, ওয়ারেন্ট ও হুলিয়া প্রত্যাহার ও বিচারের রায় বাতিল করা এবং কাহারও বিরুদ্ধে কোন  প্রকারের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ না করা।
২) পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির সকল সদস্যের যথাযথ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা অবলম্বন করা।
৩) পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির কার্য্যকলাপে জড়িত করিয়া অথবা মিথ্যা অজুহাতে জুম্ম জনগণের মধ্যে যদি কাহারও বিরুদ্ধে কোন প্রকারের মামলা, অভিযোগ, ওয়ারেন্ট ও হুলিয়া থাকে অথবা কাহারও অনুপস্থিতিতে কোন বিচার নিস্পন্ন হইয়া থাকে তাহা হইলে বিনাশর্তে সেইসব মামলা, অভিযোগ, ওয়ারেন্ট ও হুলিয়া প্রত্যাহার ও বিচারের রায় বাতিল করা এবং কাহারও বিরুদ্ধে কোন প্রকারের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ না করা।

 ৪। ক) পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের উন্নতিকল্পে কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, সমবায়, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, ধর্ম, ভাষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, পশু পালন, রাস্তা-ঘাট ও যোগাযোগ, মৎস্য, বনজ, জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ খাতে বিশেষ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও তজ্জন্য কেন্দ্রীয় তহবিল হইতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা।
খ) পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের জন্য একটি নিজস্ব ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা।
গ) বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও অন্যান্য কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জুম্ম ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা এবং বিদেশে গবেষণা ও উচ্চ শিক্ষা লাভের সুযোগ প্রদান করা।
ঘ) ১) বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীতে জুম্ম জনগণের জন্য নির্দিষ্ট কোটা সংরক্ষণ করা।
২) সরকারী চাকুরীতে জুম্ম জনগণের জন্য বয়ঃসীমা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করা।

৫। পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে অনুকূল পরিবেশ গড়িয়া                                 তুলিবার জন্য-
ক) সাজাপ্রাপ্ত অথবা বিচারাধীন অথবা বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর হেফাজতে আটককৃত সকল জুম্ম নরনারীকে বিনাশর্তে মুক্তি প্রদান করা।
খ) পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের উপর সকল প্রকারের নির্যাতন, নিপীড়ন বন্ধ করা।
গ) পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে যুক্তগ্রাম ও আদর্শ গ্রামের নামে গ্রুপিং করার কার্য্যক্রম বন্ধ করা এবং যুক্ত গ্রাম ও আদর্শ গ্রাম সমূহ ভাঙ্গিয়া দেওয়া।
ঘ) ১) বাংলাদেশের অপরাপর অঞ্চল হইতে আসিয়া পার্ব্বত্য চট্টগ্রামে বেআইনী অনুপ্রবেশ, পাহাড় ও সমতল ভূমিক্রয়, বন্দোবস্তি ও বেদখল এবং বসতি স্থাপন বন্ধ রাখা।
২) লামা, রাজস্থলী, মাটিরাঙ্গা, রামগড়, মেরুং, পানছড়ি ও লংগদু থানা সমূহের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত বেআইনী বহিরাগতদিগকে পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম হইতে অন্যত্র সরাইয়া লওয়া।

ঙ) দীঘিনালা, রুমা ও আলিকদম সেনানিবাস সহ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সকল ক্যাম্প পর্য্যায়ক্রমে পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম হইতে তুলিয়া লওয়া।

[বিঃদ্রঃ- ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৮৭, বৃহস্পতিবার গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির মধ্যে দ্বিতীয় আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকে এই ৫ (পাঁচ) দফা সম্বলিত দাবীনামা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে পেশ করা হয়। ]

জনসংহতি সমিতির পাঁচদফা দাবীর প্রেক্ষিতে এরশাদ সরকার ১৯৮৯ সালে প্রণয়ন করে স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন। ১৯৮৯ সালে প্রণীত স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন কার্যত পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যার সঠিক সমাধান দিতে পারে নি। এখানে প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, ৯০ দশকে বৈশ্বিক রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা সংঘটিত হয়। ১৯৮৯ সালে বার্লিন ওয়াল পতনের মধ্য দিয়ে বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক বলয় দুর্বল হয়ে পুঁজিবাদী রাজনৈতিক বলয় বিশ্বব্যাপী প্রসারিত হতে থাকে। ফলে দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনসমূহ দুর্বল হয়ে আসে। অন্যদিকে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে স্বৈরাচারী সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের পতন হয় ১৯৯০ সালে। এখানে প্রসঙ্গত স্মরণীয় যে, ১৯৮৩ সালে জনসংহতি সমিতি ‘লাম্বা’ এবং ‘বাদী’ দুইগ্রুপে বিভক্ত হয়েছিল এবং জনসংহতি সমিতির শক্তি কার্যত বহুলাংশে দুর্বল হয়ে এসছিল। ১৯৮৩ সালের ১০ই নভেম্বর জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা এবং জুম্ম জনগণের জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত মানবেন্দ্র লারমা বিভেদপন্থীদের অতর্কিত এবং ষড়যন্ত্রমূলক আক্রমনে নিহত হন। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নিহত হওয়ার পরে শক্তভাবে পার্টি  এবং আন্দোলনের হাল ধরেন জনসংহতি সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং ফিল্ড কমান্ডার জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। সরকার এবং জনসংহতি সমিতির মধ্যে মাঝে অস্ত্রবিরতি চলেছিল এবং উভয়পক্ষ আলোচনার উপর গুরুত্ব দিয়েছিল। ১৯৮৯ এর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার বিপরীতে জনসংহতি সমিতি ১৯৯২ সালে পেশ করে সংশোধিত পাঁচদফা দাবীনামা। যা ছিল নিম্নরূপ-

পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির সংশোধিত পাঁচ দফা

দাবীনামা

এবং

আঞ্চলিক পরিষদ সম্বলিত আঞ্চলিক
স্বায়ত্ব শাসনের সংক্ষিপ্ত

রূপরেখা



পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগ
কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত।

চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরুং, বোম, লুসাই, খুমী, খিয়াং ও চাক-ভিন্ন ভাষাভাষি এই দশটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতির আবাসভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম। যুগ যুগ ধরিয়া এই দশটি ভিন্ন ভাষাভাষি জাতি নিজস্ব সমাজ সংস্কৃতি, রীতি-নীতি, ধর্ম ও ভাষা লইয়া পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করিয়া আসিতেছে। বিশ্বের প্রতিটি জাতি বড় হউক বা ক্ষুদ্র হউক সব সময়ই নিজস্ব ধ্যান ধারণার মাধ্যমে স্বীয় জাতীয় সংহতি ও জাতীয় পরিচিতি অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাইয়া আসিতেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের দশটি ভিন্ন ভাষাভাষি জুম্ম পাহাড়ী জনগণও ইহার ব্যতিক্রম নহে।

ভারতের ব্রিটিশ সরকার এই মর্মকথা অনুধাবন করিতে সক্ষম হওয়ায় ১৯০০ সালের ৬ই জানুয়ারী ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি প্রণয়ন করিয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শাসিত অঞ্চলের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখে। ইহার পরেও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে উক্ত শাসন বিধি পুনরায় স্বীকৃতি প্রদান করিয়া পার্বত্য চট্টগ্রামকে পৃথক শাসিত অঞ্চল রূপে ঘোষণা করে। কিন্তু ১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসন ক্ষমতা পাকিস্তান সরকারের হস্তে অর্পণ করিয়া চলিয়া যায়। পাকিস্তান সরকার সংশোধিত ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনকে অন্তবর্তীকালীন শাসনতন্ত্র হিসাবে গ্রহণ করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শাসনের স্বীকৃতিও প্রদান করে। পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র ১৯৫৬সালের ২৯শে ফেব্র“য়ারী গৃহীত হয়  এবং এই শাসনতন্ত্রেও ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি পৃথক শাসিত অঞ্চল রূপে ঘোষণা করা হয়। ১৯৬২ সালের ১লা মার্চ পাকিস্তানের দ্বিতীয় শাসনতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। এই দ্বিতীয় শাসনতন্ত্রে ভারত শাসন ও ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান শাসনতন্ত্রে ব্যবহৃত ‘‘ পৃথক শাসিত অঞ্চল’’ শব্দের পরিবর্তে ‘‘ উপজাতীয় অঞ্চল’’ শব্দ ব্যবহার করিয়া ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসন পরিচালনার আইন ঘোষণা করিয়া পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতীয় অঞ্চলের মর্যাদার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বস্তুতঃ ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত এই শাসন বিধি উপনিবেশিক, সামন্ততান্ত্রিক অগণতান্ত্রিক ও ত্র“টিপূর্ণ। এই শাসন বিধিতে জুম্ম জনগণের প্রতিনিধিত্বের কোন বিধি ব্যবস্থা গৃহীত হয় নাই। এই কারণে ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য স্বায়ত্ব শাসনের দাবী উত্থাপন করা হয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে স্বাধীনতা যেন সকলের নিকট অর্থপূর্ণ হইতে পারে তজ্জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণও দেশ ও জাতির পুনর্গঠনের মহান কর্মকান্ডে নিজেদেরকে আত্মনিয়োগ করিয়া বাংলাদেশের উপযুক্ত নাগরিক হইয়া বাঁচিয়া থাকিতে চাহিয়াছিল। তদুদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শাসিত অঞ্চলের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাীিখয়া নিজস্ব আইন পরিষদ সম্বলিত স্বায়ত্ব শাসনের আবেদন করা হইয়াছিল। কিন্তু তদানীন্তন বাংলাদেশ সরকার জুম্ম জনগণের সকল প্রকারের আবেদন ও বাসনা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা ও অবজ্ঞা প্রদর্শন করিয়া এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জাতীয় ও ভূমির অধিকার সংরক্ষণের একমাত্র রক্ষাকবচ পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শাসিত অঞ্চলের স্বত্ত্বা চিরতরে লুপ্ত করিয়া দিয়া ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর বাংলাদেশের প্রথম শাসনতন্ত্র ঘোষণা করে। ফলতঃ জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও ভূমির স্বত্ত্ব সংরক্ষণের যতটুকু আইনগত অধিকার ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিতে ছিল তাহাও ক্ষুন্ন হইয়া যায়।

ব্রিটিশ শাসনামল হইতে আজ অবধি জুম্ম জনগণ সকল ক্ষেত্রে বঞ্চিত, লঞ্চিত, নিপীড়িত ও নির্যাতিত হইয়া আসিতেছে। ফলশ্র“তিতে ভিন্ন ভাষাভাষি দশটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতির জাতীয় অস্তিত্ব আজ চির বিলুপ্তির পথে। ইহা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতি, সামাজিক রীতি নীতি, ভৌগলিক পরিবেশ, আচার-অনুষ্ঠান, দৈহিক ও মানসিক গঠন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা প্রভৃতির ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ ও বাংলাদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগণের মধ্যে অনেক মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় জুম্ম জনগণও বাংলাদেশের অপরাপর অঞ্চলের জনগণের ন্যায় দেশমাতৃকার সেবা করিতে দৃঢ়-সংকল্প কিছু বিশেষ এক শ্রেণীর লোকের ষড়যন্ত্রের ফলে ঐতিহাসিকভাবে আজ তাহারা সেই মহান দায়িত্ব হইতে বঞ্চিত হইয়া রহিয়াছে। অথচ এই দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ সুদৃঢ় করিবার ক্ষেত্রে জুম্ম জনগণ নীরবে সকল বঞ্চনা ও নিপীড়ন সহ্য করিয়াও অপরিসীম ত্যাগ স্বীকারে দ্বিধাবোধ করে নাই।

ব্রিটিশ প্রদত্ত ১৯০০ সালের পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি জুম্ম জনগণের জাতীয়স্বার্থ সংরক্ষণ করিতে পারে নাই। অনুরূপ ‘‘ পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ’’ দ্বারাও জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব, ভূমি স্বত্ত্ব ও মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত হইতে পারে নাই। কারণ এই পার্ব্বত্য জেলা পরিষদ সমূহ অগণতান্ত্রিক, সামন্ততান্ত্রিক, কম ক্ষমতাসম্পন্ন ও ত্র“টিপূর্ণ। বস্তুতঃ গণতান্ত্রিক স্বায়ত্ব শাসন ব্যতিরেকে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব, ভূমি স্বত্ত্ব ও মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভবপর নহে। সুতরাং পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব অর্থাৎ দশ ভিন্ন ভাষাভাষি জুম্ম জনগণের সংহতি, সংস্কৃতি, সামাজিক সংগঠন, অভ্যাস, প্রথা, ভাষা প্রভৃতি এবং ভূমি স্বত্ত্ব অর্থাৎ পাহাড়, বন ও ভূমির স্বত্ত্ব সংরক্ষণের জন্য সর্বোপরি মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সকল প্রকারের পশ্চাদপদতা অতি দ্রুতগতিতে অবসান করিবার লক্ষ্যে পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের বৃহত্তর স্বার্থে জুম্ম জনগণের পক্ষে পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি কর্তৃক ১৯৮৭ সালের ১৭ই ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের নিকট পেশকৃত আইন পরিষদসহ প্রাদেশিক স্বায়ত্ব শাসন সম্বলিত ৫ (পাঁচ) দফা দাবী সংশোধিত আকারে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিকট উপস্থাপন করা গেল-

১। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করিয়া-

)  ক) পার্ব্বত্য চট্টগ্রামকে একটি পৃথক শাসিত অঞ্চলের মর্যাদা প্রদান করা।
খ) আঞ্চলিক পরিষদ সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্ব শাসন পার্ব্বত্য চট্টগ্রামকে প্রদান করা।

গ) এই আঞ্চলিক পরিষদ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের লইয়া গঠিত হইবে এবং ইহার একটি কার্য নির্বাহী কাউন্সিল থাকিবে।
ঘ) আঞ্চলিক পরিষদে অর্পিত বিষয়াদির উপর এই পরিষদ সংশ্লিষ্ট আইনের অধীনে বিধি, প্রবিধান, উপবিধি, উপআইন, আদেশ, নোটিশ প্রদান, জারী ও কার্যকর করিবার ক্ষমতায় অধিকারী হইবে।

ঙ) পরিষদের তহবিল ও সম্ভাব্য আয়ের সাথে সংগতি রাখিয়া স্বাধীনভাবে বাৎসরিক বাজেট প্রণয়ন ও অনুমোদন করিবার ক্ষমতা এই পরিষদের হাতে থাকিবে।
 চ)আঞ্চলিক পরিষদ নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী হইবে-১) পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা; ২) জেলা পরিষদ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, ইপ্রভমেন্ট ট্রাষ্ট ও অন্যান্য স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ; ৩) পুলিশ, ৪) ভূমি সংরক্ষণ ও উন্নয়ন; ৫) কৃষি, কৃষি ও উদ্যান উন্নয়ন; ৬) কলেজ, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা; ৭) বন, বন সম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন; ৮) গণ স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা; ৯) আইন ও বিচার; ১০) পশু পালন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ; ১১) ভূমি ক্রয়, বিক্রয় ও বন্দোবস্তু; ১৫) পর্যটন; ১৬) মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ; ১৭) যোগাযোগ ও পরিবহণ; ১৮) ভূমি রাজস্ব, আবগারী শুল্ক ও অন্যান্য কর ধার্যকরণ; ১৯) পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ; ২০) হাট বাজার ও মেলা; ২১) সমবায়; ২২) সমাজ কল্যাণ; ২৩) অর্থ; ২৪) সংস্কৃতি, তথ্য ও পরিসংখ্যান; ২৫) যুব কল্যাণ ও ক্রীড়া; ২৬) জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা; ২৭) মহাজনী কারবার ও ব্যবসা; ২৮) সরাইখানা, ডাকবাংলা, বিশ্রামাগার, খেলার মাঠ ইত্যাদি; ২৯) মদ চোলাই, উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয় ও  সরবরাহ; ৩০) গোরস্থান ও শ্মশান; ৩১) দাতব্য প্রতিষ্ঠান, আশ্রম, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও উপাসনাগার; ৩২) জল সম্পদ ও সেচ ব্যবস্থা; ৩৩) জুম চাষ ও জুম চাষীদের (জুমিয়া) পুনর্বাসন; ৩৪) পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন; ৩৫) কারাগার; ৩৬) পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত অন্যান্য কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

২। ক) চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরুং, বোম, লুসাই, পাংখো, খুমী, খিয়াং ও চাক-এই ভিন্ন ভাষাভাষি দশটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতির সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা;
 খ) পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি ‘‘ বিশেষ শাসন বিধি’’ অনুযায়ী শাসিত হইবে সংবিধানে এই রকম শাসনতান্ত্রিক সংবিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন করা;
 গ) বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল হইতে আসিয়া যেন কেহ বসতি স্থাপন, জমি ক্রয় ও বন্দোবস্ত করিতে না পার সংবিধানে সেই রকম সংবিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন করা;
 ঘ) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসী নন এই রকম কোন ব্যক্তি পরিষদের অনুমতি ব্যতিরেকে যাহাতে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করিতে না পারে সেই রকম আইন বিধি প্রণয়ন করা। তবে শর্ত থাকে যে, কর্তব্যরত সরকারী ব্যক্তির ক্ষেত্রে ইহা প্রযোজ্য হইবে না;

ঙ) ১) গণভোটের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মতামত যাচাইয়ের ব্যতিরেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয় লইয়া কোন শাসনতান্ত্রিক সংশোধন যেন না করা হয়
২) সংবিধানে সেই রকম সংবিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন করা; আঞ্চলিক পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের পরামর্শ ও সম্মতি ব্যতিরেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয় লইয়া যাহাতে কোন আইন অথবা বিধি প্রণীত না হয় সংবিধানে সেই রকম শাসনতান্ত্রিক সংবিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন করা;
 চ) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের লইয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য স্বতন্ত্র পুলিশ বাহিনী গঠন করা। তদুদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় আইন ও বিধি প্রণয়ন করা;
 ছ) যুদ্ধ বা বহিঃ আক্রমণ ব্যতীত আভ্যন্তরীণ গোলযোগের দ্বারা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে বা উহার যে কোন অংশের  নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন বিপদের সম্মুখীন হইলেও আঞ্চলিক পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের পরামর্শ ও সম্মতি ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রামে যেন জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা না হয় সংবিধানে সেই রকম শাসনতান্ত্রিক সংবিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন করা;
জ) পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সরকারী, আধা-সরকারী ও স্বায়ত্ব শাসিত প্রতিষ্ঠানের সকল স্তরের কর্মকর্তা ও বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মচারী পদে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসী নন এমন কোন ব্যক্তিকে যেন নিয়োগ করা না হয় সেই রকম আইনবিধি প্রণয়ন করা। তবে কোন পদে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের মধ্যে যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি না থাকিলে সরকার হইতে প্রেষণে উক্ত পদে নিয়োগ করা।

২। ১)  ক) রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই তিনটি জেলা বলবৎ রাখিয়া একত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ইউনিটে পরিণত করা।
খ) পার্বত্য চট্টগ্রামের নাম পরিবর্তন করিয়া পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘‘ জুমল্যান্ড’’ নামে পরিচিত করা।
২) পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক একটি পৃথক মন্ত্রণালয় স্থাপন করা।
৩) পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষি জুম্ম জনগণের জন্য একটি বিশেষ বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।
৪) পার্বত্য চট্টগ্রামস্থ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ আসন সমূহ জুম্ম জনগণের জন্য সংরক্ষিত রাখিবার বিধান করা।
৫)   ক) কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্প কেন্দ্র এলাকাকে বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র এলাকা, রাষ্ট্রীয় শিল্প কারখানা এলাকা এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থে অধিগ্রহণকৃত জমি ব্যতীত অন্যান্য সকল শ্রেণীর জমি পাহাড় ও কাপ্তাই হ্রদ এলাকা এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চলসহ অন্যান্য সকল বনাঞ্চল পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ও আওতাধীন করা।

খ) কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্প কেন্দ্র এলাকা বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র এলাকা, রাষ্ট্রীয় শিল্প কারখানা এলাকা ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থে অধিগ্রহণকৃত জমির সীমানা সুনির্দিষ্ট করা।
গ) পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ও আওতাধীন কোন প্রকারের জমি ও পাহাড় পরিষদের সম্মতি ব্যতিরেকে সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ ও হস্তান্তর না করিবার প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

ঘ) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসী নন এমন ব্যক্তির দ্বারা বেদখলকৃত ও অন্য কোন উপায়ে বন্দোবস্তকৃত বা ক্রীত বা হস্তান্তরকৃত সমস্ত জমি ও পাহাড়ের মালিকানা স্বত্ত্ব বাতিল করা এবং ঐ সমস্ত জমিও পাহাড় প্রকৃত মালিকের নিকট অথবা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা।
 ঙ) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসী নন এমন কোন ব্যক্তি নিকট বা কোন সংস্থাকে যে সমস্ত জমি বা পাহাড় রাবার চাষ, বনায়ন অথবা অন্য কোন উদ্দেশ্যে ‘‘ লীজ’’  বা বন্দোবস্ত দেওয়া হইয়াছে সেই সমস্ত জমির লীজ ও বন্দোবস্ত বাতিল করা এবং ঐ সমস্ত জমি ও পাহাড় পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ও আওতাধীন করা।
চ) সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর ক্যাম্প ও সেনানিবাস কর্তৃক পরিত্যক্ত সকল এলাকা পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ও আওতাধীন করা।

৩। ১) ১৭ই আগষ্ট, ১৯৪৭ সাল হইতে যাহারা বেআইনীভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ করিয়া পাহাড় কিংবা ভূমি ক্রয়, বন্দোবস্ত ও বেদখল করিয়া অথবা কোন প্রকারের জমি বা পাহাড় ক্রয় বন্দোবস্ত বেদখল ছাড়াই বিভিন্ন স্থানে ও গুচ্ছগ্রামে বসবাস করিতেছে সেই সকল বহিরাগতদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে অন্যত্র সরাইয়া লওয়া।

২) ১৯৬০ সালের পর হইতে যে সকল নর নারী ভারতে চলিয়া যাইতে বাধ্য হইয়াছে তাহাদের সকলের সম্মানজনক                   প্রত্যাবর্তন ও সুষ্ঠূ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৩) কাপ্তাই বাঁধের সর্বোচ্চ জলসীমা নির্ধারণ করা। বাঁধে ক্ষতিগ্রস্থ উদ্ভাস্তুদের পুনর্বাসন দেওয়া।
৪) ক) সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (ই.উ.জ) ক্যাম্প ব্যতীত সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর সকল ক্যাম্প ও                                সেনানিবাস পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে তুলিয়া লওয়া।
খ) বহিঃশত্রুর আক্রমণ, যুদ্ধ বা জরুরী অবস্থা ঘোষণা ব্যতিত পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন সেনাবাহিনীর সমাবেশ না করা ও সেনানিবাস স্থাপন না করা।

৪। ১) ক) পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির সকল সদস্যের যথাযথ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা অবলম্বন করা।
খ) পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির কোন সদস্যের বিরুদ্ধে যদি কোন প্রকারের মামলা, অভিযোগ, ওয়ারেন্ট,  হুলিয়া থাকে অথবা কাহারও অনুপস্থিতিতে যদি কোন বিচার নিস্পন্ন হইয়া থাকে তাহা হইলে বিনা শর্তে সেইসব মামলা, অভিযোগ, ওয়ারেন্ট ও হুলিয়া প্রত্যাহার ও উক্ত বিচারের রায় বাতিল করা এবং  কাহারও বিরুদ্ধে কোন প্রকারের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ না করা।

গ) পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির কার্যকলাপে জড়িত করিয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যে যদি কাহারও বিরুদ্ধে কোন প্রকারের মামলা, অভিযোগ ও ওয়ারেন্ট থাকে অথবা কাহারও অনুপস্থিতিতে কোন বিচার নিস্পন্ন হইয়া থাকে তাহা  বিনা শর্তে সেই সব মামলা, অভিযোগ ও ওয়ারেন্ট প্রত্যাহার ও বিচারের রায় বাতিল করা এবং কাহারও বিরুদ্ধে কোন প্রকারের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ না করা।
২) ক) বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস ও প্রতিরক্ষা বাহিনীতে জুম্ম জনগণের জন্য নির্দিষ্ট কোটা সংরক্ষণ করা।
খ) বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, ক্যাডেট কলেজ, কারিগরী ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জুম্ম ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা এবং বিদেশে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা লাভের সুযোগ প্রদান করা।
গ) সরকারী চাকুরীতে জুম্ম জনগণের জন্য বয়ঃসীমা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করা।
 ৩)ক) সরকারী অনুদানে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা।
 খ) ভূমিহীন ও জুম চাষীদের (জুমিয়া) পুনর্বাসনসহ কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, রাস্তা-ঘাট প্রভৃতি খাতে বিশেষ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও তজ্জন্য সরকার কর্তৃক প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা।

৪) পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি পূর্ণাঙ্গ বেতার কেন্দ্র স্থাপন করা।
৫) পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড বহাল রাখা এবং উহা পরিষদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে আনা।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে অনুকুল পরিবেশ গড়িয়া তোলা একান্ত অপরিহার্য। তৎপরিপ্রেক্ষিতে-
১) সাজাপ্রাপ্ত বা বিচারাধীন বা বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর হেফাজতে আটককৃত সকল জুম্ম নর-নারীকে বিনা শর্তে অনতিবিলম্বে মুক্তি প্রদান করা।
২) পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনকে অনতিবিলম্বে বেসামরিকীকরণ করা।
৩) জুম্ম জনগণকে গুচ্ছগ্রাম, বড়গ্রাম, শান্তিগ্রাম, যুক্তগ্রাম ও আদর্শগ্রামের নামে গ্রুপিং করিবার কার্যক্রম বন্ধ করা এবং এই গ্রামসমূহ অনতিবিলম্বে ভাঙ্গিয়া দেওয়া।
৪) বাংলাদেশের অপরাপর অঞ্চল হইতে আসিয়া পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ, বসতি স্থাপন, পাহাড় ও ভূমি ক্রয়, বন্দোবস্ত, হস্তান্তর ও বেদখল বন্ধ করা।
৫) পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ও গুচ্ছগ্রামে বসবাসরত বহিরাগতদেরকে পর্যায়ক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে অনতিবিলম্বে অন্যত্র সরাইয়া লওয়া।
৬) সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (ইউজ) ক্যাম্প ব্যতীত অন্যান্য সামরিক আধা-সামরিক বাহিনীর সেনানিবাস ও ক্যাম্প সমূহ পর্যায়ক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে তুলিয়া লওয়া।

আঞ্চলিক পরিষদ সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা
১। আঞ্চলিক পরিষদ গঠন-
(১) (ক) এই আঞ্চলিক পরিষদ ‘‘জুম্মল্যান্ড আঞ্চলিক পরিষদ’’  নামে অভিহিত হইবে।
(খ) পরিষদ অনধিক ৪৮ সদস্য লইয়া গঠিত হইবে। তন্মধ্যে পরিষদের আসন নিম্নরূপ হইবে-
(১) কেবলমাত্র জুম্ম জনগণের জন্য ৩৫ (পঁয়ত্রিশ) টি সাধারণ আসন থাকিবে।
(২) চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ব্যতীত অন্যান্য সংখ্যালঘু জুম্ম জনগণের জন্য ৭ (সাত) টি আসন সংরক্ষিত থাকিবে।
(৩) বাংগালীদের জন্য ৩ (তিনটি) আসন সংরক্ষিত থাকিবে।
(৪) মহিলাদের জন্য ৩ (তিন)টি আসন সংরক্ষিত থাকিবে এবং তাহারা পরিষদের অন্যান্য সদস্যগণ কর্তৃক আইনানুযায়ী নির্বাচিত হইবেন।

(গ) মহিলা সদস্যগণ ব্যতিরেকে পরিষদের অন্যান্য সদস্যগণ একক নির্বাচনী এলাকা সমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত হইবেন।
(২) (ক) পরিষদের একটি কার্যনির্বাহী কাউন্সিল থাকিবে। কার্য নির্বাহী কাউন্সিলে কতজন সদস্য থাকিবেন তাহা পরিষদের চেয়ারম্যানই স্থির করিবেন। তবে শর্ত থাকে যে, পরিষদের সকল সদস্যের এক তৃতীয়াংশের অধিক সদস্য কার্যনির্বাহী কাউন্সিলে থাকিবে না।
(খ) পরিষদের প্রধান চেয়ারম্যান নামে অভিহিত হইবেন। তিনি আইন প্রণয়ন ও কার্য নির্বাহের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদান করিবেন।
(৩) নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে যে দল বা যাহারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করিবেন সেই দল বা তাহারা কার্য নির্বাহী কাউন্সিল গঠন করিবেন।
(৪) পরিষদের মেয়াদ ৫ (পাঁচ) বৎসর হইবে। পরিষদের প্রথম বৈঠকের দিন হইতে এই মেয়াদ কার্যকরী হইবে।
(৬) (ক) পরিষদ গঠনের উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ৪৫ (পঁয়তাল্লিশ) সংখ্যক নির্বাচনী এলাকায় এমনভাবে বিভক্ত করা যাহাতে নির্বাচনী এলাকার জনসংখ্যা অনুপাতের সামঞ্জস্যতা থাকে।
(খ) পরিষদের সংরক্ষিত আসন সমূহের নির্বাচনী এলাকা এমনভাবে বিভক্ত করিতে হইবে যাহাতে সংশ্লিষ্ট জাতি সমূহের সংখ্যাধিক্য থাকে।
(৭) নির্বাচনের পর পরিষদের প্রথম বৈঠকে পরিষদের সদস্যদের মধ্য হইতে পরিষদ একজন অধ্যক্ষ ও একজন উপ-অধ্যক্ষ নির্বাচিত করিবেন।
(৮) পরিষদের প্রশাসনিক ও অন্যান্য কাজ পরিচালনার জন্য বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মকর্তা ও কর্মচারী থাকিবেন।

২। পরিষদের সদস্যগণের যোগ্যতা অযোগ্যতা-
(১) কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক হইলে, পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসী হইলে, তাহার বয়স পঁচিশ বৎসর পূর্ণ হইলে এবং ২ (২) বর্ণিত বিধান সাপেক্ষে তিনি সদস্য নির্বাচিত হইবার যোগ্য হইবেন।
(২) কোন ব্যক্তি পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হইবার বা থাকিবার যোগ্য হইবেন না যদি-
(ক) তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেন বা হারান।
(খ) তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হইবার পর দায় হইতে অব্যাহতি লাভ না করিয়া থাকেন।
(গ) কোন উপযুক্ত আদালত তাহাকে অপ্রকৃতিস্থ বলিয়া ঘোষণা করেন।
(ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া কমপক্ষে দুই বৎসরের কারাদন্ডে দন্ডিত হন এবং তাহার মুক্তিলাভের পর ৫ (পাঁচ) বৎসর কাল অতিবাহিত হইয়া না থাকে।
(ঙ) তাহার কোন ব্যাংকে গৃহীত ঋণের মেয়াদ উত্তীর্ণ অবস্থায় তিনি অনাদায়ী থাকেন।
(চ) তিনি প্রজাতন্ত্রের বা পরিষদের বা অন্য কোন স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কোন কর্মে লাভজনক সার্বক্ষণিক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন।

৩। চেয়ারম্যান, অধ্যক্ষ, উপ-অধ্যক্ষ, নির্বাহী কাউন্সিল ও সাধারণ পরিষদ সদস্যগণের শপথ-
(১) চেয়ারম্যান তাহার কার্যভার গ্রহণের পূর্বে নির্ধারিত ফরমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক শপথ গ্রহণ করিবেন এবং শপথনামা পত্রে স্বাক্ষর প্রদান করিবেন।
(২) অধ্যক্ষ ও উপ-অধ্যক্ষ তাহার কার্যভার গ্রহণের পূর্বে নির্ধারিত ফরমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক শপথ গ্রহণ করিবেন এবং শপথনামা পত্রে স্বাক্ষর প্রদান করিবেন।
(৩) কার্যনির্বাহী কাউন্সিলের সদস্যগণ তাহাদের কার্যভার গ্রহণের পূর্বে নির্ধারিত ফরমে পরিষদ অধ্যক্ষ কর্তৃক শপথ গ্রহণ করিবেন এবং শপথনামা পত্রে স্বাক্ষর প্রদান করিবেন।

৪। পদ মর্যাদা-
চেয়ারম্যান, অধ্যক্ষ, উপ-অধ্যক্ষ, কার্যনির্বাহী কাউন্সিলের সদস্য ও পরিষদের সদস্যগণের পদ মর্যাদা নিম্নরূপ হইবে-
(১) চেয়ারম্যান- মন্ত্রী পদ মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধাদি
(২) অধ্যক্ষ- প্রতিমন্ত্রী পদ মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধাদি
(৩) উপ-অধ্যক্ষ- প্রতিমন্ত্রী পদ মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধাদি
(৪) কার্য নির্বাহী সদস্য- উপমন্ত্রী পদ মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধাদি
(৫) পরিষদের সদস্য- সচিব পদ মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধাদি

৫। সম্পত্তি সম্পর্কিত ঘোষণা-
চেয়ারম্যান, অধ্যক্ষ, উপ-অধ্যক্ষ ও পরিষদের প্রত্যেক সদস্য তাহার কার্যভার গ্রহণের পূর্বে তাহারও তাহার পরিবারের যে কোন সদস্যের স্বত্ব, দখল বা স্বার্থ আছে এই প্রকার যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির একটি লিখিত বিবরণ নির্ধারিত পদ্ধতিতে কর্তৃপক্ষের নিকট দাখিল করিবেন।
এখানে পরিবারের সদস্য বলিতে স্বামী বা স্ত্রী এবং তাহার সাথে বসবাসকারী ও তাহার উপর নির্ভরশীল ছেলেমেয়ে, পিতা-মাতা, ভ্রাতা ও ভগ্নি বুঝাইবে।

৬। চেয়ারম্যান, অধ্যক্ষ, উপ-অধ্যক্ষ ও পরিষদ সদস্যের পদ শূন্য হওয়া-
(১) চেয়ারম্যান পদ শূন্য হইবে যদি-
(ক) তিনি সরকারী গেজেটে তাহার নাম প্রকাশিত তারিখ হইতে ৩০(ত্রিশ) দিনের মধ্যে নির্ধারিত ফরমে শপথ গ্রহণে ব্যর্থ হন। তবে শর্ত থাকে যে, অনুরূপ মেয়াদ অতিবাহিত হইবার পূর্বে যথার্থ কারণে ইহা বর্ধিত করা যাইবে।
(খ) তিনি ২ (দুই) ধারার অধীনে তাহার পদে থাকিবার অযোগ্য হইয়া যান।
(গ) তিনি পদত্যাগ করেন।
(ঘ) তিনি পরিষদের সদস্য না থাকেন।
(ঙ) তিনি পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারান।
(চ) পরিষদ ভাঙ্গিয়া যায়।
(ছ) তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
(২) অধ্যক্ষ ও উপ-অধ্যক্ষের পদ শূন্য হইবে যদি-
(ক) তিনি পরিষদ সদস্য না থাকেন।
(খ) পদ হইতে তাহার অপসারণ দাবী করিয়া মোট পরিষদ সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সমর্থিত কোন প্রস্তাব পরিষদে গৃহীত হয়।
(গ) তিনি পদত্যাগ করেন।
(ঘ) তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
(ঙ) উপ-অধ্যক্ষের ক্ষেত্রে তিনি অধ্যক্ষের পদে যোগদান করেন,
(৩) কোন সদস্যের সদস্য পদ শূন্য হইবে যদি-
(ক) তিনি নির্ধারিত সময়ে মধ্যে শপথ গ্রহণ না করেন।
(খ) তিনি ২ (দুই) ধারার অধীনে তাহার পদে থাকিবার অযোগ্য হইয়া যান।
(গ) তিনি পদত্যাগ করেন।
(ঘ) তিনি মৃত্যু বরণ করেন।
(ঙ) তিনি পরিষদের সদস্য না থাকেন।
(চ) পরিষদের অনুমতি না লইয়া একাদিক্রমে ৬০ (ষাট) দিন অনুপস্থিত থাকেন।
(৪) চেয়ারম্যান পদত্যাগ করিলে বা স্বীয় পদে বহাল না থাকিলে কার্যনির্বাহী কাউন্সিলের অন্যান্য সদস্যগণ পদত্যাগ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।

৭। চেয়ারম্যান পদ অধ্যক্ষ পদ, উপ-অধ্যক্ষ পদ ও সদস্য পদ পূরণ করা-
(১) চেয়ারম্যান পদ শূণ্য হইলে পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যগণ তাহাদের মধ্য হইতে একজন সদস্যকে চেয়ারম্যান হিসাবে নির্বাচিত করিবেন। তাহা সম্ভব না হইলে পরিষদ ভাংগিয়া যাইবে।
(২) (ক) অধ্যক্ষের পদ শূণ্য হইলে বা কোন কারণে তিনি স্বীয় দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হইলে উপ-অধ্যক্ষ অধ্যক্ষ হিসাবে নির্বাচিত হইবেন।
(খ) উপ-অধ্যক্ষ পদ শূণ্য হইলে বা কোন কারণে তাহার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হইলে পরিষদের সদস্যগণ তাহাদের মধ্য হইতে একজনকে উপ-অধ্যক্ষ হিসাবে নির্বাচিত করিবেন।
(৩) কোন সদস্য পদ শূণ্য হইলে তাহা পূরণের জন্য সদস্যপদ শূণ্য হইবার দিন হইতে ৯০ (নব্বই) দিনের মধ্যে আইন ও বিধি মোতাবেক উপ-নির্বাচনের মাধ্যমে উক্ত শূণ্য পদ পূরণ করা যাইবে।

৮। পরিষদের সাধারণ নির্বাচন-
(১) পরিষদের মেয়াদ শেষ হইবার তারিখের পূর্ববর্তী ৯০ (নব্বই) দিনের মধ্যে পরিষদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।
(২) (ক) কোন ব্যক্তি একই সময়ে দুই বা ততোধিক নির্বাচনী এলাকার পরিষদ সদস্য হইবেন না।
(খ) যদি কোন ব্যক্তি একই সময়ে দুই বা ততোধিক নির্বাচনী এলাকা হইতে নির্বাচিত হন তাহা হইলে তিনি কোন নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধিত্ব করিতে ইচ্ছুক তাহা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বাক্ষরিত ঘোষণা প্রদান করিবেন এবং তিনি অন্য যে সকল নির্বাচনী এলাকা হইতে নির্বাচিত হইয়াছিলেন সেই সকল এলাকার আসন শূণ্য হইবে।
(গ) পরিষদের মেয়াদ শেষ হইবার আগে পরিষদ ভাংগিয়া গেলে উক্ত দিন হইতে ৯০ (নব্বই) দিনের মধ্যে পুনরায় পরিষদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।
(ঘ) (১) জাতীয় সংসদের নির্বাচনের জন্য আপাততঃ বলবৎ ভোটার তালিকার যে অংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত, ভোটার তালিকার সে অংশ পরিষদের সাধারণ নির্বাচন ও উপ-নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা হইবে।
(২) পরিষদের সাধারণ ও উপ-নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্বাচন কমিশন পরিষদের পরামর্শক্রমে নির্ধারণ করিবেন।
(৩) পরিষদ ভাংগিয়া যাওয়া ব্যতীত অন্য কারণে পরিষদের কোন সদস্য পদ শূণ্য হইলে পদটি শূণ্য হইবার ৯০ (নব্বই) দিনের মধ্যে উক্ত শূণ্যপদ পূরণ করিবার জন্য উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।

৯। নির্বাচন পরিচালনা-
(১) সংবিধান অনুযায়ী গঠিন নির্বাচন কমিশন এই আইন ও বিধি অনুযায়ী পরিষদের সাধারণ নির্বাচন ও উপ-নির্বাচন পরিচালনা করিবেন।
(২) নির্বাচন পরিচালনার উদ্দেশ্যে রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, প্রিজাইডিং অফিসার এবং পোলিং অফিসার নিয়োগ করা হইবে এবং আপাততঃ বলবৎ নির্বাচন কমিশনের বিধান অনুসারে তাহাদের ক্ষমতা ও দায়িত্ব নির্ধারিত হইবে।
(৩) পরিষদের সদস্য হিসাবে নির্বাচিত সকল ব্যক্তির নাম নির্বাচনের পর যথাশীঘ্র সম্ভব নির্বাচন কমিশন সহকারী গেজেট প্রকাশ করিবেন।

১০। পরিষদের কার্যপ্রনালী বিধি ও কোরাম-
(১) পরিষদ কর্তৃক প্রণীত কার্যপ্রণালী বিধি দ্বারা পরিষদের কার্যপ্রণালী নিয়ন্ত্রিত হইবে।
(২) উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পরিষদের সিদ্ধান্ত গৃহীত হইবে। তবে সমসংখ্যক ভোটের ক্ষেত্র ব্যতীত সভাপতি ভোটদান করিবেন না এবং অনুরূপ ক্ষেত্রে তিনি নির্ণায়ক ভোট প্রদান করিবেন।
(৩) পরিষদের বৈঠক চলাকালে কোন সময়ে উপস্থিত সদস্য সংখ্যা ১২ (বার) এর কম বলিয়া যদি সভাপতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় তাহা হইলে তিনি অন্যূন ১২ (বার) সদস্য উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত বৈঠক স্থগিত রাখিবেন কিংবা মুলতবী করিবেন।

১১। কার্যনির্বাহী কাউন্সিলের ক্ষমতা-
(১) সংশ্লিষ্ট আইনের অধীন যাবতীয় কার্যাবলী যথাযথ সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করিবার ক্ষমতা কার্যনির্বাহী কাউন্সিলের থাকিবে।
(২) পরিষদের কার্যনির্বাহী ক্ষমতা আইন, বিধি ও প্রবিধান অনুযায়ী চেয়ারম্যান কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে অথবা তাহার নিকট হইতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত অন্য কোন সদস্যের মাধ্যমে তাহা প্রযুক্ত হইবে।
(৩) কার্যনির্বাহী কাউন্সিল যৌথভাবে পরিষদের নিকট দায়ী থাকিবে।

১২। পরিষদের সভা ও কার্যাবলী নিষ্পন্ন-
(১) (ক) প্রতি বৎসর কমপক্ষে ৩ (তিন) বার পরিষদের অধিবেশন বসিবে।
(খ) পরিষদের অধ্যক্ষ ও তাহার অনুপস্থিতিতে উপ-অধ্যক্ষ পরিষদের অধিবেশন আহ্বান ও পরিচালনা করিবেন।
(গ) পরিষদের এক অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের মধ্যে ১২০ দিনের অতিরিক্ত বিরতি থাকিবে না।
(২) পরিষদের কার্যাবলী বিধি ও প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যে ও পদ্ধতিতে উহার বা উহার কমিটিসমূহের সভায় অথবা উহার চেয়ারম্যান, সদস্য, কর্মকর্তা ও কর্মচারী কর্তৃক নিষ্পন্ন করা হইবে।

১৩। কমিটি গঠন-
(১) পরিষদ উহার কাজের সহায়তার জন্য প্রয়োজনবোধে কমিটি গঠন করিতে পারিবে এবং উক্তরূপ কমিটির সদস্য সংখ্যা ও উহার দায়িত্ব, ক্ষমতা ও কার্যধারা নির্ধারণ করিতে পারিবে।
(২) পরিষদ অন্য কোন স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সহিত একত্রে উহার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়ের জন্য যুক্ত কমিটি গঠন করিতে পারিবে এবং অনুরূপ কমিটিতে উহার সংশ্লিষ্ট যে কোন ক্ষমতা প্রদান করিতে পারিবে।

১৪। পরিষদ ভাংগিয়া যাওয়া-
(১) নির্বাচনের ফল ঘোষিত হইবার প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে ৫ (পাঁচ) বৎসর অতিবাহিত হইলে পরিষদ ভাংগিয়া যাইবে।
(২) পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদসস্যের সমর্থন হারাইলে পরিষদের চেয়ারম্যান পদত্যাগ করিবেন কিংবা পরিষদ ভাংগিয়া দেওয়ার জন্য লিখিতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর নিকট পরামর্শ প্রদান করিবেন। সেক্ষেত্রে অন্য কোন পরিষদ সদস্য পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন নহেন এই মর্মে মন্ত্রী সন্তুষ্ট হইলে পরিষদ ভাংগিয়া দিবেন।
(৩) পরিষদের চেয়ারম্যানের উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত চেয়ারম্যান ও কার্যনির্বাহী কাউন্সিলের সদস্যগণ স্বীয় পদে বহাল থাকিতে পারিবেন।

১৫। চুক্তি ও দলিল-
(১) কার্যনির্বাহী কাউন্সিল কর্তৃক বা উহার পক্ষে সম্পাদিত সকল চুক্তি লিখিত হইতে হইবে এবং পরিরষদের নামে সম্পাদিত হইয়াছে বলিয়া প্রকাশিত হইতে হইবে।
(২) কার্য নির্বাহী কাউন্সিলের কর্তৃত্বে কোন চুক্তি বা দলিল প্রণয়ন বা সম্পাদন করিবার জন্য চেয়ারম্যান কিংবা কোন সদস্য কিংবা কোন ব্যক্তি ব্যক্তিগতভাবে দায়ী হইবেন না।
(৩) পরিষদ প্রস্তাবের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকারের চুক্তি সম্পাদনের জন্য পদ্ধতি নির্ধারণ করিতে পারিবে এবং চুক্তি সম্পাদনের ব্যাপারে উক্ত প্রস্তাব অনুযায়ী কার্যনির্বাহী কাউন্সিল কাজ করিবে।

১৬। নির্মাণ কাজ-
পরিষদ প্রবিধান দ্বারা সম্পাদিতব্য সকল প্রকারের নির্মাণ কাজের পরিকল্পনা ও আনুমানিক ব্যয়ের হিসাবসহ উক্ত পরিকল্পনা ও ব্যয় কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ও কি শর্তে অনুমোদিত হইবে প্রভৃতি সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি প্রণয়ন করিবার বিধান করিবে।

১৭। নথি পত্র-
পরিষদ উহার কার্যাবলীর নথিপত্র ইত্যাদি প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে প্রণয়ন, প্রকাশ ও সংরক্ষণ করিবে।

১৮। পরিষদের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাসহ অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ-
(১) পরিষদের প্রশাসনিক ও অন্যান্য কার্যাদি সম্পাদন ও পরিচালনার জন্য পরিষদ মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাসহ অন্যান্য বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদ সৃষ্টি করিবেন।
(২) (ক) পরিষদে সচিব সমতুল্য পদের একজন মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা থাকিবেন। তিনি অবশ্যই পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা ও জুম্ম জাতীয় হইবেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রীর পরামর্শক্রমে পরিষদ তাহার নিয়োগ প্রদান করিবেন।
(খ)(১) পরিষদ বিভিন্ন দপ্তরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্থায়ী কর্মকর্তা নিয়োগ করিবেন।
(২) যদি প্রয়োজনীয় সংখ্যক যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মকর্তা পাওয়া না যায় সেক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়কক মন্ত্রীর পরামর্শক্রমে সরকার হইতে প্রেষণে বিভিন্ন দপ্তরে কর্মকর্তা পরিষদ নিয়োগ করিবেন।
(গ) পরিষদ নিয়ম বিধি অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ করিবেন।
(৩) পরিষদ প্রবিধান দ্বারা উহার কর্তৃক নিযুক্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চাকুরীর শর্তাদি যেমন- যোগ্যতা, শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা, শাস্তি, শাস্তির বিরুদ্ধে আপীল, বদলী, তদন্ত পদ্ধতি, বরখাস্ত, অপসারণ ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিধান করিতে পারিবে।

১৯। পরিষদের তহবিলঃ
(১) ‘‘ আঞ্চলিক পরিষদ তহবিল’’ নামে পরিষদের একটি তহবিল থাকিবে।
(২) পরিষদের তহবিলের নিম্নলিখিত অর্থ জমা হইবে-
(ক) পরিষদের তহবিলের উদ্বৃত্ত অর্থ।
(খ) সরকার ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের অনুদান ও মজুরী।
(গ) পরিষদ কর্তৃক ধার্যকৃত কর, রেইট, টোল, ফিস, শুল্ক, রয়্যালটি ও অন্যান্য দাবী বাবদ প্রাপ্ত অর্থ।
(ঘ) পরিষদের উপর ন্যাস্ত এবং তৎকর্তৃক পরিচালিত সকল সম্পত্তি হইতে প্রাপ্ত আয় বা মুনাফা।
(ঙ) পরিষদের অর্থ বিনিয়োগ হইতে মুনাফা।
(চ) সরকারের নির্দেশে পরিষদের উপর ন্যস্ত অন্যান্য আয়ের উৎস হইতে প্রাপ্ত অর্থ।
(ছ) সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সমূহ হইতে প্রাপ্ত রয়্যালটি।
(জ) পরিষদ কর্তৃক প্রাপ্ত অন্য যে কোন অর্থ।
(৩) পরিষদের তহবিলে জমাকৃত অর্থ কোন সরকারী ট্রেজারী কিংবা সরকারী ট্রেজারীর কার্য পরিচালনাকারী কোন ব্যাংকে হইবে।
(৪) প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে পরিষদ উহার তহবিলের একটি অংশ বিনিয়োগ করিতে পারিবে।
(৫) পরিষদ ইচ্ছা করিলে কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে পৃথক তহবিল গঠন করিতে পারিবে এবং প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে উক্ত তহবিল পরিচালনা করিবে।
(৬) পরিষদের তহবিলের অর্থ পরিষদের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা, পরিষদের দায়িত্ব সম্পাদন ও কর্তব্য পালনে ব্যয়, পরিষদের তহবিলের উপর দায়মুক্ত ব্যয় ইত্যাতি খাতে ব্যয় করা যাইবে।

২০। ভবিষ্য তহবিল-
(১) পরিষদ উহার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য ভবিষ্য তহবিল গঠন করিতে এবং প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত হারে উক্ত তহবিলে চাঁদা প্রদান করিবার জন্য নির্দেশ দিতে পারিবে।
(২) পরিষদ উহার কর্মচারীদের জন্য প্রবিধান অনুযায়ী বদন্যা তহবিল গঠন করিতে পারিবে এবং কর্মচারীদেরকে গ্রাচুইটি ও অন্যান্য সাহায্য প্রদান করিতে পারিবে।

২১। পরিষদের তহবিলের হিসাব সংরক্ষণ ও পরীক্ষা-
(১) পরিষদের তহবিলের হিসাব বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে ও ফরমে সংরক্ষণ করা যাইবে।
(২) পরিষদের যাবতীয় আয়-ব্যয়ের হিসাব বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে ও নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের দ্বারা নিরীক্ষিত হইবে।

২২। পরিষদের সম্পত্তি-
(১) পরিষদের মালিকানাধীন যাবতীয় সম্পত্তি বা উহার উপর ন্যস্ত সম্পত্তি প্রবিধান দ্বারা ব্যবস্থাপনা, হস্তান্তর, রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য বিধান করিতে পারিবে।
(২) দান, বন্ধক, বিক্রয়, ইজারা বা বিনিয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোন পন্থায় যে কোন সম্পত্তি অর্জন বা হস্তান্তর করিতে পারিবে।

২৩। উন্নয়ন পরিকল্পনা-
পরিষদ উহার এখতিয়ারভূক্ত যে কোন বিষয়ে পরিষদের তহবিলের সংগতি অনুযায়ী ও সম্ভাব্য আয় বুঝিয়া উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রস্তুত ও বাস্তবায়িত করিতে পারিবে।

২৪। বাজেট প্রণয়ন ও অনুমোদন-
(১) প্রতি অর্থ বৎসর শুরু হইবার পূর্বে পরিষদ উহার তহবিল ও সম্ভাব্য আয়ের সংগতি রাখিয়া উক্ত বৎসরের বাজেট বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে প্রণয়ন ও অনুমোদন করিবে।
(২) এই আইন মোতাবেক গঠিত পরিষদ প্রথমবার যে অর্থ দায়িত্বভার গ্রহণের পর অর্থ বৎসরটি অবশিষ্ট সময়ের জন্য পরিষদ কর্তৃক প্রণীত ও অনুমোদিত হইবে।

২৫। পরিষদ কর্তৃক আরোপনীয় কর-
(১) কোন প্রকারের আয় কর আইন পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হইবে না।
(২) পরিষদ কর্তৃক বর্ণিত সকল অথবা যে কোন কর, রেইট, টোল, ফিস, শুষ্ক, রয়্যালটি ও অন্যান্য দাবী প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে আরোপ করিতে পারিবে।
(৩) পরিষদের সকল প্রকারের কর, রেইট, টোল, ফিস, শুষ্ক, রয়্যালটি ও অন্যান্য নির্ধাারিত ব্যক্তি কর্তৃক ও নির্ধারিত পদ্ধতিতে প্রজ্ঞাপিত হইবে।
(৪) পরিষদ কর্তৃক আরোপিত সকল কর, রেইট, টোল, ফিস, শুষ্ক, রয়্যালটি ও অন্যান্য দাবী প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে প্রজ্ঞাপিত হইবে।
(৫) পরিষদ কর্তৃক ধার্য্যকৃত সকল কর, রেইট, টোল, ফিস, শুষ্ক, রয়্যালটি ও অন্যান্য দাবী প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে ধার্য্য ও নিয়ন্ত্রণ করা যাইবে।

২৬। পরিষদ কর্তৃক বিধি ও প্রবিধান প্রণয়ন করিবার ক্ষমতা-
(১) এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে পরিষদ উহার তালিকাভূক্ত বিভিন্ন বিষয়ে এই আইনের সহিত অসামঞ্জস্য না হয় এইরূপ বিধি, প্রবিধান, উপ-বিধি, উপ-আইন, নিয়ম ও আদেশ ইত্যাদি প্রণয়ন, জারী ও কার্যকর করিবার ক্ষমতার অধিকার থাকিবে।
(২) পরিষদ কর্তৃক প্রণীত সকল বিধি, প্রবিধান, উপ-বিধি, উপ-আইন, নিয়ম আদেশ ইত্যাদি সরকারি গেজেট বিনাবিলম্বে প্রকাশিত হইবে এবং এইরূপে প্রকাশিত হইলে উহারা কার্যকারী হইবে।

২৭। পুলিশ-
(১) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের লইয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম পুলিশ গঠন করা।
(২) পার্বত্য চট্টগ্রাম পুলিশের ইনসপেক্টর ও তদনিম্ন স্তরের সকল সদস্য পরিষদ কর্তৃক প্রণীত বিধি দ্বারা নিযুক্ত হইবেন এবং পরিষদ প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে তাহাদের বদলী ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে।
(৩) পরিষদ কর্তৃক নিযুক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম পুলিশের সকল কর্মকর্তা ও সদস্যের চাকুরীর শর্তাবলী, তাহাদের প্রশিক্ষণ, সাজ-সজ্জা, দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং তাহাদের পরিচালনা বাংলাদেশের অন্যান্য জেলা পুলিশের অনুরূপ হইবে।
(৪) পার্বত্য চট্টগ্রামের পুলিশের সকল স্তরের কর্মকর্তা ও সদস্যগণ তাহাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে পরিষদের নিকট দায়ী থাকিবেন।

২৮। ভূমি হস্তান্তরের বাধা নিষেধ-
(১) পরিষদের এলাকাধীন পাহাড় ও সকল প্রকারের জায়গা জমি পরিষদের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে বন্দোবস্ত দেওয়া যাইবে না।
(২) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসী নন এমন কোন ব্যক্তির নিকট পাহাড় ও কোন প্রকারের জমি দান, হস্তান্তর, বিক্রি বা বন্দোবস্ত দেওয়া যাইবে না।
(৩) পরিষদের এলাকাধীন কোন পাহাড়, বনাঞ্চল ও কোন প্রকারের জমি পরিষদের পরামর্শ ও সম্মতি ব্যতিরেকে রাষ্ট্রীয় বা জনস্বার্থের প্রয়োজনে সরকার কর্তৃক হস্তান্তরিত বা অধিগ্রহণ করা যাইবে না।

২৯। বিচার ও বিরোধ বিষ্পত্তি সংক্রান্ত-
(১) পার্বত্য চট্টগ্রামের বাংগালী ব্যতিরেকে ভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসমূহের জন্য আঞ্চলিক পরিষদের অধীনে একটি বিচার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা। তদুদ্দেশ্যে-
(ক) গ্রাম আদালত
(খ) ইউনিয়ন আদালত
(গ) জেলা আদালত
(ঘ) পরিষদীয় আদালত
স্থাপন করা এবং এই সব আদালতের জন্য পরিষদ কর্তৃক প্রয়োজনীয় আইন ও কার্যবিধি প্রণয়ন করা।
(২) জুম্ম জনগণের সম্পত্তির উত্তরাধিকার, বিবাহ ও বিবাহ-বিচ্ছেদ, সামাজিক রীতি-নীতি, প্রথা ইত্যাদি জুম্ম জাতীয় ক্ষেত্রে কোন মামলা মোকদ্দমা উদ্ভব হইলে উক্ত মামলা মোদ্দমাসহ অন্যান্য সকল দেওয়ানী মামলা মোকদ্দমা পরিষদের আওতাধীন আদালতে বিচার নিষ্পন্ন হইবে।
(৩) গ্রাম আদালতের সিদ্ধান্ত বা রায়ের বিরুদ্ধে ইউনিয়ন আদালতে, ইউনিয়ন আদালতের সিদ্ধান্ত বা রায়ের বিরুদ্ধে জেলা আদালতে এবং জেলা আদালতের সিদ্ধান্ত বা রায়ের বিরুদ্ধে পরিষদীয় আদালতে আপীল করা যাইবে।
(৪) পরিষদীয় আদালতের সিদ্ধান্ত বা রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপীল করা যাইবে এবং হাইকোর্টের রায় চূড়ান্ত হইবে। তবে শর্ত থাকে যে যদি সংশ্লিষ্ট বিরোধ বা মামলা জুম্ম জাতীয় বিষয়ক হইয়া থাকে তাহা হইলে আপীল নিষ্পত্তির পূর্বেই হইকোর্ট সংশ্লিষ্ট জাতি হইতে অন্যূন তিনজন বিজ্ঞ বক্তির পরামর্শ গ্রহণ করিবেন।
(৫) ২৯(২) তে বর্ণিত ভিত্তিতে জুম্ম নহে এমন কোন ব্যক্তির সাথে কোন বিরোধ বা মামলা দেখা দিলে সেই বিরোধ বা মামলা পরিষদ আওতাধীন আদালত কর্তৃক নিষ্পন্ন করা হইবে। তবে শর্ত থাকে যে, উক্ত বিরোধ বা মামলা পরিষদের আওতাধীন কোন আদালতে নিষ্পত্তি করা হইবে তাহা পরিষদ নির্ধারণ করিবেন।
(৬) রাষ্ট্রে বলবৎ আইন ও দন্ডবিধি অনুসারে সকল প্রকারের ফৌজদারী মামলা ও মোকদ্দমা রাষ্ট্রে বিদ্যমান আদালতসমূহ কর্তৃক বিচার নিষ্পন্ন হইবে।
(৭) পরিষদ প্রবিধান দ্বারা এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত বিরোধ বা মামলা নিষ্পত্তির জন্য-
(ক) বিচার পদ্ধতি
(খ) নিয়ম বিধি
(গ) বিচার প্রার্থী ও আপীলকারী কর্তৃক প্রদেয় ফিস নির্ধারণ করিবে।

৩০। পরিষদের কার্যাবলী-
নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ পরিষদ কর্তৃক পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে-
(১) পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা
(২) জেলা পরিষদ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, ইম্প্রভমেন্ট ট্রাষ্ট ও অন্যান্য স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান।
(৩) (ক) পার্বত্য চট্টগ্রামের পুলিশ বাহিনী পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ।
(খ) পুলিশের ইন্সপেক্টর ও তদনিম্ন স্তরের সকল সদস্য পরিষদ কর্তৃক প্রণীত বিধি দ্বারা নিয়োজিত হইবেন। পরিষদ তাহাদের পদোন্নতি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বিধি দ্বারা নিয়োজিত হইবেন। পরিষদ তাহাদের বদলী, পদোন্নতি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে করিবেন।
(গ) পরিষদ কর্তৃক নিযুক্ত পুলিশের সকল কর্মকর্তা ও সদস্যদের চাকুরীর শর্তাবলী, প্রশিক্ষণ, সাজ-সজ্জা, দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং পরিচালনা বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর অনুরূপ হইবে।
(ঘ) পার্বত্য চট্টগ্রাম পুলিশের সকল স্তরের কর্মকর্তা ও সদস্যগণ তাহাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে পরিষদের নিকট দায়ী থাকিবেন এবং কোন অপরাধ সংঘটিত হইলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।
(৪) ভূমি-
(ক) ভূমি ক্রয়-বিক্রয় ও বন্দোবস্ত এবং দলিল পত্র রেজিষ্ট্রেশন।
(খ) পরিষদের আওতাধীন পাহাড় ও সকল শ্রেণীর ভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসী নন এই রকম কোন ব্যক্তির নিকট বিক্রয়, বন্দোবস্ত ও যে কোন প্রকারের হস্তান্তর বন্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করা।
(গ) ভূমি সংরক্ষণ ও উন্নয়ন।
(৫) শিক্ষা-
(ক) কলেজ, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা।
(খ) মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকরণ।
(গ) ছাত্র বৃত্তি, ছাত্রাবাস, বিদ্যালয় স্থাপন, বয়স্ক শিক্ষা, বৃত্তিমূলক শিক্ষা, সাধারণ পাঠাগার।
(৬) কৃষি, কৃষি ও উদ্যান উন্নয়ন।
(৭) (ক) বন সম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন।
(খ) সংরক্ষিত (জবংবৎাবফ) বনসহ অন্যান্য সকল শ্রেণীর বন সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ।
(৮) গণস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং হাসপাতাল, ডিসপেনসারী ও চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ।
(৯) পশু পালন ও উন্নয়ন এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ।
(১০) মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ।
(১১) (ক) ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ।
(খ) স্থানীয় শিল্পের জন্য শ্রমিকের প্রশিক্ষণ প্রদান।
(১২) (ক) ব্যবসা বাণিজ্য।
(খ) বাজার দর নিয়ন্ত্রণ।
(গ) স্থানীয় শিল্প সমূহের জন্য কাঁচামাল সংগ্রহ ও উৎপাদিত সামগ্রী বাজারজাতকরণ।
(ঘ) স্থানীয় ভিত্তিক বাণিজ্য প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
(১৩) রাস্তাঘাট, খেয়াঘাট, পুল ও অন্যান্য যাতায়াত ব্যবস্থা সংরক্ষণ ও উন্নয়ন।
(১৪) যোগাযোগ ও পরিবহণ।
(১৫) পর্যটন।
(১৬) সমবায় উন্নয়ন ও জনপ্রিয়করণ।
(১৭) হাট-বাজার ও মেলা স্থাপন, নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণাবেক্ষণ।
(১৮) সংস্কৃতি-
(ক) সাধারণ ও জুম্ম সংস্কৃতিমূলক কর্মকান্ড সংগঠন।
(খ) জুম্ম জনগণের ভাষা, সাহিত্য, অভ্যাস ইত্যাদি সংরক্ষণ ও বিকাশ সাধন।
(গ) যাত্রা, প্রমোদানুষ্ঠান, প্রদর্শনী, জাতীয় দিবস ও অন্যান্য উৎসব উদযাপন, তথ্য কেন্দ্র স্থাপন ও সংরক্ষণ, লাইব্রেরী স্থাপন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা কৃষি, সমাজ উন্নয়ন প্রভৃতি বিষয়ক তথ্য প্রচার, যাদুঘর ও আর্ট গ্যালারী স্থাপন, শরীর চর্চাসহ সংস্কৃতিমূলক অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ।
(ঘ) উদ্যান ও খেলার মাঠের ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ।
(১৯) পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ।
(২০) (ক) জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা।
(খ) জন্ম -মৃত্যু পরিসংখ্যাণ সংরক্ষণ।
(২১) গোরস্থান ও শ্মশান স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ।
(২২) আইন ও বিচার-
(ক) পরিষদ এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণ কল্পে প্রয়োজনীয় আইন, বিধি ও প্রবিধান প্রণয়ন করিবে।
(খ) দেওয়ানী মামলা মোকদ্দমা পরিষদের আওতাধীন আদালত কর্তৃক বিচার নিস্পন্ন করা হইবে।
(গ) (ফৌজদারী মামলা মোকদ্দমা রাষ্ট্রে বিদ্যমান আদালতসমূহ কর্তৃক নিস্পন্ন করা হইবে।
(২৩) কর সংক্রান্ত-
(ক) ভূমি রাজস্ব ধার্য ও আদায়করণ।
(খ) স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন ও প্রস্তুতজাত নিম্নোক্ত দ্রব্যদির উপর আবগারী শুল্ক ধার্য ও আদায়করণ-
(১) ব্যবসার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত মদ্য।
(২) আফিং, গাঁজা ও অন্যান্য মাদক দ্রব্য।
(গ) নিম্নোক্ত ক্ষেত্র হইতে পরিষদ কর্তৃক কর, টোল, ফিস, শুল্ক, রয়্যালটি আরোপ ও আদায়করণ।
(১) ভূমি ও দালান কোঠা;
(২) কোন বাজারে বিক্রয়ার্থে প্রবেশের জন্য ভোগ ও ব্যবহারের জন্য দ্রব্যাদির উপর;
(৩) পণ্য ক্রয় ও বিক্রয়ের উপর;
(৪) যানবাহনের উপর;
(৫) গৃহপালিত পশু বিক্রয়ের উপর;
(৬) রাস্তা, পুল ও ফেরীর উপর টোল;
(৭) বিজ্ঞাপনের উপর;
(৮) পরিষদ কর্তৃক স্থাপিত বা পরিচালিত স্কুলের ফিস;
(৯) জন কল্যাণমূলক কাজ সম্পাদনের জন্য রেইট;
(১০) পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত কোন বিশেষ সেবার জন্য ফিস;
(১১) বৃত্তি, পেশা ও ব্যবসার উপর;
(১২) বিলাস দ্রব্য ও লটারী;
(১৩) স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের উপর;
(১৪) বনজ সম্পদের উপর;
(১৫) মামলা মোকদ্দমার ফিস;
(১৬) সরকারী ও বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের উপর;
(১৭) খনিজ সমূহের অন্বেষণ বা নিস্কর্ষনের উদ্দেশ্যে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত অনুজ্ঞা পত্র বা পাট্টা সমূহ হইতে প্রাপ্ত রয়্যালটি অংশ বিশেষ;
(১৮) পরিষদ কর্তৃক জন কল্যাণমূলক কাজ হইতে প্রাপ্ত উপকার গ্রহণের জন্য ফিস;
(১৯) সিনেমা, যাত্রা, সার্কাস ইত্যাদির উপর প্রমোদ কর।
(২৪) (ক) সমাজ কল্যাণ ও সমাজ উন্নয়ন।
(খ) গ্রাম উন্নয়ন ও গণ সংযোগ।
(২৫) অর্থ সংক্রান্ত লেন-দেন।
(২৬) যুব কল্যাণ ও ক্রীড়া-
(ক) যুব সমাজের উন্নয়ন;
(খ) ক্রীড়া ও খেলাধুলার উন্নয়ন ও প্রতিযোগিতা।
(২৭) ডাকবাংলা, সরাইখানা, কমিউনিটি সেন্টার, পাবলিক হল, বিশ্রামাগার, জনসভার স্থান স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ।
(২৮) দাতব্য প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, উপাসনাগার স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ।
(২৯) মহাজনী কারবার ও ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ।
(৩০) জুম চাষ নিয়ন্ত্রণ ও জুম চাষীদের (জুমিয়া) পুনবার্সন।
(৩১) ব্যবসার উদ্দেশ্যে মদ চোলাই, উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয় ও সরবরাহ।
(৩২) নদী-নালা, খাল-বিল ও কাপ্তাই হ্রদের জল সম্পদ সুষ্ঠু ব্যবহার ও সেচ ব্যবস্থা।
(৩৩) পরিবেশ সংক্রান্ত।
(৩৪) (ক) পরিষদের সদস্যগণের বেতন ও ভাতা ইত্যাদি;
(খ) পরিষদের চেয়ারম্যান, অধ্যক্ষ, উপ-অধ্যক্ষ ও কার্যনির্বাহী কাউন্সিলের সদস্যগণের বেতন ও ভাতা ইত্যাদি;
(গ) জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণের বেতন ও ভাতা ইত্যাদি;
(ঘ) ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণের বেতন ও ভাতা ইত্যাদি।
(৩৫) কারাগার নিয়ন্ত্রণ।

৩১। পরিষদের বিরুদ্ধে বা পরিষদ সংক্রান্ত কোন কাজের জন্য মামলা পদ্ধতিগতভাবে দায়ের করা যাইবে।

জেলা পরিষদ

১। (১) পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যেকটি জেলায় একটি করিয়া জেলা পরিষদ
থাকিবে।
(২) জেলা পরিষদ অনধিক ২৪ সদস্য লইয়া গঠিত হইবে। আঞ্চলিক পরিষদের আসনসমূহ যেভাবে নির্ধারণ করা হইবে উহার সহিত সংগতি রাখিয়া ও তিনটি জেলার ভিন্ন ভাষাভাষি জুম্ম জনগণের বসবাসের বৈশিষ্ট্য বিচার করিয়া পরিষদ গঠিত হওয়ার পর জেলা পরিষদের আসনসমূহ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রীর পরামর্শক্রমে পরিষদ কর্তৃক নির্ধারণ করা হইবে।
(৩) জেলা পরিষদে মহিলাদের জন্য তিনটি আসন সংরক্ষিত থাকিবে। তাহারা অন্যান্য সদস্যগণ কর্তৃক নির্বাচিত হইবেন।
(৪) জেলা পরিষদ গঠনের উদ্দেশ্যে জেলাকে ২১ সংখ্যক নির্বাচনী এলাকায় এমনভাবে বিভক্ত করা যাহাতে যথাসম্ভব নির্বাচনী এলাকার জনসংখ্যা অনুপাতের সামঞ্জস্য থাকে এবং সংরক্ষিত আসন সমূহের (যদি সংরক্ষিত থাকে) নির্বাচনী এলাকা এমনভাবে বিভক্ত করা যাহাতে সংশ্লিষ্ট জাতি সমূহের সংখ্যাধিক্য থাকে।
(৫) জেলা পরিষদের সদস্যগণ একক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হইবেন।
(৬) জেলা পরিষদের মেয়াদ ৫ বৎসর হইবে।
(৭) নির্বাচন কমিশন আইন ও বিধি অনুযায়ী জেলা পরিষদের সাধারণ নির্বাচন ও উপ-নির্বাচন পরিচালনা করিবেন। জেলা পরিষদের সদস্য হিসাবে সকল ব্যক্তির নাম নির্বাচনের পর যথাশীঘ্র সম্ভব নির্বাচন কমিশন সরকারী গেজেটে প্রকাশ করিবেন।
(৮) জেলা পরিষদের প্রধান চেয়ারম্যান নামে অভিহিত হইবেন। তিনি জেলা পরিষদের সদস্যগণ কর্তৃক নির্বাচিত হইবেন।
(৯) জেলা পরিষদের সদস্যগণের যোগ্যতা সংক্রান্ত বিষয়াদি পরিষদের সদস্যগণের অনুরূপ হইবে।
(১০) জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জেলা পরিষদের সভা আহবান ও পরিচালনা করিবেন।
(১১) জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণের পদ মর্যাদা নিম্নরূপ হইবে-
(ক) চেয়ারম্যান, উপমন্ত্রী পদ মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধাদি
(খ) সদস্য, উপ সচিব পদ মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধাদি।
(১২) জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি কর্তৃক শপথ গ্রহণ করিবেন এবং শপথ নামায় স্বাক্ষর প্রদান করিবেন।
২। পরিষদ কর্তৃক বিধি দ্বারা জেলা পরিষদের কার্য প্রণালী নিয়ন্ত্রিত হইবে।
৩। জেলা পরিষদের একটি কার্যালয় থাকিবে। এই কার্যালয়ের বিভিন্ন দপ্তরের দায়দায়িত্ব সম্পদনার্থে বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মচারী পরিষদ কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন। পরিষদ কর্তৃক প্রণীত প্রবিধান দ্বারা এই সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চাকুরীর শর্তাবলী নির্ধারিত হইবে।
৪। জেলা পরিষদ পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ও আওতাধীন বিভিন্ন বিষয় সংক্রান্ত কার্যাবলী ও তৎপ্রেক্ষিতে পরিষদ কর্তৃক গৃহীত কার্যক্রমসহ সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদের উপর ন্যস্ত অন্যান্য সকল বিষয় ও আদেশ কার্যকর করিবার ক্ষমতার অধিকারী হইবে।
৫। জেলা পরিষদ উহার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পাদনে পরিষদের নিকট দায়ী থাকিবে।

ইউনিয়ন পরিষদ

ইউনিয়ন পরিষদের গঠন, নির্বাচন, দায়িত্ব, কর্তব্য ও ক্ষমতা, মেয়াদ প্রভৃতি সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রীর পরামর্শক্রমে পরিষদ কর্তৃক নির্ধারিত হইবে।

পৌরসভা

পৌরসভার গঠন, নির্বাচন, দায়িত্ব, কর্তব্য ও ক্ষমতা, মেয়াদ প্রভৃতি সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রীর পরামর্শক্রমে পরিষদ কর্তৃক নির্ধারিত হইবে।

দ্রষ্টব্যঃ ৪ঠা ডিসেম্বর, রোজ শুক্রবার, ১৯৯২ সন পার্বত্য চট্টগ্রাম যোগাযোগ কমিটির মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিকট পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কর্তৃক সংশোধিত পাঁচদফা দাবীনামাসহ আঞ্চলিক পরিষদ সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা পেশ করা হয়।
(তথ্যসূত্র- প্রচারপত্র, তথ্য ও প্রচার বিভাগ, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি)

১৯৯২ সালে জনসংহতি সমিতির সংশোধিত পাঁচদফা দাবীনামার ভিত্তিতেই সরকার এবং জনসংহতি সমিতি আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকে এবং ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি।

১৯৭২ সালে জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগপর্যন্ত সময়ে জনসংহতি সমিতি ৮০ দশকের সামরিক শাসক এরশাদ সরকার, ৯০ এ এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার সরকার এবং

১৯৯৬ এ শেখ হাসিনা সরকার সব সরকারের আমলেই জনসংহতি সমিতি আনুষ্ঠানিক আলোচনা চালিয়ে গিয়েছিল। সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালের ২১ অক্টোবর,এরশাদ সরকারের সময়।

পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগপর্যন্ত বিভিন্ন সরকারের সাথে জনসংহতি সমিতির কমপক্ষে ২৬ টি আনুষ্ঠানিক বৈঠকের তথ্য পাওয়া যায়।

এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে জনসংহতি সমিতি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়ার পরপরেই ৬০ দশকে প্রতিষ্ঠিত পাহাড়ী ছাত্র সমিতির কার্যক্রম প্রকাশ্যে পরিচালনা করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে।

বলা যায় যে, ৬০ দশকের পাহাড়ী ছাত্র সমিতির ছাত্র নেতারাই ৭০ দশকের জনসংহতি সমিতির নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৭৩ থেকে জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র লড়াইকালীন সময়ে বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জুম্ম শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্নভাবে ছাত্র সংগঠন বা বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের অস্তিত্ব ছিল।

পরবর্তীতে ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা থেকেই ১৯৮৯ সালে গড়ে তোলে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ। জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামের পাশাপাশি ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ মূলত গণতান্ত্রিকভাবে রাজপথের লড়াই চালিয়ে গিয়েছিল।

আমাদের জুম্ম জাতীয় জীবনের দুর্ভাগ্য এই যে, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে ছাত্র সমাজের একাংশ এই চুক্তির বিরোধিতা করে অধিকতর অধিকারের কথা প্রচার করতে থাকে।

পরবর্তীতে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের একাংশ এবং পাহাড়ী গণপরিষদের একাংশ মিলে ১৯৯৮ সালে ইউপিডিএফ গঠন করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, পাহাড়ী গণপরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালে যার আহবায়ক ছিলেন বিজয়কেতন চাকমা।

১৯৯৫ সালে পাহাড়ি গণপরিষদের সভাপতি হন প্রসীত বিকাশ খীসা। প্রসীত বিকাশ খীসা ১৯৯২ সালে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সভাপতি ছিলেন। মূলত প্রসীতবিকাশ খীসার নেতৃত্বেই গঠিত হয় ইউপিডিএফ।

১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের ঐক্যবদ্ধ লড়াই সংগ্রামে ফাটল ধরানোর চেষ্টায় শাসকশ্রেণীর ষড়যন্ত্র যুগে যুগে অব্যাহত ছিল।

শাসকশ্রেণী জুম্ম জনগণের লড়াই সংগ্রাম বানচাল করে দেওয়ার জন্য যুগে যুগে দালালশ্রেণী তৈরী করেছে। জুম্ম জনগণের মধ্যে বিভক্তি-বিভাজন সৃষ্টি করার জন্য নানান ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পেতেছে। এখনো অব্যাহত রয়েছে শাসকশ্রেণীর ষড়যন্ত্র।

জুম্ম জাতীয় জীবনে বিভক্তি বিভাজনের প্রথম কালো অধ্যায় ১৯৮২-৮৩ সালের গৃহযুদ্ধ, যার মধ্য দিয়ে জুম্ম জনগণের লড়াই সংগ্রামে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তারিত হয়েছে, জুম্ম জাতি হারিয়েছে জাতীয় জাগরণের পুরোধা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে।

পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালের চুক্তিকে কেন্দ্র করে ছাত্র-তরুণ সমাজের মধ্যে বিভক্তি জাতিকে ঠেলে দিয়েছে আরো এক ভীষণ কালো অধ্যায়ে। তারপরেও শাসকশ্রেণী মোক্ষম আঘাত হানার চেষ্টা থেমে রাখে নি।

ফলশ্রুতিতে ২০০৭ সালের জরুরি অবস্থার সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে পুনরায় ফাটল ধরানোর ষড়যন্ত্র পরিচালিত হয়। পার্টি হিসেবে জনসংহতি সমিতি এবং সামগ্রিক বিবেচনায় জুম্ম জাতীয় আন্দোলন আরো একবার বিভেদের মুখে পড়ে।

জনসংহতি সমিতির একাংশ ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এম এন লারমা’ নাম দিয়ে রাজনীতি শুরু করে। অতি সম্প্রতি ইউপিডিএফও দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।

এমতাবস্থায় জুম্ম জনগণের লড়াই-সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথমেই দরকার জুম্ম জাতীয় ঐক্য।

জুম্ম জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করতে হলে জুম্ম জনগণকে অত্যাবশ্যকভাবে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বিশ্বের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতির আলোকে জুম্ম জনগণের জন্য সঠিক রাজনৈতিক লাইন চিহ্নিত করে নতুন করে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে হবে।

প্রস্তুতি নিতে হবে মরণপণ লড়াইয়ের। অন্যথায় জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব অচিরেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বাধ্য।

সমাজবিকাশের নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। রাজনৈতিক দলের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয় সমাজকে কেন্দ্র করে এবং সমাজের জন্যই। তাই জাতীয় সংগ্রাম পরিচালনায় রত রাজনৈতিক দলকেও পরিচালিত হতে হয় সমাজবিকাশের নির্দিষ্ট নিয়মকে অনুসরণ করেই।

একটি রাজনৈতিক দলের তাত্ত্বিক এবং মতাদর্শগত ভিত্তি কতটা মজবুত তার উপর সেই রাজনৈতিক দলের বিকাশ এবং গতিশীলতা নির্ধারিত হতে বাধ্য। সঠিক রাজনৈতিক দর্শন বা মতাদর্শগত ভিত্তি ছাড়া কোন রাজনৈতিক দল খুব বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারে না।

অন্যদিকে তাত্ত্বিকভাবে বলিষ্ঠ ইশতেহার বিদ্যমান কিন্তু বাস্তব চর্চাক্ষেত্রে দুর্বলতা থাকলে সেই রাজনৈতিক দলের বিকাশ এবং গতিশীলতাও খুব স্বাভাবিকভাবেই নড়বড়ে হবে।

জুম্ম ছাত্র-যুব সমাজকে তাঁর ঐতিহাসিক দ্বায়িত্ব বুজে নিতে হবে। সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে রাজনৈতিক উপায়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগঠিত প্রচেষ্টায় প্রজন্মের জুম্ম ছাত্র-যুব সমাজ সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সকলক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে সংগ্রাম পরিচালনা করতে পারলে জুম্ম জাতীয় জীবনে আশার আলো সঞ্চারিত হতে পারে।

তার জন্য তরুণ সমাজের অর্জন করতে হবে দৃঢ়প্রত্যয়ী রাজনৈতিক চেতনা, পরিচালনা করতে হবে সংকল্পবদ্ধ রাজনৈতিক প্রচেষ্টা। এককথায় দৃঢ়প্রত্যয়ী, সংকল্পবদ্ধ, সাহসী এবং আত্মত্যাগী জুম্ম ছাত্র-যুব সমাজই জুম্ম জাতিকে মুক্তির পথ দেখাতে পারে।

আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে- কেবল গগনবিদারী স্লোগান, জ্বালাময়ী বকৃতা কিংবা লালব্যানার সহিত নিত্যনৈমিত্তিক মিটিং-মিছিল কেই রাজনৈতিক সংগ্রাম বলা হয় না। আত্মত্যাগের অর্থ কেবল এই নয় যে, বুক চাপড়িয়ে চাপড়িয়ে বলে দিলাম- “থিগেত মুড়ি পারিম”।

রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রাম এর অর্থ নিশ্চয়ই ব্যাপক যার অন্তর্নিহিত সার হচ্ছে সমাজ জীবনে নানামুখী কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে সমাজ বিকাশের গতিকে সঠিকভাবে পরিচালিত করার জন্য বহুমুখী, সুসংবদ্ধ এবং ধারাবাহিক সংগ্রাম পরিচালনা করা।

আজকের একবিংশ শতাব্দীর জুম্ম ছাত্র-যুব সমাজের ভাবনায় বৈচিত্র্য থাকবে। সৃজনশীলতা থাকবে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ছাত্র-যুবসমাজকে জাতীয় সংগ্রামের সঠিক ইতিহাস জানার চেষ্টা করতে হবে।

নিজেদের লক্ষ্যে হতে হবে অবিচল। পরিচালনা করতে হবে দুর্নিবার লড়াই-সংগ্রাম। যে লড়াই-সংগ্রাম সর্বদা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা যুগ-যুগান্তরের জুম-পাহাড়ের বুকে জারি রাখবে রুনু খাঁর দুর্বার প্রতিরোধ সংগ্রাম, রানী কালিন্দীর গৌরবজ্জ্বল স্বজাত্যবোধ, স্নেহকুমার চাকমার ঐতিহাসিক  স্বদেশপ্রেম এবং লারমার আত্মত্যাগী রাজনৈতিক চেতনা…

জুম্ম জাতির জয় অনিবার্য


লেখকঃ কজমিলিক্ক্য চাঙমা


সহায়ক গ্রন্থাবলী:

১. ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে চাকমা জাতির প্রতিরোধ সংগ্রাম, অধ্যাপক ড: সুনীতিভুষণ কানুনগো, এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাইন্ডেশন, ২০১৬
২. পার্বত্য চট্টগ্রাম আইন সংহিতা, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, ২০১০
৩. স্মারক গ্রন্থ, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জীবন ও সংগ্রাম, এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন, ২০০৯
৪. পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা, প্রদীপ্ত খীসা, সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৬
৫. পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বায়ত্বশাসন ও স্বাধীকারের সন্ধানে, বিপ্লব চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম অধ্যয়ন ও গবেষণা কেন্দ্র, ১৯৯৭
৬. পার্বত্য চট্টগ্রামের একাল সেকাল, শরদিন্দু শেখর চাকমা, অঙ্কুর প্রকাশনী, ২০০২
৭. জীবনালেখ্য, স্নেহকুমার চাকমা, ২০১১
৮. আমি ও আমার পৃথিবী, ড: মানিকলাল দেওয়ান, ২০১৩
৯. প্রচারপত্র, তথ্য ও প্রচার বিভাগ, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি

এ অশ্রুজলে বিলাস সাজে না, চিক্কোবি!

0

“১৯৬০ ওর গদাআনে ভাজেই নেজেয়ে সেই সুখকানি”

(১৯৬০ এর বাঁধটা ভাসিয়ে নিয়ে গেল সেই সুখগুলো)

আমার খুব প্রিয় একটি গানের এই লাইনটি শোনার পর থেকে আমার প্রচন্ড কৌতুহল গানটির মাধ্যমে কোন সে সুখের কথা স্মরণ করেছেন গীতিকার! চাকমা ভাষায় গদা মানে বাঁধ। বোঝাই যাচ্ছে এখানে কাপ্তাই বাঁধ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। গানটিতে কাপ্তাই বাঁধ পরবর্তী একটি বিরহী অনুভূতির চিত্র পাওয়া যায়। চাকমা গানটির প্রথম কলিটি এরকম-

“তর আর মর দেগা ওয়ে ইধোত আগে মারিশ্যা লঞ্চানত”
(মনে পড়ে তোমার- আমার দেখা হয়েছিলো মারিশ্যার লঞ্চটায়)

বাঘাইছড়ি বাংলাদেশের অন্যতম বড় একটি উপজেলা। অথচ কাপ্তাই বাঁধ হওয়ার আগে এই বাঘাইছড়ি/মারিশ্যা অঞ্চলটি ছিল মূলত মায়ানি রিজার্ভ ফরেস্ট। এখন মারিশ্যায় লঞ্চ চলে। রাঙ্গামাটি থেকে বাঘাইছড়ি উপজেলায় যাওয়ার একমাত্র ভরসা এইতো কিছুদিন আগেও এই নৌপথই ছিল। এখন অবশ্য খাগড়াছড়ি-দীগিনালা হয়ে সড়কপথেও যাওয়া যায়। রাঙামাটি থেকে নৌপথে বাঘাইছড়ি/মারিশ্যা যাওয়ার পথে লংগদু উপজেলার সদর বাজার ঘাটে পৌঁছানোর আগে হাট্টলী বিল নামে একটা বড় বিল পার হয়ে যেতে হয়। এই বিল এখন সারাবছর কাপ্তাই বাঁধের আটকানো পানির নীচে ডুবে থাকে। কিন্তু একটা সময় এই বিল ছিল উর্বর চাষযোগ্য ভূমি, সেখানে ছিল অনেক “ভরন্দি আদাম”/(সুজলা-সুফলা গ্রাম!)-র সমন্বয়ে সমৃদ্ধ জনপদ। তাই গীতিকার আপসোসের সুরে বলেছেন,-

“হাক্কন পরে হাট্টলী মাদত দেগা অহল দিজনর
বুজেই দিলুঙ এই পানিত তলে জাগায়ানি এল আমার!”

(কিছুক্ষণ পরে হাট্টলী মাঠে দেখা হলো দুজনার
বুজালাম তোমায় এই পানির নীচের জমিগুলো ছিলো আমাদের!)

কাপ্তাই বাঁধ হওয়ার পরে গ্রামের পর গ্রাম, পুরাতন চাকমা রাজবাড়ি, উর্বর শস্যভূমি চোখের সামনে তলিয়ে যায়। হাজার হাজার উদ্বাস্তু পাড়ি জমায় পার্শ্ববর্তী ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা আর অরুণাচল প্রদেশে। সম্পূর্ণ বদলে যায় একটি সমৃদ্ধ জনপদের জনমিতি, ভৌগলিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস। এই বাঁধ এর কারণে উদ্বাস্তু হওয়া শতশত পরিবার কে কোথায় পাড়ি জমাল তার চিত্রটা মেলে গানটির এই কলিতে-

“গেলাক হিয়ে থেগাকূলে, হিয়ে গেলাক মিজোরাম
তিবিরে আসাম আর অরুণাচল হিয়ে থেলঙ চাদিগাঙ”

(কেউ গেলো ওই থেগাকূলে, কেউ গেলো মিজোরাম
ত্রিপুরা, আসাম আর অরুণাচল, কেউ থাকলো চাদিগাঙ!!)

(চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রামটাকে হিল চাদিগাঙ বলেও অভিহিত করে থাকে)

শিল্পীর তুলিতে কাপ্তাই বাঁধের পানিত তলিয়ে যাওয়া পুরনো চাকমা রাজঘর! ছবি: নান্টু চাকমা

কর্ণফুলী নদীটিকে চাকমারা বরগাঙ বলে সম্বোধন করে। এই বরগাঙকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল সমৃদ্ধ এক জনপদ। বড়গাঙ তাই মিশে আছে পার্বত্য চট্টগ্রামের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, গান-কবিতা, প্রেম-বিরহ, আনন্দ-বেদনা এবং দ্রোহ-সংগ্রামের সামগ্রিকতায়। বরগাঙের পাড়ে পুরাতন রাঙামাটি শহরটি কেমন ছিলো তার একটি খন্ডচিত্র পাওয়া যায় খুব বিখ্যাত একটি চাকমা গানে-

“হিল্লে আধিক্কে স্ববনত দেক্কোং পুরান রাঙামাত্যে
তুত্তে বোইয়ের বাহর্ , সিমেই তুলা উড়ি যার, স্ববনত দেক্কোং বরগাঙও পার।”

(গতকাল হঠাৎ স্বপ্নে দেখলাম পুরাতন রাঙামাটি
প্রবল এলোবাতাসে শিমূল তুলা উড়ে যায়, স্বপ্নে দেখলাম বরগাঙ এর পার।)

এরপরের কলিগুলো,-

“ভাজি উত্তে বুইয়ানি, ভাজি উত্তে ঘরান মর
চিগোন হালর সমাজ্জেগুন বালুচরত খারা অদন।”

(ভেসে উঠেছে ধানখেতগুলো, ভেসে উঠেছে ঘরটি আমার
বালুর চরে খেলা করে ছোট্টবেলার সাথীরা আমার)

আবার,-

“বার্গী পেখকুন উড়ি যাদন, টদেকখুনে ধান হাদন
ছাভা ছাভা মিধে রোদত হোগিলুনে গীদ গাদন।”

(বার্গী পাখিরা উড়ে যায়, টিয়াপাখিরা ধান খায়
ছায়াময় মিষ্টি রোদে কোকিলেরা গান গায়।)

বরগাঙের পারে আদাম ছিলো, সেই আদামগুলোতে এলোবাতাসে বড় বড়- উঁচুউঁচু শিমূল গাছের নরম তুলাগুলো মেঘের পানে ভাসতো, বার্গী পাখিরা নীলআকাশে উড়ে বেড়াতো, কোকিলরা মিষ্টি রোদের ছায়ায় কুহু কুহু ডাকতো। বরগাঙের পারে বালকদের নিআলজি খেলা, ঘরের সিংগবা জুড়ে মায়েদের পানজা নাগর, উফ! পুরাতন রাঙামাটি। এমনে এমনে তো আর প্রবাদ হয়নি, বরগাঙানও চাই পারা-খাদিয়ানও ধয় পারা (বরগাঙটাও দেখে আসি-খাদিটাও ধুয়ে আসি)। বরগাঙ এবং পুরান রাঙামাটির স্মৃতি বারবার ঘুরেফিরে এসেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের গানে-কবিতায়। অন্য আরেকটি চাকমা গান এরকম-

“ওই দেগোচনি চেঙে দুয়ার, যিয়োত আগে রিজার্ব বাজার
তা পূগেন্দি গাঙও সঙমধ্যে এলঅ ম’ আদাম
সেক্কে ন এল্ পানি, ন অয় গদাগান
গাঙও পারত আমি থেদং মিলি-ঝুলি!!”

(দেখছো কি ওই চেঙে-র মুখ, যেখানে আছে রিজার্ব বাজার
তার পূবে গাঙ-র মাঝে ছিল আমার গ্রাম
তখন আসেনি পানি, ছিল না কোন বাঁধ
গাঙের পারে মোরা ছিলাম মিলেমিশে!!)

বর্তমান যে রিজার্ব বাজার লঞ্চঘাট, ঠিক সেখানটাই বা তার কিঞ্চিত একটু পাশেই ছিলো পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান নদী চেঙের মুখ। চেঙে নদীটি পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরের দিক থেকে এসে খাগড়াছড়ি-মহালছড়ি হয়ে এই রিজার্ব বাজারেই বরগাঙের সাথে মিলিত হয়েছে। গানটিতে চেঙে নদীর মুখের পূর্ব পাশে পুরাতন রাঙামাটি শহরকে কেন্দ্র করে যে গ্রামগুলো ছিল, তার বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। “গাজঅ ফাগন্দি জুনান যেক্কে উধে, ইধোত তুলিচ মরে”/(গাছের ফাঁক বেয়ে যখন জোছনা ছড়ায়, মনে করো আমায়) ব্যাপক জনপ্রিয় এই চাকমা গানটিতে গীতিকার সুরে সুরে বরগাঙের উপর গদা/বাঁধ হওয়ার আগে যে চিত্র তার স্মৃতি তাঁর প্রেয়সীকে মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এভাবে-

“এক কুড়ি বজর আগর কধানি, আহজি যিয়েগোই গদা পানিত!!
সলিল রায়ও হধা ইধোত উধে নি, দলাচানও গীদ কানত বাজে নি??
ত মনঅ সুন্দুক্কোত থোগেই চেলে, থোগেই পেবে!!
এচ্চে তুই হুধু আগচ হিজেনি, ন দেগং তরে গদাআন উয়ে ধুরি!!”

(কুড়ি বছর আগের সেই কথাগুলো তলিয়ে গেছে বাঁধের পানিতে!!
সলিল রায় এর কথা কী মনে পড়ে, কানে কী বাজে দলাচানের গান??
তোমার মনের সিন্দুকে খুঁজে দেখ, পেয়ে যাবে!!
আজ তুমি কোথায় আছো জানি না, বাঁধটি হওয়ার পরে নেই কোন দেখা!!)

কত বিরহের উপাখ্যান এই বাঁধ জন্ম দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কত গেরস্তের ঘর ভেঙেছে, কত স্মৃতি ভুলিয়ে দিয়েছে এই অভিশপ্ত বাঁধ তা মনে না করে জুম্মবী থাকতেই পারে না। চিক্কোবি ইধোত তুল সে হধানি, ইধোত তুল। অন্য আরেকটি গানে বাঁধটির কারণে অভিশপ্ত উদ্বাস্তু জীবনের কথা গীতিকার স্মরণ করেছেন এভাবে-

“গদান অবার পরেন্দি, নানান মানেই নানান জাগাত
যিয়োন তারা মনত দুখকানিলোই, যিয়োন তারা মনত দুখকানিলোই!”

(বাঁধটি হওয়ার পরে, নানান মানুষ নানান জায়গায়
চলে গেল তারা মন:কষ্টে, চলে গেল তারা মন:কষ্টে!)

আবার,-

“বেলান ডুপ্পেগোই জুনান উট্টে আগাজত, গোদা দিন্নো দুগ গরিনেই, বোচ্চোঙ ইঝোরত”

(সুর্য ডুবে গেছে, জোছনাটা ওই আকাশে, সারাটা দিন কষ্ট করে, বসে আছি ইঝোরে)

– জনপ্রিয় এই চাকমা গানটিতেও গদা/বাঁধ হওয়ার আগে পুরাতন চাকমা রাজবাড়ির স্মৃতি হাতরানো হয়েছে এভাবে-

“গদাআন ন’ অবার আগেন্দি রাজঘরান তুই দেক্কোচ্ নি??
পুরোন দিনোর পুরোন দিনুন ইধোত উধের নি???”

(বাঁধটি হওয়ার আগে রাজবাড়িটি দেখেছো কী??
পুরনো দিনের পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে কী???)

পাহাড়ের বুক চিড়ে এভাবে বয়ে চলেছে শত শত নদী। ছবি: নান্টু চাকমা

কাপ্তাই বাঁধটি প্রথমদিকে হওয়ার কথা ছিলো বর্তমান সুবলং বাজারের একটু নীচের দিকে। এখনো সুবলং যাওয়ার পথে এর কিছু চিহ্ন চোখে পড়ে। এখানে কিছু কাজও হয়েছিলো। পরবর্তীতে ভারতের আপত্তির কারণে প্রকল্পটির স্থান বর্তমান কাপ্তাইয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়। সুবলং-এ বাঁধটি নির্মিত হলে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের কিছু অংশও প্লাবিত হতো, তাই ভারত আপত্তি তোলে। সুবলং-র পুরনো নাম ছিলো শলক দোর (শলক মুখ); দেখুন-স্নেহকুমার চাকমার “জীবনালেখ্য”।এই শলক নদীটি জুরাছড়ি উপজেলার দক্ষিণ-পূর্ব সর্বশেষ ইউনিয়ন দুমদুম্যা-র বড়হলগ হয়ে প্রায় পুরো জুরোছড়ি উপজেলাটিকে সাপের মত পেঁচিয়ে বর্তমান সুবলঙের সন্নিকটে বড়গাঙের সাথে মিলিত হয়েছে। মূল বরগাঙ নদীর উৎস মিজোরামের লুসাই পাহাড়! বরগাঙের একেবারে শুরুর দিকেই বরকল উপজেলার ঊরিঙে মৌন/হরিণা পাহাড় থেকে উৎপন্ন হওআ ঊড়িঙে/হরিণা ছড়াটি কিছুটা নেমে এসে থেগা ছড়াটির সাথে মিশে বড়গাঙে রুপ নিয়েছে। কিছুদূর নীচে তার সাথে মিলেছে জুরাছড়ি উপজেলার শলক ছড়া। শলক ছড়াটির সাথে মিশেছে ছোট ছোট অনেক ছড়া-ছড়ি।

বড়হলগ, ফইরেছড়া, নলবন্নেছড়া, শিলছড়ি প্রভৃতি ছড়াগুলো পূর্ব-পশ্বিমমুখী হয়ে উত্তর-দক্ষিণ মুখী শলক ছড়াটায় মিশেছে। থেগা ছড়াটিতে যেমন মিশেছে আন্দারমানিক। বরকল উপজেলার দক্ষিণে জুরাছড়ি আর উত্তরে বাঘাইছড়ি। বাঘাইছড়ি উপজেলা থেকে হাজলং নদীটা কিছুটা দক্ষিণে এসে মিলিত হয়েছে মেইনীর সাথে। হাজলঙ বেয়ে একটু নীচে নামলে লংগদু উপজেলা সদর বাজার ঘাটটির একেবারেই সন্নিকটে যেখানে এখন মাইনী বাজার সেখানে মেইনী নদীটি মিলেছে হাজলঙের সাথে। এই হাজলঙে ছোটবড় আরো অনেক ছড়া-ছড়ি মিশে আছে, এই যেমন,- সাজেক, শিজক, দূরছড়ি ইত্যাদি। হাজলঙ এবং মেইনীর সম্মিলিত প্রবাহ একসাথেই সমর্পিত হয়েছে বড়গাঙের বুকে!! আর উত্তরের দিক থেকে খাগড়াছড়ি-মহালছড়ি হয়ে সোজাসুজি দক্ষিণমুখী হয়ে চেঙে নদীটা বর্তমান রিজার্ব বাজারের সন্নিকটে মিলিত হয়েছে বড়গাঙ-র সাথে।

এরপর আরও কিছুটা দক্ষিণে বর্তমান কাপ্তাই বাঁধটির সন্নিকটে বিলাইছড়ি উপজেলা থেকে নেমে আসা রেইংখং নদীটাও এসে মিলিত হয়েছে বরগাঙর সাথে। রেইংখং বিলাইছড়ি উপজেলার প্রধান নদী। এটি বিলাইছড়ির একেবারে দক্ষিণদিক থেকে উৎপন্ন হয়ে ফারুয়া ইউনিয়ন হয়ে নেমে এসে বর্তমান ধনপাতা এবং বড়াদম বাজারের কাছাকাছি যে কাপ্তাই নেভিক্যাম্প তার সন্নিকটে বড়গাঙের সাথে মিলিত হয়েছে। বলা যায়, খাগড়াছড়ির প্রধানতম নদী চেঙে এবং রাঙ্গামাটির সবকটা প্রধান নদীই বরগাঙের সাথে মিলিত হয়ে প্রথমে উত্তর-দক্ষিণ এবং পরে সোজা পশ্চিমমুখী হয়ে চলে গেছে বঙ্গোপসাগরে।

কাপ্তাই বাঁধ হওয়ার ফলে ৫৪ হাজার একর ফসলি জমি তলিয়ে যায় পানির নীচে। হাজার হাজার উদ্বাস্তু পার্শ্ববর্তী ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে শরণার্থী হয়ে যেতে বাধ্য হন। অনেকেই চলে যান খাগড়াছড়ি, দিঘীনালা, মাটিরাঙ্গায়। কেউ কেউ চলে যান ভারত সীমান্তবর্তী থেগাকূলে। উদ্বাস্তুদের বড় একটা অংশ অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে নতুন বসতি করেন বর্তমান মারিশ্যা/বাঘাইছড়ি অঞ্চলের গহীন মায়ানী রিজার্ব ফরেস্টে। অনেকেই চলে যান বান্দরবানের কিছু কিছু জায়গায়। যেমন- বান্দরবান সদর উপজেলার কুহালং ইউনিয়ন, থানচি উপজেলার বলিপাড়া। বান্দরবানের বর্তমান নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রটির আশেপাশে যে তঞ্চঙ্গ্যা পাড়াগুলো চোখে পড়ে খুব সম্ভব তারাও এই কাপ্তাইয়েরই উদ্বাস্তু।

আর রাঙামাটির আসামবস্তি-কাপ্তাই রোডের দুপাশে যে গ্রামগুলো চোখে পড়ে এরা সবাই কাপ্তাই বাঁধের অভিশাপ নিয়ে কীভাবে বেঁচে আছে তা যারা নিয়মিত এই রোডে আসা-যাওয়া করেন একটু চোখ বুলালেই তা বুঝা যাবে। বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নটার বড় অংশটা এখনও রিজার্ব ফরেস্টের অধীনে। ফারুয়া ইউনিয়নে যাদের বসবাস তারা সবাই এই কাপ্তাইয়ের ভিকিটিম। বিদ্যুৎ উৎপাদন কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটির গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্দেশ্য হলেও এর পাশাপাশি মূলত পার্বত্য রাঙামাটির বনজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠন করাই ছিল এর প্রধানতম কারণ। এই যে- হরিণা, থেগা, শলক, হাজলং, মেইনী, রেইংখং-র দুপার জুড়ে বিসতৃত পাহাড়ের সারি, সেই পাহাড়ের বনজ সম্পদ আহরণকে খুব সহজ করে দেয় এই কাপ্তাই বাঁধ। অথচ বাধঁটি হওয়ার ৫০ বছরের অধিক সময় পরেও কাপ্তাইয়ের একেবারে ২/১ কিলোমিটারের কাছাকাছি করে লাগোয়া যে পাহাড়ি গ্রামগুলো, যেমন-কামিল্লেছড়ি, বেঙছড়ি, মগবান, জীবতলী, বড়াদম প্রভৃতি জুম্ম অধ্যুষিত এলাকায় এখনো বিদ্যুৎ পোঁছাইনি। বরকল, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি-র বিসতৃত এলাকাজুড়েও নেই বিদ্যুৎ। আমরা আমাদের রাজবাড়ি হারালাম, জনপদ হারালাম, উর্বর জমি হারালাম, বনজ সম্পদ হারালাম বিনিময়ে বিদ্যুৎ উদপাদিত হলো, আমরা চিরঅন্ধকারে নিমজ্জিত হলাম আর কারো কারো ঘর আলোকিত হয়ে উঠলো আমাদের রক্তে-আমাদের অশ্রুতে!!!

কাপ্তাই বাঁধের পানিতে ডুবে আছে কত শত না জানা ইতিহাস, বিচ্ছেদ-বেদনার হাজারো গল্প! ছবি: লেখক

এখন কাপ্তাই বাঁধের ফলে সৃষ্ট কৃত্রিম হ্রদটাকে কেন্দ্র করে রাঙামাটি শহরের পরিচিতি হচ্ছে পর্যটন নগরী। এখানে শহুরে লোকেরা মৌসুমী প্রমোদ ভ্রমণে বেড়াতে আসে। হ্রদের জলের উপর স্টিমার ভাসিয়ে তারা পাহাড় দেখে, মেঘ দেখে, আকাশ দেখে, ঝরণা দেখে অথচ আমাদের দু:খটাকে দেখে না, কষ্টটাকে দেখে না, পুরাতন রাঙামাটির অশ্রুসিক্ত বেদনাকে দেখে না!! সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ের বর্তমান প্রজন্ম, এই আমরাও আমাদের অন্তরের গহীনে লুকিয়ে থাকা অশ্রু আর অব্যক্ত বেদনাগুলোকে পাশ কাটিয়ে চলার বৃথা চেষ্টা করি অবচেতনভাবে অথবা সচেতনভাবেই!!! আমরা যারা উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট প্রভৃতি শহরে পড়তে আসি সেই তথাকথিত শিক্ষিত ছাত্র-যুবসমাজ এই আমরাই,আমাদেরই অশ্রুজলের উপর নাচানাচি করি, ব্যাচ পিকনিক করি, মাইক বাজাই, সেলফি তুলি, মজা লুঠি, মাস্তি করি আরও কত্ত কী?

আমরা আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে, কষ্টকে-বেদনাকে ভুলে যাই অথবা ভুলিয়ে দেওয়া হয়। চারিদিকেই তো ভুলিয়ে দেওয়ার-ভুলিয়ে রাখার কত শত আয়োজন!!! আদিপুরুষের অশ্রুসিক্ত ইতিহাসকে ভুলে থাকার এবং অস্বীকার করার প্রতিযোগিতাই কেউই আমরা পিছিয়ে নেই। এ তো হওয়ার কথা ছিলো না!!যাস্ট একবার ভাবুন তো, সেই ৬০ দশকেই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এই বাঁধটিকে কেন জুম্ম জনগণের জন্য মরণফাঁদ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন? কাপ্তাই বাঁধ, জুম পাহাড়ের মরণফাঁদ!! জুম্ম জনগণের জন্য সর্বনাশী এই মরণফাঁদ প্রিয় বড়গাঙকে করে রেখেছে চিরদুঃখী। তোমাকে-আমাকেও নয় কী? হরিণা, থেগা, শলক, হাজলং, মেইনী, চেঙে, রেইংখং থেকে প্রতিমুহুর্তে শতশত পাহাড় আর হাজার হাজার পাহাড়ির অশ্রুজল বড়গাঙ বেয়ে নীরবে বয়ে যায়।

এ অশ্রু চিবচরণের, এ অশ্রু রাধামনের, এ অশ্রু তান্যেবীর, এ অশ্রু পুনংচানের। এ অশ্রু তোমার, এ অশ্রু আমার। এ অশ্রুজলে বিলাস সাজে না, চিক্কোবি…

***লেখাটি ২০১৬ সালে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের ৯ই আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের প্রকাশনা ‍”সংহতি” তে প্রথম প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে অনলাইন মাধ্যমে জুমজার্নালও লেখাটি প্রকাশ করেছে। আমাকে যারা পাঠ করেন বা করবেন- তাদের জন্য এখানে তুলে রাখলাম..