পাহাড়ের সাম্প্রতিক সময়ের সম্ভাবনাময়ী শিল্পীদের একজন শিল্পী নান্টু চাকমা। কোনপ্রকার সন্দেহ-সংশয় ব্যতিরেকেই আমার বিবেচনায় তিনি পাহাড়ের এসময়কার চিত্রশিল্পীদের মধ্যে অন্যতম সেরা। তিনি অত্যন্ত নির্লোভ এবং খুব সাধাসিধে জীবনবোধে বিশ্বাসী। কোন বাহ্যিকতা নেই, অহমিকা নেই, উচ্চাভিলাস নেই। নেই কোন খ্যাতির মোহ, প্রতিষ্ঠার লোভ।
প্রকৃত শিল্পীরা যেরকম জীবনযাপনে অভ্যস্ত হন, নান্টু দা-র জীবনাচার নিকটে যেয়ে অবলোকন করলে ঠিক সেরকমই মনে হয় এবং ঠিক এ জায়গাটিতেই তিনি সমসাময়িক অন্যান্য শিল্পীদের চেয়ে শিল্পবোধের বিচারে সৎ বলে বিবেচিত হতে পারেন। কিন্তু আর্থিক অস্বচ্চলতা, প্রযুক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে দুর্বলতা থাকায় হয়তো তিনি এখনো সেভাবে “মনযোগ” আকর্ষণ করতে পারেন নি। তারপরেও তাঁর রয়েছে অসংখ্য শুভাকাঙ্খী ও গুণগ্রাহী। চলতি লেখায় আমরা চিত্রশিল্পী নান্টু চাকমার টুকটাক শিল্পচর্চার এদিক-সেদিক এবং কাজের ধরন সম্পর্কে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।
তিনি ছবি আঁকেন একেবারে নিজের মনঃমত। সময়ের বাজারি চাহিদা অনুযায়ী নয়। রঙ মাখেন প্রগাঢ় আবেগে । ইচ্ছে হলে আঁকেন, নতুবা বসে থাকেন মাসের পর মাস। ঘুরে বেড়ান বনে বাদারে, নিভৃতে-নির্জনে। সমসাময়িক অনেকের মতোই বাজারি কাজের প্রতি তাঁর আগ্রহ নেই, নিষ্পৃহ। জীবনবোধে সন্দেহাতীতভাবে ন্যায়, সত্য-সুন্দর, শিল্প ও প্রকৃতির পূজারি।
শিল্পের নিশ্চয়ই নিজস্ব অভিব্যক্তি আছে এবং শিল্পীরও! নান্টুর কাজগুলোর সামনে দাঁড়ালে আমরা একইসাথে শিল্পের এবং শিল্পীর নিজস্বতার সাথে পরিচিত হই, নির্মল আবহের সন্ধান পাই। তার কোন ছবির সামনে ক্ষনিক দাঁড়ালে যে কেউই কাজটি করার সময়কার তাঁর ভাবনার জগতকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন।
শিল্পী নান্টু-র তুলি বেশ গতিময়, রঙ ব্যবহারে তিনি পরিণত, স্বচ্ছন্দ এবং সাবলীল। ক্যানভাস প্রায়শই প্রাণবন্ত এবং উচ্ছল। রঙ ছড়ানোর ধরন বেশ বৈচিত্রময়। নিবিড় অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে তুলে আনেন অন্য এক গভীর বোধের বুনন।
ক্যানভাসের পরিসর বা বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও নেই কোন তাড়াহুড়ো। তুলির আঁচড়গুলো প্রায়শই নিখুত এবং সূক্ষè। একবার যা ফোকাস করেন তা সাবলীল ব্যঞ্জনায় ফুটিয়ে তুলতে তিনি পারঙ্গম। বিশেষত এ্যাক্রিলিক মাধ্যমে ক্যানভাসের উপর গতিশীল তুলি চালানোর ক্ষেত্রে তাঁর হাতে দক্ষতার ছাপ স্পষ্ট।
নান্টুর কাজগুলোর মধ্যে একটা শৈল্পিক মাদকতা মিশে থাকে। তার বোধ উৎসারিত কাজগুলো যে কোন প্রকৃতিপ্রেমীকে বুদ করে রাখে নিদারুন মগ্নতায়।
তাঁর কাজগুলোতে পাহাড়ের প্রতি নিখাদ মমতার চিত্র ফুটে ওঠে। তাঁর কাজের বিষয়বস্তুর গভীরে খোঁজ নিলে দেখা যায় সেখানে আস্ত একটা সবুজ পাহাড় বসে আছ যেন! পাহাড়ের প্রতি নিখাদ ভালোবাসায় উদাসীন জীবন নিয়েই বোধহয় তিনি সাজাতে চান আরেক পাহাড়ের চুড়ো।
পাহাড়ি ছড়ায় চপল জুম্ম নারীর নিবিড় কথোপকথনের মতোই তাঁর ছবির ক্যানভাসের মাঝেই তিনি ধরা দেন অন্য একটি চোখ নিয়ে, অন্য এক অনুভূতি নিয়ে। ঘন-সবুজের কোলে ঐতিহ্যের চাঁদরে মোড়ানো নিটৌল পাহাড়ি গ্রাম কখনো কখনো তাঁর ছবির বিষয়বস্তু হয়, ঘুমিয়ে থাকা সারি সারি পাহাড়ের চিরন্তন মোহের টানে কখনো কখনো ছুট দেয় তার দূরন্ত এবং ক্ষ্যাপাটে তুলি।
এ্যাক্রিলিক মাধ্যমে ক্যানভাসের উপর আলোছায়ার বুনন নির্মাণে তিনি সমসাময়িক অনেকের তুলনায় বেশ এগিয়ে। এখানে আমরা তাঁর কয়েকটি সেরা এ্যাক্রিলিক কাজ দেখে নিতে পারি..
“হিল আর্টিস্ট গ্রুপ” এর প্রায় সবকটি চিত্র প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের পাশাপাশি তিনি সুযোগ পেলেই বিভিন্ন দলীয় কর্মশালা এবং শিল্পপ্রদশর্নীতে অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করেন। ২০০৯ সালে তিনি রাঙ্গামাটিতে একটি একক চিত্র প্রদর্শনী করেন। সেসময় তাঁর সবকটি কাজই ছিল জলরঙের। জলরঙের উপর করা তাঁর কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন কাজের উপর আমরা দৃষ্টি দিতে পারি …
প্রকৃত শিল্পচর্চা যারা করতে চান তারা দর্শনগত জায়গা থেকে নির্মোহ, অনুসন্ধানী এবং নিবেদিত হন। নান্টু দা-র ক্ষেত্রেও কথাটি বহুলাংশে সত্য। তিনি পার্থিব আকাঙ্খার বিচারে নির্মোহ অথচ সমাজ-রাজনৈতিক দ্বায়বোধের বিবেচনায় অগ্রগামী। সমাজ-রাজনৈতিক দ্বায়বোধের ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট সংবেদনশীল এবং সক্রিয়। পাহাড়ের গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সামিল থাকার চেষ্টা করেন। রাজনৈতিক বিভিন্ন প্রোগ্রামের ব্যানারগুলিও প্রায় সময়ই তিনি করে দেন নামমাত্র পারিশ্রমিক এ। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর খ্যাত-অখ্যাত বহু লেখকের বইয়ের প্রচ্ছদ কিংবা বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের অসংখ্য প্রচ্ছদ ডিজাইন তিনি করেছেন।
ওয়াল পেইন্টিং এর ক্ষেত্রেও তাঁর দখল অনবদ্য। সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ের বিভিন্ন সরকারি স্কুেল তিনি নামমাত্র পারিশ্রমিকে একটার পর একটা নান্দনিকতায় সমৃদ্ধ ওয়াল পেইন্টিং করে যাচ্ছেন। সেরকম একটি ওয়াল পেইন্ট..
নিদারুণ মমতায় জুম-বন-পাহাড়ের শিল্পী নান্টু জীবনবোধের তুলি নিয়ে নিখাদ আবেগের রঙ অবিরাম মেখে যাচ্ছেন একের পর এক ক্যানভাসে। আসুন নান্টুর এই শিল্পযাত্রায় পাশে দাঁড়াই। ন্যায়বোধে আপস না করি। শিল্প-সত্য-সুন্দর এর পাশে থাকি।