অনেকেই জেনে থাকবেন, “Mayflower” একটি বিখ্যাত জাহাজের নাম। এই জাহাজে চড়ে বর্তমান আমেরিকার পুর্বপুরুষদের একটি দল বিশাল সাগরে একপ্রকার নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছিল। ১৬২০ সালের ৫ সেপ্টেস্বর ইংল্যান্ডের প্লাইমাউথ শহর থেকে ১০২ জনের একটি দল সাগরের অপরপ্রান্তে পাড়ি জমিয়েছিল অজানা এক সম্ভাবনা-কে উদ্দেশ্য করে। তখনও আমেরিকা-র বিশাল সম্পদ ও ভূমি বর্তমানের “তথাকথিত আধুনিক সভ্যতার” সংস্পর্শে আসে নি। উত্তাল জলরাশি, প্রতিকুল আবহাওয়া ঢিঙিয়ে সাগরের বুকে বহু প্রাণহানি-র পরেও Mayflower- এর সাহসী অভিযাত্রীরা থমকে যান নি এবং ৬৬ দিন অবিচল সংগ্রাম করার পরে নভেম্বরের ১০ তারিখ নতুন এক ভূখন্ড আমেরিকা মহাদেশে “মে ফুল” তীর খুঁজে পেতে সক্ষম হয়। বাকি গল্পটা আমেরিকার আধুনিক ইতিহাস।
C. T. Shen – সি টি শেন, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। জন্মসূত্রে চাইনীজ বংশোদ্ভূত। ইঞ্জিনিয়ারিং এ গ্রাজুয়েট শেন, ১৯৫২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এবং সেখানে তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। তিনি “Board of The American Steamship Company” -র চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়াও তিনি “The Institute For Advance Studies of the World Religions” এবং “The Buddhist Association of the United States” -এরও প্রতিষ্ঠাতা। শাক্যমুনি বুদ্ধের শিক্ষা এবং দর্শন দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত শেন বিভিন্নসময়ে বুদ্ধের শিক্ষা এবং দর্শন নিয়ে তার ব্যাক্তিগত অধ্যয়ন এবং অভিজ্ঞতালব্ধ উপলব্ধিগুলোকে আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় বকৃতা আকারে উপস্থাপন ও প্রচার করে থাকেন। এতদসংক্রান্ত তাঁর বক্তব্যগুলোর সংকলন নিয়ে তাঁর বই- “MayFlower 2, On the Buddhist Voyage to Liberation” সম্প্রতি আমার চক্ষুগোচর হয়েছিল।
সি টি শেন, তাঁর মে ফ্লাওয়ার বইয়ে সন্নিবেশিত বকৃতামালাগুলোকে বিভিন্ন শিরোনামে উপস্থাপন করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- The Five Eyes, A Glimpse of Buddhism, The Concept of Birth and Death, The Truth of Karma, The Truth of Self (emptiness), The source of Joy, What can we learn from Buddhism প্রভৃতি।
পুরো বইটি পড়ে আমার সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে- The Five Eyes শিরোনামের বকৃতামালাটি। ১৯৬৯ সালের ২৫ মে, শাক্যমুনি বুদ্ধের জন্মদিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে শেন, নিউইয়র্ক শহরের “The Temple of Enlightenment” – এ একটি বক্তব্য প্রদান করেন। এটিই পরবর্তীতে তিনি তাঁর মে ফ্লাওয়ার বইয়ে “The Five Eyes” শিরোনামে সন্নিবেশিত করেন। নীচে আমি তার সেই বকৃতা-টির চুম্বক অংশগুলোর কিয়দাংশের মূলভাব কিঞ্চিত সংযোজন-বিয়োজনপূর্বক আমার মতো করে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
The Five Eyes – এ শেন উল্লেখ করেছেন যে, বৌদ্ধ শাস্ত্রে পাঁচ প্রকার চোখ বা চক্ষুদৃষ্টি সম্বন্ধে জানা যায়। যেমন-
- Physical Eye
- Heavenly Eye
- Wisdom Eye
- Dharma Eye
- Buddha Eye
- আমি এভাবে বাংলা করার চেষ্টা করছি।
- ১. সাধারণ দৃষ্টি (সাধারণ চক্ষু/চর্মচক্ষু)
- ২. দিব্যদৃষ্টি (দিব্যচক্ষু)
- ৩. প্রজ্ঞাদৃষ্টি (জ্ঞান বা প্রজ্ঞাচক্ষু)
- ৪. ধর্মদৃষ্টি (ধর্মচক্ষু)
- ৫. বুদ্ধদৃষ্টি (বুদ্ধচক্ষু)
১. Physical Eye / সাধারণ দৃষ্টি (সাধারণ চক্ষু/চর্মচক্ষু):
সাধারণ চোখের দৃষ্টি বলতে এখানে কেবল মানুষের সাধারণ চোখের দৃষ্টিকে বোঝানো হয় নি। কেননা মানুষের চোখের চাইতেও উন্নতদৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন বা বিশেষ দৃষ্টিক্ষমতা সম্পন্ন প্রাণী এই ধরণীতে আছে। যেমন ধরুন- ঈগল, চিল প্রভৃতি প্রাণীর সাধারণ চোখের দৃষ্টিও মানুষের চোখের দৃষ্টির চেয়ে প্রখর এবং তীক্ষ্ম আবার পেঁচা রাতের অন্ধকারেও দেখতে সক্ষম। বইটিতে শেন বৈজ্ঞানিক একটি চার্টও যুক্ত করেছেন, যেখানে দেখা যায় যে- আমাদের সাধারণ চোখে আমরা বিশ্বব্রক্ষান্ডের খুবই সীমাবদ্ধ একটি পরিসর পর্যন্তই কেবল দেখতে সক্ষম হই। অর্থাৎ আমাদের সাধারণ চোখের একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিসীমা আছে এবং আমরা কেবল ততটুকু পর্যন্তই দেখতে সক্ষম হই যা আমরা দৃষ্টিগ্রাহ্য(?) বা “Visible Light” হিসেবে অভিহিত করি। সাধারণ চোখ দিয়ে আমরা সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি সহ বেশকিছু তরঙ্গ দেখতে সক্ষম নই বা আমাদের সাধারন চক্ষুদৃষ্টিতে তা দৃষ্টিগোচর হয় না। আমরা আমাদের সাধারণ চোখ দিয়ে এই মহাবিশ্বের কেবল ছোট একটি অংশ পর্যন্ত দেখতে সক্ষম হই এবং বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আবিষ্কার হওয়ার আগে আমরা কেবল আমাদের সাধারণ খোলা চোখের দৃষ্টিগ্রাহ্য বিষয়গুলোকেই বাস্তব এবং মূর্ত বলে জানতাম। কিন্তু এখন আমরা জানি যে, খোলা চোখে যা আমরা দেখতে পাই না, তার বাইরেও এই মহাবিশ্বের অসংখ্য বিষয়বস্তু রয়েছে যা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা যায়।
২. Heavenly Eye / দিব্যদৃষ্টি (দিব্যচক্ষু):
এবার আসা যাক দিব্যচোখ বা দিব্যদৃষ্টি বিষয়ে। ধরুন, একটি বড় শহরের একেবারে মাঝখানে সবদিক থেকে বন্ধ অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি ঘর থেকে কেবল একটি মাত্র ছোট জানালা থেকে কিছুসংখ্যকমাত্র বিল্ডিং, নীল আকাশের ছোট্ট একটি অংশ এবং কিছুমাত্র মানুষের কর্মকান্ড দৃষ্টিগ্রাহ্য। সেই ঘরের মধ্যে একটি শিশুর জন্ম হলো এবং সে সেখানেই বেড়ে উঠতে থাকলো। বাইরের কোনকিছু সে দেখতে পেল না। তাহলে সেই শিশুর পৃথিবী সম্পর্কে ধারণা কতদূর হবে? নিঃসন্দেহে সে যতটুকু পর্যন্ত দেখে দেখে অভ্যস্ত তার কাছে ততটুকুই মনে হবে সমস্ত দুনিয়া। তার কাছে যতই বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে বলা হোক না কেন, সে প্রত্যক্ষভাবে তা অবলোকন বা উবলব্ধি করতে সক্ষম হবে না। অর্থাৎ আমাদের সাধারণ চোখের দৃষ্টিসীমার বাইরে আমরা যেতে পারি না এবং সেকারণেই, আমরা ঠিক যতটুকু দেখি ততটুকুই আমাদের কাছে তাৎক্ষণিকভাবে মূর্ত বা বাস্তব অথচ আমাদের নিজস্ব দৃষ্টিসীমার বাইরেও সত্যিকারের বিষয়বস্তুর বাস্তব অস্তিত্ব রয়েছে কিন্তু আমরা হয়তো খোলা চোখে সেসব দেখতে পাই না। আমাদের চোখে যতটুকু পর্যন্ত দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় আমরা তাকেই কেবল বাস্তব এবং পরিপূর্ণ বলে মনে করে থাকি যা ভুল।
এবার ধরুন, একটি পর্বতের চুড়ায় একটি বাড়ি আছে। বাড়িতে একটি বড় জানালা আছে এবং সেখান থেকে বিশালাকার আকাশ ও দিগন্তবিস্তৃত দৃশ্যাবলী দেখা যায়। এই বাড়িতে একটি শিশুর জন্ম হলে তাঁর কাছে পৃথিবীটা নিঃসন্দেহে পূর্ববর্তী বর্ণিত শিশুটির চেয়ে ভিন্ন, বৈচিত্রময় এবং বিশাল মনে হবে। উপরের দুইটি বিশ্লেষণ এর ক্ষেত্রে, যদিওবা হয়তো তাদের প্রাকৃতিক দৃষ্টিসক্ষমতা একইরম কিন্তু এখানে- ১ম শিশুটির দৃষ্টিসীমা বিবেচনায় ২য় শিশুটির বাস্তব এবং মূর্ত দৃষ্টিসীমা অনেক অনেক বেশি। বলা যেতে পারে যে, অজ্ঞানতাবশত ১ম শিশুটির কাছে- ২য় শিশুটির দৃষ্টিলব্ধ বিষয়াবলীগুলো অনেক বেশী অলীক, অবাস্তব এবং সেকারণে একপ্রকার দৈববিশেষ।
খুব সোজাকথায় যেকোনপ্রকারে প্রযুক্তদৃষ্টি বা সাধারণ মানুষের আপাত:দৃষ্টিশক্তি তুলনায় বিশেষ সক্ষমতার দৃষ্টিশক্তিকে আমরা দিব্যদৃষ্টি বা দৈবদৃষ্টি হিসেবে অভিহিত করতে পারি যা মানুষের সাধারণ চোখের দৃষ্টিসীমার বাইরেও দূরবর্তী জিনিসকে চাক্ষুসভাবে দেখার মতন অনুভব করতে বা দেখতে সক্ষম। যেমন- অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে আমরা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীবকে দেখতে পাই। টেলিস্কোপ দিয়ে দূরবর্তী জিনিসকে দেখতে পাই। টেলিভিশনের সাহায্যে বহুদূরের ঘটনাবলীকেও আমরা বাস্তবরুপে দেখতে পারি যা চোখে দেখার মতনই।
কিন্তু আজ থেকে ২৫০০ বছর আগেকার বুদ্ধের সময়কালীন সময়ে তো এসব যন্ত্রপাতি ছিল না। খুব সম্ভব তখন ধ্যানশক্তির মাধ্যমে দূরবর্তী জিনিসসমূহকে সম্যকভাবে বর্ণনা করতে পারাটাই দৈবদৃষ্টি বলে অভিহিত হয়েছে। বিভিন্ন ধ্যানশাস্ত্র অনুসারে জানা যায় যে, ধ্যানশক্তির মাধ্যমে অতিদূরবর্তী জিনিসকেও চাক্ষুসরুপে দেখার মতনই সম্যকভাবে অনুভব করা সম্ভব যা একপ্রকার দেখার মতোনই। সেক্ষেত্রে এটাই দিব্যদৃষ্টি বা দৈবদৃষ্টি।
৩. Wisdom Eye / প্রজ্ঞাদৃষ্টি (জ্ঞান বা প্রজ্ঞাচক্ষু):
জ্ঞান বা প্রজ্ঞাচক্ষু বা প্রজ্ঞাদৃষ্টি বিষয়ে অবতারণার আগে বৌদ্ধশাস্ত্রের অন্য একটি মৌলিক বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে। সংস্কৃত ভাষায় “শূণ্যতা” – র সম্ভাব্য ইংরেজী অনুবাদ করা হয় “Emptiness ” হিসেবে। বৌদ্ধতত্ত্বের এই স্বতন্ত্র এবং বিশিষ্ট ধারণাটি প্রচলিত অন্যান্য ধর্মীয় মতবাদ বা দর্শনগুলোতে সচরাচর খুঁজে পাওয়া যায় না। বৌদ্ধশাস্ত্রে শূণ্যতা বিষয়ক বহু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষন খুঁজে পাওয়া যায়, এবং “শূন্যতা” ধারণাটির উপরে শতসহস্র বই-পুস্তক পাওয়া যাবে। এখানে আমরা বস্তু বা বিষয়সমুহকে বিশ্লেষণের জন্য বিভিন্নসময়ে বুদ্ধভাষিত ৩টি পদ্ধতির মাধ্যমে “শূণ্যতা” বিষয়ে আলোকপাত করতে পারি।
ক. পৃথকীকরণ পদ্ধতিতে বস্তুর শূণ্যতা বিশ্লেষণ (The analytical method of disintegration):
শেন তাঁর বইয়ে, একটি রেডিও কে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আমরা এখানে একটি বিল্ডিং কে উদাহরণ হিসেবে নিচ্ছি। ধরুন, একটি ৫ তলা বিশিষ্ট বিল্ডিং কে কল্পনা করা গেল। আমরা যদি পুরো বিল্ডিংটি চিন্তা না করে, কেবলমাত্র বিল্ডিংটার মধ্যে ব্যবহৃত ইটগুলোকে পৃথকভাবে চিন্তা করি তবে কি ইটগুলোকে বিল্ডিং বলা যাবে? অবশ্যই না। সেভাবে কেবল লোহার রডগুলোকে কি বিল্ডিং বলা যাবে? না। আবার সিমেন্ট বা অন্যান্য উপকরণগুলোকে যদি পৃথক পৃথকভাবে বিবেচনা করি তবে সেগুলোর কোনটাকেই বিল্ডিং বলা যাবে না।
এভাবে আমরা যদি আরো গভীরভাবে চিন্তা করি, তাহলে দেখতে পাব যে- ইটগুলো তৈরী হয়েছে মাটি থেকে। মাটিকেও আরো সূক্ষ্মভাবে ভেঙে ভেঙে আমরা বিভিন্ন পদার্থ, অণু-পরমাণু হিসেবে পৃথক পৃথকরুপে দেখতে পারবো। তাহলে যেটাকে আমরা বিল্ডিং হিসেবে অভিহিত করছি, সেই “বিল্ডিং”-টা তো দেখা যাচ্ছে ইট-বালু-সিমেন্ট-লোহার রড প্রভৃতির একটি সাময়িক সমষ্টি বা মিশ্রণ মাত্র। অর্থাৎ- একদিক থেকে বিবেচনা করলে বিল্ডিং বলতে এই পৃথিবীতে আসলে কিছুই নেই, “বিল্ডিং” নামক বস্তুটি আসলে শূণ্য।
এভাবেই আমরা দেখতে পাই যে, পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুসমূহকে আমরা যে নামেই অভিহিত করি না কেন সবকিছুই কেমন যেন শূণ্য। অর্থাৎ কোনকিছুই চিরস্থায়ীভাবে অস্তিত্বমান নয়। সবকিছুই অনিত্য, ক্ষণস্থায়ী এবং শূণ্যতাবিশিষ্ট।
শাক্যমুনি বুদ্ধ এই পৃথকীকরণ দৃষ্টিভঙ্গী প্রয়োগ করেই তাঁর সমস্ত দেহ এবং চিন্তাবলীকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন, তাঁর মাথাটাকে যদি শরীর থেকে বিচ্ছিন্নরুপে চিন্তা করা হয় তবে সেটা “পূর্ণাঙ্গ মানব শরীর” বলে বিবেচ্য নয়। সেভাবে, যদি দুই হাত কর্তন করে বিচ্ছিন্নরুপে বিবেচনা করা হয় তবে সেগুলোও “পূর্ণাঙ্গ মানব শরীর” বলে অভিহিত করা যায় না। এভাবে পুরো শরীরটাও অণু-পরমাণুর সমাবেশ মাত্র। তাহলে যে “শরীর” কে আমরা “আত্ম” হিসেবে অভিহিত করছি তার প্রকৃত অস্তিত্ব কোথায়? তাই বুদ্ধের দর্শনের একটি মৌলিক উপলব্ধি- “আত্ম” বলতে কোনকিছুর অস্তিত্ব নেই, সবকিছুই “অনাত্ব”। তাই বৌদ্ধদর্শনে বলা হয়ে থাকে যে, জগতে সবকিছুই অনিত্য এবং অনাত্ব। আমরা যে কোন বস্তু বা বিষয়বস্তুর ক্ষণস্থায়ী রুপকে চিরন্তন অস্তিত্বমানরুপে ধারণা করে থাকি এবং সেকারণে জাগতিক বিভিন্ন বস্তু বা বিষয়সমূহে আসক্ত হই। অথচ প্রকৃত বিচারে বস্তু বা বিষয় সবকিছুই একধরণের শূণ্যতামাত্র।
খ. একীভূতকরণ পদ্ধতিতে বস্তুর শূণ্যতা বিশ্লেষন (The analytical method of integration):
যদিও এই পৃথিবীতে আমরা অসংখ্য বস্তু দেখতে পাই তথাপি সকল বস্তুসমূহই নির্দিষ্ট কয়েকটি মাত্র উপাদান দিয়ে গঠিত হয়। বুদ্ধের সময়কালীন প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিকরা পৃথিবীর সকল বস্তুসমূহকে চারপ্রকার উপাদান দিয়ে গঠিত ধাতু বা পদার্থমাত্র বলে জ্ঞান করতেন, যথা- মাটি বা মৃত্তিকা, তরল বা পানি, বায়ু এবং তাপ বা অগ্নি। অর্থাৎ পৃথিবীর সকল বস্তুর মধ্যেই কমবেশি এই চারপ্রকার ধাতু উপকরণ বা সাধারণ রাসায়নিক বৈশিষ্ঠ্যের উপস্থিতি পাওয়া যায়। সেদিক দিয়ে যেকোন বস্তু মাত্রই- হয় মাটি, নয় তরল, নয়তো বায়ু অথবা তাপমিশ্রিত ধাতু। বুদ্ধ আরও গভীরতর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করলেন যে, এই চারপ্রকার ধাতুউপকরণও প্রকৃতবিচারে অনিত্য এবং শূণ্যতাবিশিষ্ট বলে জ্ঞান করা যায়। মাটিও শূণ্যতাবিশিষ্ট, তরলও শূণ্যতাবিশিষ্ট, বায়ুও শূণ্যতাবিশিষ্ট এবং তাপ বা অগ্নিজাত ধাতুসমূহও শূণ্যতাবিশিষ্ট, অনিত্য। প্রত্যেক ধাতুমাত্রেরই চুড়ান্ত এবং চিরস্থায়ীরুপে অস্তিত্বমান স্বরুপ বলতে কিছুই নেই, বরং অনিত্য এবং শূণ্য।
মজার বিষয়, আধুনিক পাশ্চাত্য বিজ্ঞানও বুদ্ধের এই পর্যবেক্ষণ এবং উপলব্ধিকে যথার্থরুপে সমর্থন করে। আইনস্টাইন তাঁর বিখ্যাত “আপেক্ষিকতা তত্ত্ব” আবিষ্কার করার আগে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের যাবতীয় বস্তু এবং বিষয়াবলীকে কেবলমাত্র দুইভাগে, যথা- বস্তু এবং শক্তি (Matter and Energy) হিসেবে চিহ্নিত করতেন। আইনস্টাইন এই দুটি পৃথক ধারণাকে সমন্বিত করে গাণিতিকভাবে প্রমাণ করলেন যে, বস্তুমাত্রই (Matter) শক্তির (Energy) বিশেষ রুপ বা অবস্থামাত্র। তিনি এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, মহাবিশ্বের সবকিছুই শক্তির (Energy) ভিন্ন ভিন্ন রুপ বা অবস্থামাত্র (Form)।
গ. আত্মবিকীরণ(?) পদ্ধতিতে বস্তুর শূণ্যতা বিশ্লেষণ (The analytical method of penetration):
শেন, তার বইয়ে বৈজ্ঞানিক চার্ট এর মাধ্যমে এই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করেছেন। এখানে সেটি সংযুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা অন্যভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করছি।
আমরা জানি যে, জগৎ-জীবন সম্পর্কে বুদ্ধের সমস্ত উপলব্ধিগুলোই স্বয়ং প্রত্যক্ষজাত এবং মূলত গভীরতর ধ্যান এর মাধ্যমেই তিনি জাগতিক বিষয়াবলীকে সূক্ষাতিসূক্ষরুপে দর্শন ও পর্যবেক্ষণ করার প্রয়াস নিয়েছেন। “শূণ্যতা” (Emptiness) ধারণাটি ব্যক্তির স্বয়ং প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করার মতন বিষয়। যারা স্বয়ং এটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হন তারা জানেন যে, এটা এমন এক বোধ, উপলব্ধি বা অভিজ্ঞতা যা সাধারণ মানুষের বোধ, উপলব্ধি এবং অভিজ্ঞতা থেকে অনেক বেশি সূক্ষ, গভীর এবং উচ্চমাত্রার।
পালি বা সংস্কৃত “দুঃখ” (Duhkha) শব্দটিকে ইংরেজীতে Suffering হিসেবে অভিহিত করা হয়, যদিও বৌদ্ধদর্শনে যে অর্থে “দুঃখ” শব্দটিকে ব্যবহার করা হয় Suffering সেটাকে হয়তো পূর্ণাঙ্গভাবে নির্দেশ করে না। বুদ্ধের জীবনী আলোচনায় আমরা জানি যে, রাজকুমার সিদ্ধার্থ জাগতিক বিভিন্ন দুঃখের উৎস বা মূলকারণ সম্বন্ধে জানতে চেয়েছেন এবং জাগতিক নানাবিধ দুঃখ থেকে কীভাবে চিরমুক্তি লাভ করা যায় তার অণুসন্ধান করার চেষ্টা করেছেন। সেকারণে তিনি রাজকুমার থেকে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করার পণ করে রাজসিক ক্ষণস্থায়ী সুখ-ভোগ-বিলাস-প্রতিপত্তি প্রভৃতি পরিত্যাগকরতঃ গৃহত্যাগের সংকল্পে স্থির হয়েছিলেন। “বুদ্ধত্ব” বা জগৎ ও জীবন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ এবং সর্বজ্ঞতাজনিত- “সম্যক জ্ঞান” অর্জন করার পরে তিনি ব্যাখ্যা করলেন- ৮টি উৎস থেকে দুঃখ উৎসারিত হয়। যথা-
১. জন্ম হওয়ার সাথে সাথেই দুঃখ উৎপত্তি হয়
(Suffering because of birth)
২. বার্ধক্যের কারণে দুঃখ উৎপত্তি হয়
(Suffering because of old age)
৩. অসুস্থতাজনিত কারণে দুঃখ উৎপত্তি হয়
(Suffering because of death)
৪. মৃত্যুজনিত কারণে দুঃখ উৎপত্তি হয়
(Suffering because of death)
৫. প্রিয় ব্যক্তি বা বস্তু বা বিষয়াবলী থেকে বিচ্ছিন্নতা থেকে দুঃখ উৎপত্তি হয়
(Suffering because of separation from loved ones or things one likes)
৬. অপ্রিয় ব্যক্তি বা বস্তু বা বিষয়াবলীর সাথে অনাকাঙ্খিত সংযোগ স্থাপিত হলে দুঃখ উৎপত্তি হয়। (Suffering because of confrontation with an undesirable person or things.)
৭. আকাঙখিত বস্তু বা বিষয় লাভে অসমর্থ হলে দুঃখ উৎপত্তি হয়
(Suffering because of the denial of one’s desires.)
৮. পঞ্চস্কন্ধজনিত (রুপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার, বিজ্ঞান) লোভ-দ্বেষ-মোহ-অবিদ্যা-আসব-অজ্ঞানতা থেকে দুঃখ উৎপত্তি হয়
(Suffering because of burning intensity of the five aggregrates of an individual)
# The Five Agregrates (পঞ্চস্কন্ড)
রুপ – Form/material image, impression
বেদনা – Sensations/ Feelings received from form
সংজ্ঞা – Perceptions
সংস্কার – Mental activity or formations
বিজ্ঞান – Consciousness
উপরের ৮ প্রকার দুঃখ বা দুঃখের উৎস সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করার সুযোগ এখানে আপাতত নেই। আমরা যদি খেয়াল করি, তবে এমন সিদ্ধান্ত টানা যায় যে- উপরে বর্ণিত এসকল দুঃখের মূল উৎস বা ক্ষেত্র হচ্ছে “আমাদের শরীর এবং চৈতন্য” (Physical Body and Consciousness) যেটাকে আমরা “আত্ম” (Self) হিসেবে অভিহিত করি এবং তাঁর সাথে একধরণের বন্ধনে আসক্ত (Attachment) হই। বৌদ্ধদর্শন মতে, আসক্তি বা তৃঞ্চা-ই জাগতিক সকল দুঃখের কারণ- Roots of every suffering is attachment । অর্থাৎ, যেহেতু বৌদ্ধদর্শন মতে- জগতের সবকিছুই অনিত্য (Impermanence) সেহেতু, জাগতিক ক্ষণস্থায়ী বিষয়াবলীর সাথে “আমাদের শরীর এবং চৈতন্য” বা “আত্ম” আসক্তিযুক্ত বা বন্ধনযুক্ত হয়ে উঠে বলেই উপরে বর্ণিত ৮ প্রকার দুঃখমূল উৎপন্ন হয়।
তাহলে আমরা সহজভাবে বলতে পারি, যেখানে শরীর- এরই অস্তিত্ব নেই সেখানে কীভাবে দুঃখ থাকবে? যেখানে “আত্ম” বলতেই কিছু নেই সেখানে দুঃখ উৎপন্ন হওয়ার প্রশ্নই আসে না। এভাবেই, যখন কেউ ধারাবাহিক এবং নিবিড় চর্চার মধ্য দিয়ে স্বয়ং উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যে, জগত-জীবন সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী, অনিত্য এবং অনাত্ব তখন তারা সবকিছুর মধ্যেই কেবল শূণ্যতা দর্শন করেন। সুতরাং আমরা এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে,- জাগতিক সবকিছুকেই অনিত্য, অনাত্ম, শূণ্যতাবিশিষ্ট এবং অনাসক্তরুপে দর্শন করাই হচ্ছে জ্ঞান বা প্রজ্ঞাদৃষ্টি। বুদ্ধের বহু শিষ্য এবং অনুসারী বুদ্ধবর্ণিত এই প্রজ্ঞাদৃষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বৌদ্ধ পরিভাষায় তাদেরকে “অরহত” বলা হয়, যিনি সকল “অরি” বা আসক্তি-কে হত বা পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছেন। বৌদ্ধদর্শনের মৌলিক এবং চুড়ান্ত আলোচ্য “নির্বাণ” হচ্ছে একধরনের শূণ্যতা। জগত এবং জীবন-কে অনিত্যরুপে দর্শন করার জন্য স্বয়ং উৎপন্ন প্রজ্ঞাদৃষ্টি-র মাধ্যমেই কেবল শূণ্যতা -কে যথার্থরুপে উপলব্ধি করা সম্ভব। এমনটা যারা করতে সক্ষম হন তারাই “অরহত” বা নির্বাণপ্রাপ্ত।
৪. ধর্মদৃষ্টি (ধর্মচক্ষু)/ Dharma Eye:
এবার আসা যাক, ধর্মদৃষ্টি বিষয়ে। বুদ্ধের মতে, আমরা সাধারণ দৃষ্টিতে এবং দিব্যদৃষ্টিতে জাগতিক বিষয়াবলীর অনিত্য, পরিবর্তনশীল, অপূর্ণাঙ্গরুপকে যথার্থ ও সম্যকরুপে দর্শন বা উপলব্ধি করতে পারি না বরং আমরা জাগতিক মোহবশত সবকিছুকেই নিত্য, সম্পূর্ণ এবং চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করি। সেকারণে, আমরা জাগতিক বিষয়াবলীর সাথে আসক্তিযুক্ত হই এবং এতে নানাবিধ জাগতিক দুঃখ উৎপত্তি হয়। এটা একপ্রকার “অতিমাত্রা” (Extreme)। অন্যদিকে, প্রজ্ঞাদৃষ্টি অনুসারে আমরা যদি সবকিছুর মধ্যেই কেবল শূণ্যতা দর্শন করি এবং শূণ্যতায় আসক্ত হই তবে সেটাও একপ্রকার “অতিমাত্রা” (Extreme)। সেকারণে, বুদ্ধ তার শিষ্যদের প্রজ্ঞাদৃষ্টি-র পাশাপাশি ধর্মচক্ষু বা ধর্মদৃষ্টি উৎপন্ন করার শিক্ষা দিয়েছেন।
যখন কেউ প্রজ্ঞাদৃষ্টিতে জাগতিক বিষয়াবলীকে শূণ্যতাবিশিষ্টরুপে দর্শন বা উপলব্ধি করেন কিন্তু শূণ্যতা-র মধ্যেও তিনি আসক্তরুপে অবস্থান করেন না বা শূণ্যতা-র দিকেও অনাসক্তি চর্চা করেন তবে তিনি ধর্মচক্ষু বা ধর্মদৃষ্টির অধিকারী বলে অভিহিত করা যায়। যে কোন বস্তু বা বিষয়াবলীর “আপাতঃমূর্ত অভিব্যক্তি” (Manifestation) ঠিক যেমন, সেটাকে ঠিক তেমনরুপেই দর্শন করা-ই ধর্মদৃষ্টি। অর্থাৎ আপাতবিচারে যেটা যেমন, সেটাকে তেমনভাবেই বিবেচনা করা। আমরা প্রজ্ঞাদৃষ্টি আলোচনার সময় একটা বিল্ডিং-কে উদাহরণ হিসেবে নিয়েছিলাম এবং সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছিলাম যে, বিল্ডিং বলতে আসলে কিছু কি আছে? সবই তো শূণ্য। কিন্তু, তাৎক্ষণিকভাবে বিবেচনা করলে “বিল্ডিং একটি “আপাতঃমূর্ত অভিব্যক্তি” (Manifestation) এবং আপাতঃমূর্ত সত্য।
যার মধ্যে ধর্মদৃষ্টি উৎপন্ন হয়, তিনি বিষয়াবলীকে একদিক থেকে যেমন, “আপাতঃমূর্ত অভিব্যক্তি” (Manifestation) বলে দর্শন করেন অন্যদিকে একইসাথে তিনি জানেন যে চুড়ান্তবিচারে সবকিছুই শূণ্যতাবিশিষ্ট। এমন উপলব্ধিবিশিষ্ট ব্যক্তিগণের মনচিত্তের মধ্যে একপ্রকার স্বতস্ফূর্ত, নিঃস্বার্থ এবং শর্ত ও বিভাজনবিহীন বিশ্বজনীন গভীর মৈত্রী-করুণা ভাব উদয় হয়। ধর্মদৃষ্টিবিশিষ্ট এবং নিঃস্বার্থ ও ভেদাভেদহীন বিশ্বজনীন গভীর মৈত্রী-করুণা সম্পন্ন ব্যক্তিগণকে বৌদ্ধ সাহিত্যে বোধিসত্ত্ব বলে অভিহিত করা হয়। শেন এর বইয়ে বোধিসত্ত্বগণের ধর্মদৃষ্টি ও উদার গুণাবলী নিয়ে দুইটি ছোট গল্পের উল্লেখ আছে। আমরা সেগুলো আলোকপাত করে দেখতে পারি-
ধরুন, একটি বহুতলবিশিষ্ট বিল্ডিং এ হঠাৎ ভয়াভহ আগুন লাগলো। বিল্ডিংটির মধ্যে জরুরী অবস্থায় নিরাপদে বের হয়ে আসার জন্য একটিমাত্র পথ রয়েছে। বিল্ডিং এর ভিতরে বহু লোক, মহিলা এবং শিশু আটকে রয়েছে, যাদের অনেকেই জানে না ভিতরে ভয়াভহ আগুন লেগেছে। কিছু লোক আগুন সম্পর্কে অবহিত হলো এবং তাড়াহুড়ো করে বিল্ডিং থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজতে লাগলো। জরুরী অবস্থায় বিল্ডিং থেকে নিরাপদে বের হয়ে আসার পথটি বেশ বিপদজনক এবং লম্বা। প্রচন্ড ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে অবশেষে কিছু লোক বের হয়ে আসতে সক্ষম হলো। আশু বিপদ থেকে সদ্য মুক্ত হওয়ার পরে তারা স্বস্তি পেল এবং কেউই আর অন্যকিছু ভাবতে পারছে না। কিন্তু ভিতরে এখনো অনেকেই আটকে পড়ে আছে এবং অনেকেই জানেও না যে বিল্ডিং এর মধ্যে আগুন লেগেছে। যারা আগুনের কথা জেনে গেছে তারাও হয়তো নিরাপদে বের হয়ে আসার পথটি কোনদিকে তা ঠিক জানে না।
এমতাবস্থায়, বের হয়ে আসা লোকদের মধ্য থেকে কেউ একজন ভিন্নভাবে চিন্তা করলো। সে ভিতরে আটকে পড়া লোকদের কীভাবে জরুরী পথটি দেখিয়ে দিয়ে নিরাপদে উদ্ধার করা যায় তা চিন্তা করলো এবং নিজের সমূহ বিপদ এবং আশু ঝুঁকি-র কথা বিবেচনা না করে সে পুনরায় বিল্ডিং এর মধ্যে প্রবেশ করলো আটকে পড়া লোকগুলিকে জরুরী পথটি দিয়ে নিরাপদে বের করে আনার জন্য। এভাবে সে আটকে পরা লোকগুলিকে উদ্ধার করার জন্য বারবার নিজের সমূহ বিপদ ও আশু ঝুঁকিকে উপেক্ষা করে বিল্ডিং এ প্রবেশ করে একের পর এক দলকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে চেষ্টা করতে লাগলো। সেক্ষেত্রে এই উদার ব্যক্তিকে একজন ধর্মদৃষ্টিসম্পন্ন ও বোধিসত্বগুণাবলীসম্পন্ন বলে অভিহিত করা যায়, যিনি বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার পথ নিজে চিনে নিয়ে অন্যান্যদেরকেও মুক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বৌদ্ধসাহিত্যে এরকম অনেক গল্প আছে যেখানে দেখা যায় বোধিসত্ত্বগণ নিজের জীবনের বিনিময়েও উদারভাবে অপরের মঙ্গল সাধন করে থাকেন।
Professor Huston Smith রচিত বহুলপঠিত বই- The Religions of Man, নিউইয়র্ক, আমেরিকান লাইব্রেরী, ১৯৫৮ থেকে শেন অন্য আরেকটি গল্পের উল্লেখ করেছেন এভাবে-
একদল লোক রত্নসম্পদ অনুসন্ধান করতে করতে একটি বিশালকায় মরুভূমির দূরবর্তী স্থানে চলে গেল। সূর্যের প্রচন্ড খড়তাপে পুড়তে পুড়তে এবং তপ্ত মরুভূমির বুকে বহুদূরের পথ হাঁটতে হাঁটতে তারা সবাই ক্লান্ত-শ্রান্ত-পিপাসার্ত। এমতাবস্থায় তাদের বিশ্রাম এর জন্য ছায়া ও তৃঞ্চা মেটানোর জন্য জল ও খাবার প্রয়োজন।
দলটির মধ্য থেকে তিনজন ব্যক্তি আরো কিছুদূরে অগ্রসর হয়ে দেয়ালঘেরা একটি জায়গা খুঁজে পেল। প্রথমজন দেওয়াল পার হয়ে জায়গাটির মধ্যে প্রবেশ করল এবং খুশিতে দুয়েকটি চিৎকারও দিল। দ্বিতীয়জনও তাকে অণুস্মরণ করে সাথে সাথেই সেখানে চলে গেল। এবার তৃতীয়জন দেওয়ালটির উপরে উঠামাত্রই দেখতে পেল যে জায়গাটির মধ্যে পাম গাছ এবং ফুলের বাগান দিয়ে পরিবেষ্টিত বেশ প্রশস্ত একটি পুকুর রয়েছে। যেইমাত্র সে দেওয়াল বেয়ে জায়াগাটির মধ্যে প্রবেশ করতে যাবে, অমনিই তাঁর পেছনে পড়ে থাকা বাকি লোকগুলোর কথা মনে পড়ে গেল যারা অন্যএকদিকে এবং বেশ কিছুদূরে পরে রয়েছে। সে দেওয়াল বেয়ে জায়গাটির মধ্যে প্রবেশ না করে বরং অপরাপর লোকগুলোকে সেখানে নিয়ে আসার জন্য পুনরায় তাদের কাছে ফিরে গেল যেন সবাই মিলে পিপাসা মিটানো যায় এবং বিশ্রাম নেওয়া যায়। তবে সেই ব্যক্তির মধ্যে নিঃসন্দেহে বোধিসত্ত্ব গুণাবলী বিদ্যমান, যিনি সতত অন্যের কল্যাণের জন্য নিজেকেও অগ্রাধিকার দেন না।
এখানে একটা বিষয় স্মর্তব্য যে, অরহত আর বোধিসত্ত্বগণের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। অরহতগণ এই জন্মের মধ্যেই জাগতিক মোহ, আসক্তি, দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করতে সমর্থ হয়ে “নির্বাণ” প্রত্যক্ষ করেন, অন্যদিকে বোধিসত্ত্বগণ পরবর্তী কোন এক মানবজন্মে স্বয়ং কোন এক সম্যক সম্বুদ্ধরুপে জন্ম গ্রহণ করবেন। অহরহতগণের মধ্যে প্রজ্ঞাদৃষ্টি এবং ধর্মদৃষ্টি উভয়ই যথাযথরুপে বিদ্যমান থাকতে পারে কিন্তু বোধিসত্ত্বগণের জীবনে প্রজ্ঞাচিত্ত এবং প্রজ্ঞাদৃষ্টির তুলনায় ধর্মচিত্ত এবং ধর্মদৃষ্টির প্রভাব বেশি থাকে।
৫. বুদ্ধদৃষ্টি (বুদ্ধচক্ষু)/ Buddha Eye:
চারপ্রকার চক্ষু এবং চক্ষুদৃষ্টি সম্পর্কে আমরা মোটামুটি একটা জুতসই আলোচনা করে নিয়েছি। এখন বুদ্ধচক্ষু বা বুদ্ধদৃষ্টি সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে এখানে স্বীকার করে নেওয়া প্রয়োজন যে, একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে একজন সম্যক সম্বুদ্ধের গুণাবলী, তাঁর লব্ধজ্ঞান এবং দৃষ্টি সম্পর্কে যথাযথরুপে আলোচনা করা কখনোই সম্ভব নয়। বুদ্ধগণের অসীম গুণাবলী স্বয়ং প্রত্যক্ষলব্ধ। তাই স্বয়ং বুদ্ধগণ ব্যতীত সাধারণ মানুষের পক্ষে যথার্থরুপে তা উপলব্ধি করা অসম্ভব। তাই বুদ্ধচক্ষু এবং বুদ্ধদৃষ্টি সম্পর্কে আমরা যাই আলোচনা করি না কেন তা যথার্থ এবং পূর্ণাঙ্গ কখনোই হয়ে উঠবে না এবং অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
তারপরেও আমরা ন্যুনতম একটা ধারণার জন্য আলোচনা করছি।
প্রথমত-
চর্মচক্ষু, দিব্যচক্ষু, প্রজ্ঞাচক্ষু এবং ধর্মচক্ষু সম্পর্কে আলোচনা করার সময় আমরা দেখতে পেয়েছি যে, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে একজন প্রত্যক্ষকারী (Subject) এবং প্রত্যবেক্ষণীয় বিষয়বস্তু (Object) বিদ্যমান রয়েছে। যেমন- চর্মচক্ষু ক্ষেত্রে মানুষ বা অপরাপর প্রাণীগণ প্রত্যক্ষকারী (Subject) এবং পার্থিব নানা দৃষ্টিগ্রাহ্য বিষয়বস্তুসমূহ হচ্ছে প্রত্যবেক্ষণীয় বিষয়বস্তু (Object)। দিব্যচক্ষুক্ষেত্রে দৈবসত্ত্বাগণ প্রত্যক্ষকারী এবং মহাবিশ্বের অগণিত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, সুক্ষাতিসুক্ষ রাশিমালা ও দৈব বিষয়বস্তুসমূহ হচ্ছে প্রত্যবেক্ষণীয় বিষয়বস্তু। জ্ঞান বা প্রজ্ঞাচক্ষুক্ষেত্রে প্রজ্ঞাদৃষ্টি অর্জনকারী একজন অরহত হচ্ছেন প্রত্যক্ষকারী এবং শূণ্যতা হচ্ছে প্রত্যবেক্ষণীয় বিষয়বস্তু। ধর্মচক্ষুক্ষেত্রে একজন বোধিসত্ত্বগুণাবলী সম্পন্ন ব্যক্তি হচ্ছেন প্রত্যক্ষকারী এবং বিশ্বজনীন বিবিধ বিষয়সমূহ হচ্ছে প্রত্যবেক্ষণীয় বিষয়বস্তু।
কিন্তু আমরা যখন বুদ্ধচক্ষু সম্পর্কে কথা বলবো তখন আমরা আর উপরোক্ত চারপ্রকার চক্ষুদৃষ্টির মত পৃথক পৃথকভাবে প্রত্যক্ষকারী (Subject) এবং প্রত্যবেক্ষণীয় বিষয়বস্তুর (Object) কথা বলতে পারবো না। অর্থাৎ আমরা যদি বলি যে, বুদ্ধ হচ্ছেন প্রত্যক্ষকারী (Subject) এবং বিশ্বব্রক্ষান্ড হচ্ছে প্রত্যবেক্ষণীয় বিষয়বস্তু (Object) তবে কথাটি ভূল হবে। বৌদ্ধতত্ত্ব অনুসারে, বুদ্ধগণের গুণাবলী অসীম যার কোন আদি বা শুরু এবং অন্ত বা শেষ নেই। সেকারণে যা বুদ্ধচক্ষু তাই বুদ্ধ এবং যা বুদ্ধ তাই বুদ্ধচক্ষু। সুতরাং বলা উচিত যা বিশ্বব্রক্ষান্ড তাই বুদ্ধ, যা বুদ্ধ তাই বিশ্বব্রক্ষান্ড। অর্থাৎ বুদ্ধগণের গুণাবলী এ মহাবিশ্বের সর্বত্র সমানভাবে বিরাজমান। তাই বুদ্ধচক্ষু এবং বুদ্ধদৃষ্টিকে মহাবিশ্বের অন্যান্য বিষয়বস্তু থেকে পৃথকভাবে পৃথকরূপে বিবেচনা করার কোন সুযোগ নেই।
দ্বিতীয়ত,-
বুদ্ধগণের স্বরুপ আদি এবং অন্তহীন (Infinite Infinity)। আমরা বিশ্বব্রক্ষান্ড (Cosmos) সম্পর্কে মন্তব্য করে থাকি যে মহাবিশ্ব অসীম (Infinite)। কিন্তু সম্যক সম্বুদ্ধগণের গুণরাশি সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে সেই অসীম ধারণা থেকেও অসীম মাত্রায় উপনীত হতে হয়। বৌদ্ধতত্ত্বে বলা হয়ে থাকে যে, বুদ্ধগণের গুণরাশি অসীম-অনন্ত এবং বুদ্ধগণ সম্যকরুপে সর্বজ্ঞ। আপাতবিচারে অবিশ্বাস্য এই ধারণাটিকে গাণিতিক উদাহরণের মাধ্যমে আলোচনা করা যায়।
পদার্থবিজ্ঞানের ধারণা অনুসারে আমরা জানি যে, শক্তির প্রথম রুপ, আকার বা অবস্থা হচ্ছে একটি সরলরেখা (The first degree of power is a line), শক্তির ২য় রুপ হচ্ছে ভূমিতল (The second degree of power is a plane), শক্তির তৃতীয় রুপ হচ্ছে ত্রিভুজ বা ত্রিমাত্রিক ক্ষেত্র (The third degree of power is three-dimensional space)। বর্ণিত এই তিনটি ক্ষেত্রেই শক্তির রুপ, আকার বা অবস্থা-র সর্বমোট আয়তন বা সীমারেখা অসীমরুপে কল্পনা করা যায়। তাহলে আমরা যদি, ক্রমাগতভাবে শক্তির ৪র্থ, ৫ম, ৬ষ্ঠ, ৭ম, ৮ম, ৯ম অবস্থা পর্যন্ত ব্যাখ্যা করতে চাই? সেটা একপ্রকার অসম্ভব। এর কোন শেষ নেই। অর্থাৎ বিশ্বব্রক্ষান্ডের স্বরুপ সম্পর্কে আমাদের মস্তিষ্ক যতটুকু পর্যন্ত কল্পনা করতে সক্ষম সেটা অতি নগণ্য এবং প্রকৃত বিচারে মহাবিশ্ব কল্পনারও অতীত। তাকে কল্পনা করেও শেষ করা যায় না। ঠিক সেরুপেই সম্যক সম্বুদ্ধগণের গুণরাশিও কল্পনারও অতীত। অসীম থেকে অসীমতর।
তৃতীয়ত,-
বুদ্ধগণের দৃষ্টি সর্বদা তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যুৎপন্ন এবং স্বতস্ফূর্ত। সাধারণ মানুষের পক্ষে এরকম একটি বিষয় ঠিকমতো ধারণা করতে পারা বেশ কঠিন। সাধারণভাবে আমাদের কাছে সময়ের স্থায়ীত্ব একটি বাস্তব ও মূর্ত স্বরুপ। সেকারণে আমরা বাল্যকাল, যৌবন, প্রৌড়, বৃদ্ধকাল প্রভৃতিরুপে সময়কে অতিবাহিত করছি বলে হিসেব করে থাকি। তাই সহস্র আলোকবর্ষ পরিমাপ করা আমাদের পক্ষে বেশ দূরুহ। কিন্তু কোটি-সহস্র আলোকবর্ষও বুদ্ধগণের দৃষ্টিতে নিমিষেই পর্যবক্ষেণীয়। বুদ্ধগণের দৃষ্টি সর্বদা সর্বত্র বিরাজমান । এ ধারণাটি ঠিকমতো কল্পনা করতেও আমাদের বেগ পেতে হয়।
চতুর্থত,-
বুদ্ধগণ, বুদ্ধচক্ষু বা বুদ্ধদৃষ্টি সবদিক থেকে অবিভাজ্য এবং সম্যকরুপে সর্বজ্ঞ বলে বিবেচ্য। বুদ্ধ মাত্রই অন্তহীন গুণরাশি। অনেকেই হয়তো “Yellow Submarine” নামে একটি সিনেমা দেখে থাকবেন। সেখানে দেখানো হয়েছে মস্তবড় ফাঁপা মেশিনের মতন (Vaccuam Machine) এক বিরাটাকার দৈত্য (Monster) সম্মুখে যা আছে তার সবকিছুকেই গিলে ফেলছে। এভাবে গিলতে গিলতে সে মহাবিশ্বের সবকিছুকেই গিলে ফেলল। একসময় সমস্ত বিশ্বব্রক্ষান্ডকেও সে গিলে ফেলল। কোনকিছুই যখন আর গিলে ফেলার জন্য অবশিষ্ট নেই সে নিজেকে নিজেই গিলে ফেলল। এবার দেখা গেল সমস্ত বিশ্বব্রক্ষান্ড যা সেই বিশালকার দৈত্যও তা। অর্থাৎ সে বিশ্বব্রক্ষান্ডে নিজেই অবিভাজ্যরুপে মিলিয়ে গেল। বুদ্ধগণের গুণরাশি বা আয়তনও সেরুপে অনন্ত।
শেন, বুদ্ধচক্ষু বা বুদ্ধদৃষ্টি সম্পর্কে এভাবে উপসংহার টেনেছেন-
1. No subject and no object; that is, no duality
2. Infinite infinity; that is, no space
3. Instaniety and spontaneity; that is, no time
4. All-inclusiveness and totality; that is, no nothingness.
আমরা এভাবে বাংলা নিতে পারি-
১. প্রত্যক্ষকারী এবং প্রত্যবেক্ষণীয় বিষয় নেই। অর্থাৎ দ্বৈতসত্ত্বাবিশিস্ট নয় বরং অদ্বৈত বা এককতাবিশিষ্ট
২. অসীম থেকে অসীমতর। সর্বত্র বিরাজমান।
৩. সর্বদা তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যুৎপন্ন এবং স্বতস্ফূর্ত। সর্বকালীন।
৪. সবদিক থেকে অবিভাজ্য এবং সম্যকরুপে সর্বজ্ঞ বলে বিবেচ্য। অন্তহীন গুণরাশি।
# প্রাসঙ্গিকভাবে স্মর্তব্য যে, বৌদ্ধতত্ত্বে ৩ প্রকার বুদ্ধের উল্লেখ আছে, যথা- ১. সম্যক সম্বুদ্ধ ২. প্রত্যেক বুদ্ধ ৩. শ্রাবক বুদ্ধ (অরহত)। বুদ্ধদৃষ্টি আলোচনা ক্ষেত্রে আমরা কেবল সম্যক সম্বুদ্ধগণকেই বুঝে থাকব।
শেন, তার লেখাটি শেষ করেছেন এভাবে-
Before I conclude today’s talk I would like to tell you another story,-
“A couple was always at odds with each other. Then they heard about the five eyes. One day they began to quarrel. It looked as if it would be one of their usual arguments with both husband and wife so upset, angry, and frustrated that they wouldn’t speak to each other for days. Suddenly the husband said, `I am using my heavenly eyes now. You are just a skeleton. Why should I argue with a skeleton? ` The wife kept silent for a while and then burst into laughter. The husband asked, “What are you laughing about?” The wife said, “I am using my wisdom eye and you’ve disappeared. Now there is nothing bothering me. I am in Shunyata.” Then they both laughed and said, “Let us both use our Dharma eyes. We are manifestations, but let’s live happily together in this realm.”
পুনশ্চ : লেখাটি সরাসরি অনুবাদকর্ম বলে বিবেচ্য নয়। কেবল চুম্বক অংশগুলোকে তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে এবং যথেষ্ট সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে। সেসব করতে গিয়ে কিছু ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। আমরা লেখাটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে মানবকল্যাণে প্রয়োজনীয় দৃষ্টিভঙ্গি উৎপন্ন করতে সক্ষম হই- এই কামনা করি।
May All The Living Being Be Happy.
লেখাটি ২০২০ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় জুমজার্নালে www.jumjournal.com । পাঠকদের জন্য এখানেও তুলে রাখলাম..